মানবেন্দ্ৰনাথ রায় (২২-৩-১৮৮৭ – ২৫-১-১৯৫৪) খেপুত—মেদিনীপুর। পিতা দীনবন্ধু ভট্টাচাৰ্য পূজারীর পৈতৃক বৃত্তি পরিত্যাগ করে ২৪ পরগনার কোদালিয়া গ্রামে শ্বশুরালয়ে বাস করেন এবং আড়াবেলিয়া গ্রামের বিদ্যালয়ে হেড পণ্ডিতের চাকরি নেন। প্রকৃতনাম নরেন্দ্রনাথ। বিপ্লবী কাজে বিভিন্ন সময়ে সি, মার্টিন, হরি সিং, মি. হোয়াইট, মানবেন্দ্ৰনাথ রায়, ডি, গাসিয়া, ডা, মাহমুদ, মি. ব্যানার্জী প্রভৃতি নাম গ্ৰহণ করতে হলেও মানবেন্দ্রনাথ নামটির পরিচিতি সর্বাধিক। পিতারস্কুলে তাঁর শিক্ষা শুরু। ১৮৯৭ খ্রী. হরিনাভি অ্যাংলো-সংস্কৃত বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে ১৯০৫ খ্রী. গুপ্ত বিপ্লবী দলে যোগ দেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ঐ অঞ্চলে এলে তাঁর সংবর্ধনা জানাতে ছাত্রদের নিয়ে মিছিল পরিচালনা করার অপরাধে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক বিতাড়িত সাতজন ছাত্রের মধ্যে তিনিও ছিলেন। জাতীয় বিদ্যাপীঠ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ (১৯০৬) হয়ে, যাদবপুরের বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। চাংড়িপোতা রেল স্টেশনে (বর্তমান সুভাষানগর) রাজনৈতিক ডাকাতিতে (১৯০৭) অংশগ্রহণ করার জন্য পুলিস সন্দেহক্রমে গ্রেপ্তার করলেও প্রমাণাভাবে তিনি মুক্তি পান। মজঃফরপুর বোমা ও মুরারিপুকুর বোমা মামলায় বেশীর ভাগ কর্মী ও নেতা ধরা পড়লে বাঘা যতীনের সহকর্মিরূপে আবার গুপ্ত সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯১০ খ্রী. ধরা পড়েন। প্রমাণাভাবে মুক্ত হবার পর তাঁকে সাধু-সন্ন্যাসীর সঙ্গ করতে দেখা যায়। অল্পদিন পরেই আবার বাঘা যতীনের নেতৃত্বে বিপ্লবী কর্মে লিপ্ত হয়ে ভারতে ও ভারতের বাইরে সংগঠন গড়তে থাকেন। ১৯১৪ খ্রী. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় বিপ্লবীগণ ইংরেজের শক্রি জার্মানদের কাছে অস্ত্ৰসাহায্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করার একটি বিরাট পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনায় তিনি প্রধান ভূমিকা নেন। এর প্রস্তুতির জন্য দুইটি ডাকাতিতে নেতৃত্ব দেন। (১২-১-১৯১৫ খ্রী. গার্ডেনরিচ ও ২২-২-১৯১৫ খ্রী. বেলিয়াঘাটায়) এবং মোট ৪০ হাজার টাকা সংগ্ৰহ করেন। এ ব্যাপারে মানবেন্দ্ৰনাথকে কারাবাস থেকে বাঁচানোর জন্য নেতা যতীন্দ্রনাথ ও পূর্ণ দাসের আদেশে রাধাচরণ প্ৰামাণিক স্বীকারোক্তি করেন এবং বিশ্বাসঘাতকের কলঙ্ক নিয়ে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেন। সি. মার্টিনের ছদ্মনামে তিনি বৈদেশিক যোগাযোগের প্রয়োজনে এপ্রিল ১৯১৫ খ্রী. বাটাভিয়া যাত্রা করেন। এ মাসেই উত্তর ভারতের বিপ্লবী দল অবনী মুখার্জীকে জাপানে পাঠায়। মার্টিন জুন মাসের মাঝামাঝি ভারতে ফেরেন। ইতিমধ্যে বিদেশী জাহাজো ভারতে অস্ত্ৰ আমদানির কথা একাধিক সূত্রে সরকার জানতে পারে এবং তল্লাশী ও ধরপাকড় শুরু হয়। ১৫৭৮-১৯১৫ খ্রী. পুনরায় আর একজন বিপ্লবী সহকর্মীর সঙ্গে তিনি দেশত্যাগ করেন। তাঁর সহকর্মী ধরা পড়েন। কিন্তু তিনি হরি সিং নামে ফিলিপাইনে অবতরণ করেন। এখান থেকে আবার নাম বদলে মি. হোয়াইটরাপে জাপানের নাগাসাকি বন্দরে অবতরণ করে রাসবিহারী বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নূতন চীনের জনক সান-ইয়াৎ সেনের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎকার ঘটে। কিছু অস্ত্ৰ স্থলপথে ভারতে পাঠাবার চেষ্টায় জাপানী পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে পিকিং যাত্রা করেন। দেড় বছর দূর প্রাচ্যের প্রায় সকল দেশ ভ্ৰমণ করে ১৯১৬ খ্রী. সানফ্রানসিসকোয় অবতরণ করেন। সেখানে জার্মান গুপ্তচর অপবাদ এড়াতে পালো আন্টোতে ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়ের আশ্রয়ে কিছুদিন থাকেন এবং তাঁরই পরামর্শে নাম গ্ৰহণ করেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। আমেরিকা ইতিমধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং জাতীয়তাবাদী ভারতীয় বিপ্লবীদের জার্মান স্পাই বলে গ্রেপ্তার শুরু হয়। এ সময় ভারতের পক্ষে প্রচারের জন্য আমেরিকায় ভ্ৰমণরত লালা লাজপত রায় ও মানবেন্দ্রনাথ আমেরিকায় র্যাডিক্যালদের সংস্পর্শে আসেন। তাদের প্রভাবে তিনি মার্ক্সবাদ পড়তে আরম্ভ করেন। জীবনের শেষে ‘ফিজিক্যাল রিয়্যালিজম’ নামে এক দর্শনের প্রবক্তা হন। সোশ্যালিস্ট ভ্রাতৃসঙ্ঘের তিনিই প্ৰথম ভারতীয় সদস্য। এই সময়ে আমেরিকায় থাকা নিরাপদ নয় বুঝে তিনি মেক্সিকো যান এবং সোশ্যালিস্ট পার্টি পরিচালিত মেক্সিকোর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে একজন মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকরূপে প্ৰতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি মেক্সিকোয় সোশ্যালিস্ট পার্টিকে কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত করে রাশিয়ার বাইরে বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবর্তকরূপে পরিচিত হন। পরে বোরোদিনের মারফত লেনিন কর্তৃক মস্কোয় যাওয়ার নিমন্ত্রণ পান। মেক্সিকোকে তিনি তাঁর দ্বিতীয় জন্মভূমি বলেছেন। ১৯১৯ খ্ৰী. ডি. গার্সিয়া ছদ্মনামে মেক্সিকো ছাড়েন এবং স্ত্রী এভলিন ট্রেন্টসহ বার্লিন প্রভৃতি ঘুরে ১৯২০ খ্রী. মস্কোয় পৌঁছে ‘মে দিবসে’র সমাবেশে বক্তৃতা করেন। মেধা ও বুদ্ধিমত্তার জন্য তিনি লেনিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন এবং তৎকালীন রাশিয়ার প্রথম শ্রেণীর তাত্ত্বিকদের একজন বলে পরিগণিত হন। জুলাই মাসের কংগ্রেসে লেনিনের উপনিবেশ-বিষয়ক থিসিসের সঙ্গে একমত না হয়ে নিজস্ব থিসিস দেন এবং সেটি দ্বিতীয় কংগ্রেসে লেনিন থিসিসের পরিশিষ্টরূপে গৃহীত হয়। এই কংগ্রেসে কার্যনির্বাহক সমিতির প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন ‘স্মল ব্যুরো’র সদস্য নির্বাচিত হন। কমিন্টানের মধ্য এশিয়ার বুরোর সদস্যও হন কিন্তু ১ থেকে ৮ জুলাই বাকু শহরে অনুষ্ঠিত মধ্য এশিয়ার সম্মেলনে উপস্থিত না হয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ তাশখন্দ রওনা হন। এখানে থিবা শহরে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির কয়েকজন পলাতক সৈন্য ও ইরানী বিপ্লবীদের সংগঠিত করে তিনি লাল ফৌজের এক আন্তর্জাতিক বাহিনী গড়ে তোলেন। এই সৈন্যদলের সাহায্যে তিনি মেশেদ–কোয়েটা সড়ক ও ট্রান্সকাম্পিয়ান রেলপথের কয়েকশত মাইল শক্রমুক্ত করেন। এ অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ প্রভাব লুপ্ত হয় এবং সোভিয়েট সীমান্ত নিরাপদ হয়। তিনি বোখারায় হস্তক্ষেপ করে এক সোভিয়েট সরকার স্থাপন করেন। ফরগনা দখলের দুঃসাহসিক অভিযানেও বিজয়ী হন। মস্কোয় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তৃতীয় সম্মেলনে যোগ দেন। অবনী মুখার্জীর সঙ্গে যৌথভাবে রচিত ‘India in Transition’ গ্রন্থটি এ সময়ে প্রকাশিত হয়। তৃতীয় আন্তর্জাতিকে (১৯২২) তিনি অন্যতম সভাপতি নিযুক্ত হন। এর পরই মস্কোয় টয়লার্স অফ দি ঈস্ট’ নামে বিদ্যালয় খোলা হয় এবং তিনি এখানে উচ্চপদ লাভ করেন। করাচীতে অনুষ্ঠিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে তিনি তাঁর গোপন দূত নলিনী গুপ্ত (কুমার) মারফত কাৰ্যসূচী পাঠান। ১৯২২ খ্ৰী. আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংস্থার কার্যকরী সমিতির বিকল্প সদস্য ও ১৯২৪ খ্রী. সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম এবং বিশিষ্ট সম্পাদক হন। ১৯২৩ খ্রী. শওকত ওসমানি, মুজফফর আমেদ প্রভৃতির নামে যে ষড়যন্ত্রের মামলা ভারতে শুরু হয়। তিনি তার প্ৰথম আসামী ছিলেন। তিনি ইউরোপ থেকে ‘ভ্যানগার্ড’, ‘ম্যাসেস’, ‘অ্যাডভান্স গার্ড’ প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে প্রচার চালাতেন। ১৯২৪ খ্রী. লেনিনের মৃত্যুর পর চীনদেশে বিপ্লব পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠনের পক্ষ থেকে বোরোদিনকে সাহায্যের জন্য তিনি চীনে প্রেরিত হন। এখানে বোরোদিনের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য হওয়ায় চীন থেকে বহিষ্কৃত হন (১৯২৭)। চীনদেশের এই ঘটনার পর থেকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠনে তাঁর পতন সূচিত হয়। ১৯২৮ খ্রী. স্ত্রী এভলিনের সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়। কমিন্টার্ন-এর ষষ্ঠ কংগ্রেসে (১৯২৮) তাঁর অনুপস্থিতিতে ‘ডিকলোনাইজেশন থিসিস’ লেখার জন্য তিনি নিন্দিত ও কমিন্টার্ন থেকে বিতাড়িত হন। ১৯২৯ খ্রী. ব্রন্ডলার নামক জার্মান বন্ধুর পত্রিকায় ‘কমিন্টার্নের সঙ্কট’ নামে ধারাবাহিক প্ৰবন্ধ প্ৰকাশ করতে থাকেন ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে নিজের বিরোধিতা প্রকাশ করে কমিউনিস্ট সমাজচ্যুত হন। বিভিন্ন প্ৰবন্ধ রচনায় এলেন গটসচেক তাকে সাহায্য করতেন। ১৯৩০ খ্রী. ডা মাহমুদ ছদ্মনামে তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। জুন ১৯৩১ খ্রী. বোম্বাই শহরে ধরা পড়েন। ৬ বছর কারাবাসকালে গড়ে ওঠে তাঁর বিখ্যাত দর্শন ‘ফিজিক্যাল রিয়্যালিজম’। কারামুক্তির পর কংগ্রেসের ফৈজপুর অধিবেশনে সম্মানিত নেতারূপে যোগ দেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে ভারতের রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব অনুভূত হয় না। ৪৯৪-১৯৩৭ খ্রী. বোম্বাই থেকে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্ডিয়া’ নামে পত্রিকা প্ৰকাশ করেন। ১৯৩৯ খ্রী. পত্রিকার নাম বদলে ‘র্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট’ নামে প্ৰকাশ করতে থাকেন। ২৬-১০-১৯৪০ খ্রী. র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পিপলস পার্টি গঠন করেন। প্ৰথমা স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তিনি ইউরোপীয় কৃষক সমিতির সম্পাদিকা এলেন গটসচেককে বিবাহ করে দেরাদুনে থাকতেন। ১৭টি ভাষায় দক্ষতা ছিল। তাঁর রচিত ৬৭টি গ্রন্থ ও ৩৯টি পুস্তিকার সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলি ইংরেজী, ফরাসী, স্প্যানিশ ও জার্মান ভাষায় রচিত। তাঁর অসমাপ্ত জীবনস্মৃতি মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য রচনা : ‘Revolution and Counter-revolution in China’, ‘New Humanism’, ‘Reason, Romanticism and Revolution’ (2 Vols), ‘My Memoirs’ প্রভৃতি।
পূর্ববর্তী:
« মানকৃষ্ণ নামদাস
« মানকৃষ্ণ নামদাস
পরবর্তী:
মানসিং মাঝি »
মানসিং মাঝি »
Leave a Reply