মনোরঞ্জন গুপ্ত (৭-৩-১৮৯০ – ১৩-১০-১৯৭৬) আধুনা–বরিশাল। দীনবন্ধু। ১৯০৯ খ্রী. বাটাজোড় উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। বরিশাল ব্ৰজমোহন কলেজে আই.এ. পড়ার সময় সহাধ্যায়ী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু হীরালাল দাশগুপ্তের আগ্রহে বরিশাল শঙ্কর মঠের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্ৰজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর (ব্ৰহ্মচারী সতীশচন্দ্ৰ মুখোপাধ্যায়) নেতৃত্বে স্থাপিত বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির দলে যোগ দেন। এই ‘বরিশাল দল’ পরে যুগান্তর দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ব্ৰজমোহন কলেজ থেকে ১৯১৪ খ্ৰী. বি.এ. পাশ করে দলের কাজে কলিকাতা চলে আসেন। তাঁর আগে পর্যন্ত বরিশাল জেলার বিভিন্ন স্থানে যে তিনটি ডাকাতি হয় তার প্ৰত্যেকটিতে তিনি সক্রিয় অংশ গ্ৰহণ করেন। তাঁর পরিচালনায় ৬-১১-১৯১৫ তারিখে কলিকাতার মসজিদবাড়ি স্ট্রীটের এক বাড়িতে পুলিস ইনস্পেক্টর গিরীন মুখার্জী নিহত এবং ২-১২-১৯১৫ তারিখে করপোরেশন স্ট্রীটের এক সোনার দোকানে ডাকাতি হয়। প্রথম ঘটনায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভূপতি মজুমদার ও আলিপুরদুয়ারের প্রখ্যাত ডাক্তার ব্ৰজেন্দ্রনাথ দত্ত। বিপ্লবী নরেন ঘোষ চৌধুরীর অতি ঘনিষ্ঠ সহকর্মিরূপে বহু রোমহর্ষক কাজের অংশীদার ছিলেন। ১৯১৬ খ্রী. তিন আইনে গ্রেপ্তার হয়ে রাজবন্দী হিসাবে সাড়ে চার বছর। জেলে আটক থাকেন। ছাড়া পেয়ে ১৯২০ খ্রী. অরুণচন্দ্ৰ গুহর সহযোগিতায় কলিকাতার হ্যারিসন রোডে প্ৰজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর নাম অনুসারে ‘সরস্বতী লাইব্রেরী’ স্থাপন করেন। বই-বিক্রির ভার নিলেন বিপ্লবী কিরণচন্দ্ৰ মুখোপাধ্যায়। ১৯২১ খ্রী. অসহযোগ আন্দোলনকালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন তাঁর ও জিতেন্দ্রনাথ দত্তের উপর বরিশালের আন্দোলন সংগঠনের ভার অর্পণ করেন। শ্ৰীসরস্বতী প্রেসের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২৩ খ্রী. প্রেসের কাজ আরম্ভ করে তাঁর প্রথম ম্যানেজার হন। ঐ বছরই নেতৃস্থানীয় আরো অনেকের সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হয়ে ১৯২৮ খ্রী. ছাড়া পান। ঐ বছরে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি খাদি প্রদর্শনীর সম্পাদক ছিলেন। এই সময়ে সত্যেন্দ্ৰচন্দ্ৰ মিত্র, হরিকুমার চক্রবর্তী ও প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে মিলে তিনি ‘বেঙ্গল ইনসিওরেন্স এন্ড রিয়াল প্ৰপাটি কোম্পানী’ নামে এক জীবনবীমা কোম্পানীর পরিচালন-ভার গ্রহণ করেন এবং এই কোম্পানীর কাজে ১৯২৯ খ্রী. মাদ্রাজ শাখার সেক্রেটারী হিসাবে বৎসরাধিককাল মাদ্রাজে কাটান। ১৯২৯ খ্ৰী লাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব পাশ হয়। এর পরই তিনি ও অন্যান্য বিপ্লবীরা সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে মিলিত হয়ে দাবি করতে আরম্ভ করেন যে এই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে এখনই কংগ্রেসের আন্দোলন আরম্ভ করতে হবে। ১৮৯৪-১৯৩০ খ্রী. চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে শ্ৰীসরস্বতী প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা’ সাপ্তাহিকে ভূপেন্দ্ৰকুমার দত্তের ‘ধন্য চট্টগ্রাম’ প্রবন্ধের জন্য সরকার পত্রিকাটি বে-আইনী ঘোষণা করে ও প্রেসের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা জামানত নেয়। এই সময়ে দলের ডাঃ নারায়ণ রায় প্রমুখের চেষ্টায় বোমা তৈরির কাজ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চলতে থাকে। প্ৰত্যেক জেলার ইউরোপীয়ান ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়ি অথবা সেখানের ইউরোপীয়ানদের ক্লাবে বোমা ফেলে তাদের আতঙ্কিত করে ইংরেজদের দেশ-ছাড়া করার যে রাজনৈতিক চাপ-সৃষ্টির কার্যসূচী তখন নেওয়া হয়, তাতে তাঁর অবদান অনেকখানি। ডিসে, ১৯৩০ খ্রী. ফেরারী অবস্থায় ধরা পড়ে ১৯৩৮ খ্রী; ছাড়া পান। ঐ বছর যুগান্তর দলভুক্ত সকলের মিলিত সিদ্ধান্ত অনুসারে খবরের কাগজে প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হলে অন্যান্যদের সঙ্গে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। রামগড় কংগ্রেসে গৃহীত ব্যাপক সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রস্তুতির কাজে নিযুক্ত থাকার সময় তিনি ফরিদপুরে গ্রেপ্তার হন এবং জেলে থাকতেই ১৯৪৬ খ্ৰী. বরিশাল জেলা থেকে এমএলএ নির্বাচিত হয়ে মুক্তিলাভ করেন। ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে স্বাধীন হবার পর তিনি তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে যান। বরিশাল থেকে নির্বাচিত হয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের আইনসভায় সাত বছর এমএল-এ ছিলেন। ১৯৫৪ খ্রী. সাধারণ নির্বাচনে প্ৰতিদ্বন্দ্বিতা না করে কলিকাতায় চলে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ আইনসভায় এমএলসি হিসাবে ১৫ বছর ছিলেন। আইনসভার বাইরে তিনি প্রধানতঃ সমবায়ের কাজ নিয়ে ব্যাপৃত থাকতেন। তাঁর রচিত গ্ৰন্থ: ‘সমবায়মূলক সাধারণতন্ত্র ও বিশ্ব রাজনীতি, ‘Philosophy Of Co-operation’, ‘বিপ্লবীর জীবনস্বপ্ন-সমবায় সমাজ’, ‘রবীন্দ্ৰ চিত্ৰকলা’, ‘যারা হারিয়ে গেল’, ‘মেকিয়াভেলির রাজনীতি’ ইত্যাদি।
পূর্ববর্তী:
« মনোমোহন সেন, ড.
« মনোমোহন সেন, ড.
পরবর্তী:
মনোরঞ্জন গুহ »
মনোরঞ্জন গুহ »
Leave a Reply