বীরেন্দ্ৰনাথ চট্টোপাধ্যায় (১৮৮০ – ৬-৪-১৯৪৩) ব্ৰাহ্মণগাঁ-ঢাকা। শিক্ষাবিদ অঘোরনাথ। পিতারকর্মস্থল হায়দ্রাবাদে জন্ম। মাদ্রাজ থেকে প্ৰবেশিকা ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পাশ করেন। ১৯০১ খ্রী. আইসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিলাত যান। সেখানে বীর সাভারকরের প্রভাবে বিপ্লবমান্ত্রে দীক্ষা নেন। সিভিল সার্ভিস পাশ করতে না পেরে ব্যারিস্টার হবার চেষ্টা করেন। ১৯০৬ খ্রী. নবীন তুকীর কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন এবং ভারতের জাতীয় আন্দোলনে সাহায্য চান। এই বছর শ্যামাজী কৃষ্ণবর্মা প্রতিষ্ঠিত লন্ডনের ইন্ডিয়ান সোশিওলজিস্ট পত্রিকা পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব তাঁর ওপর পড়ে। ইউরোপের ব্রিটিশ-বিরোধী সংবাদপত্র ‘তলোয়ার’-এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। ইন্ডিয়া হাউসের ছাত্রদের অভিনব ভারত সঙ্ঘের ও ফ্রী ইন্ডিয়া সোসাইটির সদস্যদের রাজনৈতিক শিক্ষার ভার গ্রহণ করেন। ১৯০৯ খ্রী মদনলাল ধিংড়ার হাতে উইলিয়ম কার্জন ওয়াইলী নিহত হলে তাঁর মিডল টেম্পলের ব্যারিস্টারী সনদ বাতিল হয় ও গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য তিনি পরের বছর প্যারিসে চলে আসেন। তখন থেকে ‘তলোয়ার’ ও ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকা দুটির পরিচালনায় সহযোহিতা করেন। ফরাসী সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য হলেও মনেপ্ৰাণে একজন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী ছিলেন। এই সময় তাঁর জ্যেষ্ঠা ভগিনী খ্যাতনাম্নী দেশনেত্রী সরোজিনী নাইডু ব্রিটিশ সরকারের চিঠির জবাবে লেখেন—বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের কোন সম্পর্ক নেই–বহুদিন আগেই তাকে অর্থসাহায্য পাঠানো বন্ধ হয়েছে। প্যারিসে কাজ করার সময় বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে পরিচিত হন। বার্লিনে অবস্থানকালে তাঁর রচিত ‘Japan, The Enemy of Asiaľ গ্রন্থে আকৃষ্ট হয়ে জার্মান সরকার ভারতীয় বিপ্লববাদীদের ব্রিটিশ-বিরোধী বৈপ্লবিক কার্যকলাপে সাহায্য করার ইচ্ছা প্ৰকাশ করলে তিনি শক্রর শত্ৰু কাইজারের সঙ্গে ১৫ দফা চুক্তি করলেন—ভারতে বিপ্লব প্রচেষ্টায় আর্থিক ও সামরিক সাহায্য লাভের আশায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে তাঁরই উদ্যোগে জার্মানীতে সমবেত ভারতীয়দের নিয়ে বিপ্লবী সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স কমিটি’ (বার্লিন কমিটি) গড়ে ওঠে এবং তিনিই তাঁর প্রথম সম্পাদক হন। ১৯১৬, খ্রী. পর্যন্ত এই কমিটির সম্পাদক ছিলেন। এই কমিটি ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্ৰাচ্য এমন কি সুদূর মেক্সিকো ও ব্ৰেজিল পর্যন্ত যোগাযোগ করে এবং বহু দুঃসাহসী ভারতীয় যুবক এই কর্মযজ্ঞে যোগ দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল যাত্রা শুরু করেন। স্টকহোমে ১৯১৭ খ্রী. যে শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে বীরেন্দ্রনাথ প্রমুখ ভারতীয় বিপ্লবীরা যোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধান্তে বার্লিন কমিটির কার্যকলাপ শেষ হয়। ৯.৭-১৯১৯ খ্রী। তিনি ‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকায় তাঁর সন্ত্রাসবাদ ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করেন। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে তিনি মস্কোয় যান। মস্কো সফরে তাঁর সঙ্গিনী ছিলেন আমেরিকার শ্রমিক কন্যা ভারত দরদী অ্যাগনেস স্মেন্ডলী। মস্কোয় বীরেন্দ্ৰনাথ ও স্মেন্ডলী পরস্পর স্বামী-স্ত্রী বলে ঘোষণা করেন। ১৯২১ খ্রী. আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংস্থা ‘তৃতীয় আন্তর্জাতিক’-এর তৃতীয় সম্মেলনের প্রাক্কালে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পাণ্ডুরং খানখোজে প্রমুখ একদল ভারতীয় বিপ্লবীর নেতা হিসাবে তিনি পুনরায় মস্কো যান। ১৯২২ খ্রী. জাতীয় কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে তিনি একটি স্মারকলিপি পাঠান। এতে জাতীয় কংগ্রেসকে কিভাবে একটা গণ-পরিষদে পরিণত করা যায় তাঁরই ব্যবস্থা প্রদত্ত হয়েছিল। ১৯২৬ খ্রী. তিনি রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে লর্ড সত্যেন্দ্ৰ সিংহের দ্বারা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কাছে ভারতে ফেরার জনয অনুমতি লাভের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ১৯২৭ খ্রী. ব্রাসেলস শহরে যে ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সঙ্ঘ’ স্থাপিত হয় তিনি তাঁর অন্যতম সম্পাদক এবং ব্রাসেলস সম্মেলনের একজন প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। ১৯৩২ খ্রী. হিটলারের অভ্যুত্থানের পূর্বাহ্নে তিনি সোভিয়েট দেশে যান এবং লেনিনগ্রাদের ইনস্টিটিউট অফ এথনোগ্রাফির ভারতীয় বিভাগের প্রধানরূপে যোগদান করেন। এই সঙ্গে ইনস্টিটিউটের এশীয় শাখার বিজ্ঞান সম্পাদক হন। লিডিয়া এডোয়ার্ডেভানারকে বিবাহ করেন। তাঁর বহু লেখা নানা দেশের পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। তাঁর মধ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি, ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, দর্শন কিছুই বাদ যায় নি। তবে Ethnographic গবেষণায় খুবই সাফল্যলাভ করেছিলেন। ১৯৩৭ খ্রী. স্ট্যালিনের আদেশে গ্রেপ্তার হয়ে অজ্ঞাত স্থানে প্রেরিত হন। মৃত্যুর স্থান ও কারণ অজ্ঞাত। সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির ২০ তম কংগ্রেসের পুনর্বিচারে কমিউনিস্টরূপে তিনি পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হন।
পূর্ববর্তী:
« বীরেন্দ্ৰনাথ গঙ্গোপাধ্যায়
« বীরেন্দ্ৰনাথ গঙ্গোপাধ্যায়
পরবর্তী:
বীরেন্দ্ৰনাথ দত্তগুপ্ত »
বীরেন্দ্ৰনাথ দত্তগুপ্ত »
Leave a Reply