বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় বা বিষ্টু ঠাকুর (এপ্রিল ১৯১০ – ১১-৪-১৯৭১) খানকা—খুলনা। রাধাচরণ। বিখ্যাত জমিদার পরিবারে জন্ম হলেও জমিদার-বিরোধী কৃষক-দরদীরূপে খুলনা তথা বাঙলার কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক নেতা। নিজ গ্রামের নিকট নৈহাটি স্কুলে পড়ার সময় সাধুসঙ্গের ইচ্ছায় নিরুদেশ হয়ে যান এবং সন্ন্যাস-জীবনে মুক্তির আশা না দেখে ফিরে আসেন। ভাইবোনদের অনেকেই তখন যশোর খুলনা সমিতির আবরণে গুপ্ত বিপ্লবী কর্মেরত। তাঁর ভাইবোনদের মধ্যে বলাই, নারায়ণ ও ভানুদেবী ব্রিটিশ কারাগারে নিপীড়িত হয়েছেন। খালিশপুর স্বরাজ আশ্রমে কাজ করার সময়ে ১৯২৯ খ্রী. রাজনৈতিক ডাকাতির অভিযোগে প্ৰথম গ্রেপ্তার হন। পরে প্রমাণাভাবে ছাড়া পান। আইন অমান্য আন্দোলনের কমিরূপে ২-৫-১৯৩০ খ্রী. বঙ্গীয় সংশোধিত ফৌজদারী আইনে আটক-বন্দী হন। বন্দী-জীবনের প্রথমে খেলাধুলায় ও এসরাজ শিখে কাটালেও, ক্রমে প্রমথ ভৌমিক ও আবদুর রাজাক খাঁর প্রভাবে মার্ক্সীয় দর্শনে বিশ্বাসী হন। ১৯৩৮ খ্ৰী. স্বগৃহে অন্তরীণাবস্থায় মুক্তি পান। অল্প দিনেই কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ অর্জন করে দক্ষিণ খুলনায় কৃষক সংগঠনের কাজ শুরু করেন। শোভনার শাখাবাহী নদীর বাধ ও ‘নবেকী’র বাধ তাঁর সংগঠনমূলক কৃষক আন্দোলনের চিরস্মরণীয় কাজ। প্ৰতিক্রিয়াশীল জমিদার ও সরকারী আমলাদের যোগাযোগে চাষের জমি নোনাজলে ভাসিয়ে চাষী উৎখাতের যে বর্বর প্রথা সুদীর্ঘকাল বাঙলাদেশে চালু আছে তা তিনি কৃষকদের একতাঁর বলেই নিজ অঞ্চলে প্রতিরোধ করেন। দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল ও বন্দুকধারী পুলিসকে স্তব্ধ করে কয়েক হাজার কৃষকের সাহায্যে এই বাঁধ দুটি বাঁধেন। ১৯৪০ খ্রী. জমি উদ্ধার করে ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করেন। এই বাঁধ দুটির আওতায় যথাক্রমে ১৬ হাজার ও ৭ হাজার বিঘা জমি উদ্ধার ও বিলি হয়। ১৯৩৯ খ্রী. ও ১৯৪৪ খ্ৰী. দুটি জেলা কৃষক সম্মেলনে তিনি সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় দেন। তাঁরই উদ্যোগে তাঁর এলাকা মৌভাগে ১৯৪৬ খ্ৰী. প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন সংগঠিত হয়। দেশবিভাগের পর বহু দিন পাকিস্তানের কারাগারে আবদ্ধ থাকেন। জীবনের ২৪ বছর জেলে থাকার ফলে স্বাস্থ্যভঙ্গ হয় এবং গুরুতর পীড়ায় আক্রান্ত হলে মুক্তি পান। খুলনার চাষীদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল বিষ্ট ঠাকুর বাঁধের উপর হাঁটলে সে বাঁধ ভাঙ্গার ক্ষমতা কারুর নেই। একজন অভিজ্ঞ চাষীর মতই কোন জমিতে কি ধরনের সার দিতে হয় তা জানতেন। কুমড়া, মানকচু, কলা ও অন্যান্য কৃষিপণ্য উন্নত আকারে উৎপন্ন করার সফল গবেষণা করেন। আম, জাম, কুলগাছ প্রভৃতি গাছের কলম বাঁধার বহু পদ্ধতি জানতেন। পশুপালন-পদ্ধতি এবং পশুচিকিৎসাও জানতেন। মাছের চাষ ও মাছ ধরার নানা কলাকৌশল তাঁর আয়ত্ত ছিল। শত শত বুনো গুল্মাদির নাম জানতেন। এসরাজ বাজানো ছাড়াও ছবি আঁকায় হাত ছিল। ‘মেহনতী মানুষ’ তাঁর প্রবন্ধ-সংগ্ৰহ। কৃষক-জীবনের পটভূমিকায় রচিত তাঁর কয়েকটি গল্প আছে। নিজ এলাকায় কৃষকদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলটি আজ উচ্চ ইংরেজী স্কুলে পরিণত হয়েছে। তাঁর চেষ্টায় বয়স্কদের শিক্ষার জন্য একটি নৈশ স্কুল গড়ে ওঠে এবং বিশ্বভারতীর লোকশিক্ষা সংসদের পরীক্ষা কেন্দ্ৰ স্থাপিত হয়। বাঙলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের সময় লীগ দালালদের হাতে এই আজীবন সংগ্ৰামী নৃশংসভাবে নিহত হন।
পূর্ববর্তী:
« বিশ্বেশ্বর শিবাচাৰ্য
« বিশ্বেশ্বর শিবাচাৰ্য
পরবর্তী:
বিষ্ণু দে »
বিষ্ণু দে »
Leave a Reply