বিবেকানন্দ, স্বামী (১২-১-১৮৬৩ – ৪-৭-১৯০২) সিমুলিয়া-কলিকাতা। বিশ্বনাথ দত্ত। শৈশবের নাম বীরেশ্বর বা বিলে। অ্যাটর্নি পিতার মেধাবী সন্তান। মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ও প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যয়ন করেন এবং ১৮৮৪ খ্রী. জেনারেল অ্যাসেমব্লীজ ইনস্টিটিউশন থেকে বি.এ. পাশ করেন। আইন পড়বার সময় পিতার মৃত্যুতে সাংসারিক অনটন দেখা দিলে পড়া বন্ধ করতে বাধ্য হন। ইতিমধ্যেই দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে বিবিধ গ্রন্থের মাধ্যমে সত্যানুসন্ধান চলছিল। সাংসারিক প্রয়োজনে মেট্রোপলিটান স্কুলে শিক্ষকতা করেন। কলেজে পড়বার সময় রাজা রামমোহন রায়ের বেদান্তদর্শন বিষয়ে গ্রন্থ পড়ে ব্ৰাহ্মসমাজের সভ্য হন। এফ.এ. পড়বার সময় রামকৃষ্ণদেবের সাক্ষাৎ পেয়ে গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। ক্রমে রামকৃষ্ণের কাছ থেকে মানব-সেবার দীক্ষা নেন। ১৬ আগস্ট ১৮৮৬ খ্রী. রামকৃষ্ণদেবের মৃত্যুর পর গুরুভ্রাতাদের নিয়ে বরাহনগরে মঠ স্থাপন করে সন্ন্যাস-নাম গ্ৰহণ করেন ‘বিবেকানন্দ’। পরের তিন বছর পরিব্রাজক-রূপে সারা ভারতবর্ষ ভ্ৰমণ করেন। এই সময় জয়পুরের সভাপণ্ডিতদের কাছ থেকে অষ্টাধ্যায়ী পাণিনি, ক্ষেত্রীর সভাপণ্ডিত নারায়ণ দাসের কাছে পতঞ্জলির মহাভাষ্য এবং পোরবন্দরের পাণ্ডুরংয়ের কাছে বেদান্ত শেখেন। মাদ্রাজে থাকা কালে শিষ্যদের অনুরোধে এবং সারদা দেবীর অনুমতি নিয়ে তিনি শিকাগো ধর্ম মহাসভায় যোগদানের জন্য ৩১ মে ১৮৯৩ খ্রী. আমেরিকা যাত্রা করেন। সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ঐ মহাসভায় হিন্দুধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে অসামান্য প্রসিদ্ধি অর্জন করেন এবং ধর্মপ্রচারক মহলে আলোড়ন তোলেন। এরপর বোস্টন, ডিট্রয়েট, নিউইয়র্ক, বাল্টিমোর, ওয়াশিংটন, ব্রুকলীন প্রভৃতি নগরে বক্তৃতা দেন। তাঁর বেদান্ত-সম্বন্ধীয় বক্তৃতায় ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বহু নরনারী তাঁর বক্তব্যে ও ধর্মমতে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে মিস মার্গারেট নোবল (নিবেদিতা) অন্যতম। ১৮৯৭ খ্ৰী. ভারতে ফিরে এলে স্বামীজীকে বীরোচিত সংবর্ধনা জানানো হয়। সংবর্ধনা-সভায় যুবকদের প্রতি তাঁর উদাত্ত আহ্বান ছিল: ‘ওঠে, জাগো–লক্ষ্যে পৌঁছবার আগে থেমো না।’ ১ মে ১৮৯৭ খ্রী. ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ এবং ১৮৯৯ খ্রী. রামকৃষ্ণ মিশনের কেন্দ্র হিসাবে ‘বেলুড় মঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মিশনের মূল আদর্শ ছিল—মানব-সেবা। বেদান্ত ও রামকৃষ্ণের শিক্ষা প্রচারের জন্য বাংলায় ‘উদ্বোধন’ ও ইংরেজীতে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ নামে দুটি মাসিক পত্রিকা প্ৰকাশ করেন। জুন ১৮৯৯ খ্রী. আমেরিকায় বেদান্ত-শিক্ষার কেন্দ্ৰ স্থাপনের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয়বার সেখানে যান। ফেরবার পথে প্যারিসে ‘ধর্ম ইতিহাস সম্মেলনে’ যোগ দেন। ভারতে ফিরে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, বেনারসে ব্ৰহ্মচর্যাশ্রম ও রামকৃষ্ণ হোম, রামকৃষ্ণ পাঠশালা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। রাজনীতিক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে অবতীর্ণ না হলেও তাঁর বক্তৃতা ও রচনা দেশের যুবকদের প্রাণে অভূতপূর্ব প্রেরণা জুগিয়েছিল। তিনি আধুনিক ভারতের অন্যতম স্ৰষ্টা ব’লে পূজিত হন। তিনি সংস্কার ও আচারের বহিরাবরণ সরিয়ে ভারতাত্মাকে জাগ্রত করেছেন, দেশকে নূতন জাতীয়তা ও মানবতাবোধে উদ্ধৃদ্ধ করেছেন এবং বিশ্বের কাছে ভারতের ভাবমূর্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলা সাহিত্যে সফল কথ্যভাষার তিনি অন্যতম প্ৰধান প্রচারক। তিনি ইংরেজী ও বাংলায় বহু গ্ৰন্থ প্ৰণয়ন করেন। রচিত উল্লেখযোগ্য গ্ৰন্থ : ‘পরিব্রাজক’, ‘ভাববার কথা’, ‘বর্তমান ভারত’, ‘প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘Karmayoga’, ‘Rajayoga’, ‘Jnanayoga’, ‘Bhaktiyoga’ প্রভৃতি।
পূর্ববর্তী:
« বিবেকরঞ্জন সেন
« বিবেকরঞ্জন সেন
পরবর্তী:
বিভূতিচন্দ্ৰ »
বিভূতিচন্দ্ৰ »
Leave a Reply