বিপিনচন্দ্ৰ পাল (৭-১১-১৮৫৮ – ২০-৫-১৯৩২) পৈল-শ্ৰীহট্ট। রামচন্দ্ৰ। প্ৰসিদ্ধ দেশনেতা ও বিশিষ্ট বক্তা। প্ৰথমে শ্ৰীহট্ট শহরে একজন মৌলবীর কাছে ও পরে উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে পড়েন। ১৮৭৪ খ্রী প্ৰবেশিকা পরীক্ষায় ৩য় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েও একটি স্কলারশিপ লাভ করেছিলেন। প্রেসিডেন্সী কলেজে দুবছর এবং কলিকাতার চার্চ মিশনারী সোসাইটিতে এক বছর পড়ে গণিতের জন্য আই.এ. পাশ করতে না পারলেও পরিচিত মহলে সাহিত্যে ও ইংরেজী ভাষায় তাঁর জ্ঞানের খ্যাতি ছিল। কলিকাতায় ছাত্রাবস্থায় ব্ৰাহ্মসমাজে যাতায়াত করতেন এবং ১৮৭৭ খ্রী. শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রেরণায় ব্ৰাহ্মধর্ম গ্ৰহণ করে ত্যাজ্যপুত্র হন। ১৮৭৯ খ্রী. কটকের একটি স্কুলে প্ৰধান শিক্ষকের কাজ গ্রহণ করেন। কিছুকাল পরে এখানে মতদ্বৈধ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন। পরে শ্ৰীহট্ট, কলিকাতা, বাঙ্গালোর প্রভৃতি স্থানে শিক্ষকতা করেন। ডিসেম্বর ১৮৮১ খ্রী বোম্বাইয়ে এক ব্ৰাহ্মণ বাল-বিধবাকে ব্ৰাহ্মমতে বিবাহ করেন। এই স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় বার দীর পরিগ্রহ করেছিলেন। বাঙ্গালোর থেকে কলিকাতা ফেরার সময় দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৮৮৭ খ্রী মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত জাতীয় মহাসমিতির তৃতীয় অধিবেশনে প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত থেকে অস্ত্ৰ আইন প্রত্যাহারের দাবি সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। ১৮৯৮ খ্ৰী. বৃত্তি পেয়ে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পড়ার জন্য বিলাত গিয়ে এক বছর অক্সফোর্ডে কাটান। ভারতে ফিরে ১২-৮-১৯০১ খ্রী. ‘নিউ ইন্ডিয়া’ নামে সাপ্তাহিক ইংরেজী পত্রিকা প্ৰকাশ করেন। ১৯০৫ খ্রী. বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে স্বদেশী আন্দোলনে সুরেন্দ্রনাথের অনুগামী হয়ে বিভিন্ন সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। ৬-৮-১৯০৬ খ্রী. ইংরেজী দৈনিক ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকাটি প্রকাশ হলে প্রথম সম্পাদক হন বিপিনচন্দ্ৰ পাল। এরপর সম্পাদক হন শ্ৰীঅরবিন্দ। সুবোধচন্দ্ৰ মল্লিক, হরিদাস হালদার, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন দাশ, হেমেন্দ্ৰপ্ৰসাদ ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিরা পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কাগজের শিরোনামায় লেখা হলো ‘India for Indians’। অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় কাগজ ছেড়ে দিলেও রাজদ্রোহিতার মামলায় অরবিন্দ গ্রেপ্তার হলে তিনি পুনর্বার সম্পাদক হন এবং অরবিন্দের মামলায় সাক্ষ্যদান করতে অস্বীকার করে কারাদণ্ড ভোগ করেন। স্বদেশী ও স্বরাজের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে ১৯০৭ খ্রী. মাদ্রাজে তাঁর প্রদত্ত বক্তৃতাবলীর প্রভাব সারা দক্ষিণ ভারতে অনুভূত হয়েছিল। ১৯০৮ খ্রী. তিনি দ্বিতীয়বার বিলাত যান। সে সময়ে তিনি সেখানে ‘Swaraj’ এবং ‘Indian Student’ নামে দুটি পত্রিকা বার করেন। ‘Swaraj’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘The Aetiology of the Bomb in Bengal’ শীর্ষক প্রবন্ধের জন্য তিন বছর পর বোম্বাইতে পৌঁছান মাত্র তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯১২ খ্রী. থেকে ১৯১৫ খ্রী. পর্যন্ত লেখাই ছিল তাঁর মুখ্য কাজ। ১৯১৬ খ্ৰী. থেকে আর একবার তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ঐ বছর বালগঙ্গাধর তিলক হোমরুল গঠন করলে তিনি তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। ১৯১৮ খ্রী. ভারতের শাসন-সংস্কার সম্পর্কে মন্টেগু চেমসফোর্ড রিপোর্ট প্ৰকাশিত হয়। পরের বছর ১৯১৯ খ্রী. একটি কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে তিনি তৃতীয়বার বিলাত যান। রাজনৈতিক জীবনে তিনি লালা লাজপৎ রায় ও লোকমান্য তিলকের অনুগামী এবং চরমপন্থী ‘লাল-বাল-পালে’র অন্যতম। ১৯২১ খ্রী. গান্ধীজীর প্রবর্তিত অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধিতা করে নিন্দিত হন এবং সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। স্ত্রী-পুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাসী এবং স্ত্রীশিক্ষা ও জাতীয় শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন। প্ৰথম মহাযুদ্ধের সময় চরমপন্থী সংগ্রামের পথ পরিত্যাগ করে অ্যানি বেশান্তের ‘হোমরুল-আন্দোলন’-এ সহযোগিতা করেন। চিদম্বরণ পিল্লাই তাকে ‘স্বাধীনতার সিংহ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। উপরোক্ত পত্রিকাগুলি ছাড়া ‘পরিদর্শক’, ‘দি হিন্দু রিভিউ’, ‘দি ডেমোক্রেট’, ‘দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ প্রভৃতির সম্পাদক ছিলেন। রচিত গ্রন্থ: ‘শোভনা’, ‘ভারত সীমান্তে রুশ’, ‘মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জীবনী’, ‘জেলের খাতা’, ‘নবযুগের বাংলা’, ‘সত্তর বৎসর’ (আত্মস্মৃতি), ‘চরিত্র চিত্র’, ‘সাহিত্য ও সাধনা’, ‘রাষ্ট্রনীতি’, ‘মার্কিনে-চারিমাস’, ‘Indian Nationalism’, ‘Nationality and Empire’, ‘Swaraj and the Present Situation’, ‘The Basis of Social Reform’, ‘The Soul of India’, The New Spirit’,’Studies of Hinduism’,’Memoirs of My life and Time’ প্রভৃতি। ‘ব্রাহ্মত্ব’ কোনোদিন তিনি ত্যাগ করেন নি। কিন্তু ক্ৰমে ক্রমে ধর্মমত পরিবর্তিত হয়ে ১৮৯৫ খ্ৰী. বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে দীক্ষা গ্ৰহণ করে বৈষ্ণব সাধনায় অনুরাগী হন। শেষজীবনে আর্থিক অনটনে কষ্ট পেয়েছেন।
পূর্ববর্তী:
« বিপিনচন্দ্ৰ দাস
« বিপিনচন্দ্ৰ দাস
পরবর্তী:
বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায় »
বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায় »
Leave a Reply