প্ৰভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ১ (৩-২-১৮৭৩ – ৫-৪-১৯৩২)। আদি নিবাস গুরুপ-হুগলী। জয়গোপাল। ১৮৮৮ খ্রী. জামালপুর হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং ১৮৯৫ খ্রী. পাটনা কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করে ১৯০১ খ্রী. বিলাত যান। ১৯০৩ খ্রী. ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন। ৮ বছর গয়ায় আইন ব্যবসায় করেন। ১৯১৬ খ্ৰী. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজের অধ্যাপক হন। ছাত্রাবস্থায় ‘ভারতী’ পত্রিকার মাধ্যমে কবিতা রচনা দিয়ে সাহিত্যজীবন শুরু। পরে গদ্যরচনায় হাত দেন। শ্ৰীমতী রাধামণি দেবী ছদ্মনামে লিখে কুন্তলীনের প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। ‘মানসী ও মর্মবাণী’ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। ‘প্ৰদীপ’, ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতী’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। রচিত ১৪ টি উপন্যাস ও শতাধিক গল্পের মধ্যে ‘রত্নদীপ’ শ্রেষ্ঠ উপন্যাসরূপে স্বীকৃত এবং এটির নাট্য ও চিত্ররূপও জনপ্রিয় হয়। শ্ৰীজানোয়ারচন্দ্ৰ শৰ্মা ছদ্মনামে রচিত। ‘সূক্ষ্মলোম পরিণয়’ পঞ্চাঙ্ক নাটকটি ‘মর্মবাণী’তে প্রকাশিত। ইংল্যান্ড সম্বন্ধেও নানা প্ৰবন্ধ লিখেছেন। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গ্ৰন্থ : ‘অভিশাপ’ (ব্যঙ্গকাব্য), ‘গল্পবীথি’, ‘হতাশ প্রেমিক ও অন্যান্য গল্প’, ‘সিন্দুর কৌটা’,দেশী ও বিলাতী’, ‘সতীর পতি’, ‘রমাসুন্দরী’ প্রভৃতি। সরল, অনাবিল হাস্যরসের গল্পলেখকরূপেই তিনি সমধিক প্ৰসিদ্ধ।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ২ (২৫-৭-১৮৯২ – ৮-১১-১৯৮৫) নদীয়ার রাণাঘাটে জন্ম। নগেন্দ্রনাথ। প্ৰখ্যাত রবীন্দ্র জীবনীকার। উকিল পিতারকর্মক্ষেত্ৰ বিহারের গিরিডিতে প্ৰাথমিক শিক্ষা শুরু। ১৯০৭ খ্রী. বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে তিনি বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হন। ১৯০৮ খ্ৰী. জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রবর্তিত প্ৰবেশিকা পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করে দশ টাকা বৃত্তি পান। পিতারমৃত্যু ও নিজের রুগ্নতার জন্য কলেজে পড়া তাঁর হল না। ১৯০৯ খ্রী. শান্তিনিকেতনের ব্ৰহ্মচর্যাশ্রমে যোগ দেন। সেই থেকেই তাঁর শান্তিনিকেতনে বাস। দুবছর (১৯১৬–১৮) কলিকাতার সিটি কলেজের গ্রন্থাগারিক হয়েছিলেন। ১৯১৮ খ্ৰী. পাঠভবনের শিক্ষকতার ও গ্রন্থাগারিকের কাৰ্যভার নিয়ে শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন। ১৯২৬ খ্ৰী. থেকে কলেজ শাখায় অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ইতিহাসেই তাঁর উৎসাহ ছিল বেশি। তবে সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়েও ক্লাশ নিতেন। গ্রন্থাগারিকরূপে তিনি ছিলেন বিশ্বজ্ঞানের ভাণ্ডারী। সারাজীবন জ্ঞানের সাধনায় কাটিয়েছেন। জাতীয় জাগরণের দিনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লিখেছেন ‘প্ৰাচীন ইতিহাসের গল্প’ (১৯১২), ‘ভারত পরিচয়’ (১৯২১), ‘ভারতে জাতীয় আন্দোলন’ (১৯২৫), ‘বঙ্গ পরিচয়’ দুই খণ্ড (১৯৩৬ ও ১৯৪২)। তাঁর রচিত বালকপাঠ্য বইয়ের মধ্যে ‘জ্ঞানভারতী’ নামে সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ উল্লেখযোগ্য। ১৯২১ খ্ৰী. সিলভা লেভি শান্তিনিকেতনে এলে তাঁর কাছে চীনা ও তিব্বতী ভাষা শিখে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বৌদ্ধ ও হিন্দু দর্শনের সমগ্ৰ চীনা ভাষ্য। ১৯২৫ খ্ৰী. ইতালীয় পণ্ডিত তুচ্চির কাছে কংফুৎসুর গ্রন্থ পাঠ করে তা অনুবাদ করেন। ১৯২৮ খ্ৰী. কাশী বিদ্যাপীঠে বৃহত্তর ভারত সম্পর্কে যে বক্তৃতা দেন তা পরে ‘Indian Literature in China and Far East’ নামে গ্রন্থাকারে প্ৰকাশিত হয়। বিশ্বভারতীর ঐক্যের তত্ত্বে বিশ্বাসী। তিনি লিখলেন ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ (১৯৬৬)। যুক্তিবাদের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণে লিখেছেন, ‘রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য’ (১৯৭২)। গ্রন্থাগার আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগার গঠনে তাঁর অবদান স্মরণীয়। ১৯৫৪ খ্রী. তিনি সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে তাঁর ‘বাংলা দশমিক বর্গীকরণ’ উল্লেখযোগ্য গ্ৰন্থ। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অনন্য সৃষ্টি চার খণ্ডে রচিত ‘রবীন্দজীবনী’। ১৯১০ খ্ৰী. থেকে তিনি এই গ্ৰন্থ রচনায় নিবিষ্ট ছিলেন। জীবনীটি লিখতে সময় লেগেছে পঁচিশ বছর (১৯২৯–৫৪)। ১৯৩৩ খ্রী. প্ৰকাশিত ১ম খণ্ডটিই মাত্র রবীন্দ্রনাথ দেখে যেতে পেরেছেন। রবীন্দ্ৰনাথ সম্পর্কে তাঁর অপর গ্রন্থ : ‘রবীন্দ্রগ্রন্থ পঞ্জী’ (১৯৩২), ‘রবীন্দ্র জীবন কথা’, ‘রবিকথা’, ‘রবীন্দ্রনাথের চেনাশোনা মানুষ’ ‘শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী ‘রবীন্দ্রনাথের গান—কালানুক্রমিক সূচী’, ‘রবীন্দ্র গ্রন্থ’ পরিচিতি প্রভৃতি। সত্তর বছর বয়সে সোভিয়েত সায়ন্স আকাদেমির আমন্ত্রণে রাশিয়া ভ্ৰমণে যান। বই লেখেন ‘সোভিয়েত সফর’। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্ৰন্থ ‘ফিরে ফিরে চাই’ (১৯৭৮)। তাঁর বাংলা ধৰ্মসাহিত্য’ প্ৰকাশিত হয় ১৯৮১ খ্রী। অবসর গ্রহণের পর শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে ভুবনডাঙ্গায় নিজস্ব বাসভবনে কাটিয়েছেন। জীবনে বহু সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। নানা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করেছে। ১৯৬৫ খ্রী. বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ ও ১৯৮১ খ্রী ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি লাভ করেন। তাঁর স্ত্রী পণ্ডিত সীতানাথ তত্ত্বভূষণের কন্যা সুধাময়ী শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের ছাত্রী এবং বোলপুর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাত্রী। বহু বছর ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান-শিক্ষিকা ছিলেন।
Leave a Reply