প্ৰফুল্লচন্দ্ৰ ঘোষ ১ (৩-৩-১৮৮৩ – ২৭-৩-১৯৪৮) খারসুটি—যশোহর। প্রখ্যাত পালি পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদ ঈশানচন্দ্ৰ। হেয়ার স্কুল ও প্রেসিডেন্সী কলেজে শিক্ষা। ১৯০৩ খ্রী. ইংরেজীতে এম.এ. পাশ করেন এবং ১৯০৭ খ্রী. প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পান। ১৯০৫ খ্রী ‘India as Known to Ancient and Mediaeval Europe’ নিবন্ধ লিখে ‘গ্রিফিথ স্মারক পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯০৪ খ্রী. অস্থায়ীভাবে এবং ১৯০৮ খ্রী. থেকে একাদিক্ৰমে ৩১ বছর প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনার পর ১৯৩৯ খ্রী. অবসর-গ্ৰহণ করেন। এই সময়ে সরকার তাকে উচ্চ খেতাব দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি তা প্ৰত্যাখ্যান করলে তাকে এমিরিটাস প্রফেসর করা হয়। আচার্য জগদীশচন্দ্রের পরে তিনিই প্ৰথম এই সম্মান পান। তাঁর পাণ্ডিত্য, ব্যাখ্যা-নৈপুণ্য ও পঠনভঙ্গির জন্য তিনি ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে, বিশেষত শেক্সপীয়রের ভাষ্যকার হিসাবে অপরাজেয় খ্যাতি অর্জন করেন। দানশীলতার জন্যেও পরিচিত ছিলেন। পিতার নামে ঈশান-অনুবাদমালা গ্রন্থরচনার জনয তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৩০ হাজার টাকা দান করেন। পরে তাঁর লক্ষাধিক টাকা মূল্যের বিরাট গ্রন্থ-সংগ্রহও বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে যান।
প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ২ (২৪-১২-১৮৯১ – ১৮-১২-১৯৮৩) মালিকান্দা-ঢাকা। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক পূৰ্ণচন্দ্র। স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর আগে ১-৭-১৯৪৭ তারিখে তাঁর নেতৃত্বে দশজন মন্ত্রী নিয়ে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। ২রা জুলাই এই মন্ত্রিসভার সদস্যগণ শপথ গ্ৰহণ করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্ৰথম হন। ১৯২০ খ্রী. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিএস-সি। অল্পদিন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। পরে টাকশালে ডেপুটি অ্যাসেস মাস্টার নিযুক্ত হন। এই পদে তিনিই প্রথম ভারতীয়। ১৯২১ খ্রী. চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মোট আট বছর কারারুদ্ধ থাকেন। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ প্রচারের জন্য ডাঃ সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘অভয় আশ্রম’ গঠন করেন। ঢাকায় ছাত্রাবস্থায় বিপ্লবী দেশকর্মীদের সংস্পর্শে আসেন যাদের মধ্যে পুলিনবিহারী দাস অন্যতম। ১৯২৪ খ্রী. বঙ্গীয় প্ৰাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সম্পাদক, ১৯৩০ খ্রী. লবণ সত্যাগ্রহে অংশীদার ও ১৯৩৯ খ্রী. কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৪০ খ্রী. যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহে যোগ দেন। ১৯৪৭ খ্রী. স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়ে প্রশাসন-কার্যের উৎকর্ষের জন্য ব্যবস্থা গ্ৰহণ, দুনীতি দমনের চেষ্টা এবং দুনীতি রোধ অর্ডিনান্স জারী করেছিলেন। প্ৰাথমিক শিক্ষাবিস্তারের ব্যাপক পরিকল্পনা এবং দু বছরের মধ্যে বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষারূপে পশ্চিমবঙ্গে প্রবর্তিত করার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করেন। তাঁর উদ্যোগে ১৫-১০-১৯৪৭ খ্রী. রাজশেখর বসু, সুনীতি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শিক্ষাব্রতীদের নিয়ে বাংলা পরিভাষা কমিটি গঠিত হয়। সুরেশচন্দ্ৰ মজুমদারের উদ্যোগে এবং তাঁর প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়িটি রবীন্দ্রভারতি সোসাইটির হাতে অর্পণ করা হয়। কংগ্রেসের ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে মন্ত্রিপদ থেকে তাকে সরে আসতে হয়। ১৫-১-১৯৪৮ খ্রী. ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় পশ্চিমবঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদে কংগ্রেসী দলের নেতা নির্বাচিত হন এবং পরিষদে কংগ্রেসী দলের সভায় তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়। কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে ১৯৫০ খ্ৰী. নবগঠিত ‘কৃষক মজদুর প্রজা পার্টির সম্পাদক হন। এই দল পরে সমাজতন্ত্রী দলের সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘প্রজাসমাজতন্ত্রী দল’ নাম হয়। ১৯৫৭ খ্রী. মহিষাদল থেকে বিধানসভায় নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ খ্রী. সাধারণ নির্বাচনে তিনি ঝাড়গ্রাম কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে আবার বিধান সভায় আসেন এবং অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রথম অ-কংগ্রেসী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেও অল্পদিন পরেই ২০১১-১৯৬৭ তারিখে পদত্যাগ করে প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (পিডি-এফ) নামে নতুন এক ফ্রন্ট গঠন করেন। ২১-১১-১৯৬৭ তারিখে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল তাঁর নেতৃত্বে পিডিএফ মন্ত্রিসভাকে শপথ গ্ৰহণ করান। যদিও তিন মাস পরেই তাঁর মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। আজীবন গান্ধীবাদী, অকৃতদার প্রফুল্লচন্দ্রের শেষজীবন কাটত শ্রীঅরবিন্দচর্চায় এবং নিঃসঙ্গ স্মৃতিচারণায়। রচিত গ্রন্থঃ ‘From Nagpur to Lahore, West To-day’, ‘প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস’, ‘বিজ্ঞানের কথা’, ‘জীবনস্মৃতি’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘জগৎগুরু বিবেকানন্দ’, ‘ঋষি অরবিন্দ’ প্রভৃতি। জার্মান, সংস্কৃত, হিন্দী ও গুজরাতি ভাষাও ভাল জানতেন। আইনস্টাইন, ওপেনহাইমার, অটোহান প্রমুখ বহু যুগন্ধর ব্যক্তির তিনি সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন। সারা ভারত গ্রামীণ শিল্প পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
Leave a Reply