নজরুল ইসলাম, কাজী (২৫.৫.১৮৯৮ – ২৯.৮.১৯৭৬) চুরুলিয়া-বর্ধমান। কাজী ফকির আহমদ। ‘বিদ্রোহী কবি’ নজরুলের সংগ্রামের হাতিয়ার ছিল তার কবিতা ও গান। তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এক সময় বাঙালীকে উদ্দীপিত করেছিল। তার বিদ্রোহ কেবল সেদিনের বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধেই ছিল না, যেখানে যত অবিচার সেখানেই তিনি গানে কবিতায় আঘাত হেনেছেন-সাম্যের গান গেয়েছেন, নারীমুক্তির বন্দনা রচনা করেছেন, ধর্মান্ধতাকে কশাঘাত করেছেন। এই কবিই ‘ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান’ শুনিয়েছেন। ‘অগ্নিবীণা’, ‘দোলন চাঁপা’ প্রভৃতি বই-এ এবং গজল গানগুলিতে তার রচনার বিভিন্ন দিক-পাশাপাশি রুদ্র, বীর, করুণ ও মধুর রসের অভিব্যক্তি ঘটেছে। শুধু ভাবের অভিব্যক্তি নয়, ভাষার ওজস্বিতার জন্যও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। আর ছিল তার প্রাণমাতান উচ্ছল দরাজ কষ্ঠের গান। যে আসরে তিনি উপস্থিত থাকতেন, গানে কবিতায় হাসি গল্পে সে আসর জমজমাট হয়ে উঠতো।
শৈশবে পিতৃহীন হয়ে প্রথম থেকেই তাকে কঠোর জীবনসংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। ১০ বছর বয়সে মক্তবে নিম্ন-প্ৰাথমিক পরীক্ষা পাশ করে ঐ মক্তবেই এক বছর পড়ান। বাল্যকালে সাধু সন্ন্যাসী বাউল দরবেশ প্রভৃতির সঙ্গলাভ করতে ভালবাসতেন। মাত্ৰ ১১ বছর বয়সে ‘লেটো’ নাচের উপযুক্ত কাহিনী ও গান রচনা করে অর্থ উপার্জন করেছেন। স্বরচিত গানে সুর-সংযোজনাও করতে হত। এক সময় গ্রাম ছেড়ে আসানসোলের এক রুটির দোকানে ৫ টাকা বেতনে কাজ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর কৃতী ছাত্র নজরুল দেশপ্রেমের আহ্বানে সৈনিকবৃত্তি নিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে ১৯১৭–১৯ খ্রী. সেনাবাহিনীতে ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হাবিলদার নজরুল বাঙলাদেশের পত্রিকার জন্য বহু গল্প, কবিতা, গান প্রভৃতি লিখে পাঠাতেন। ১৯১৯ খ্ৰী. ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় তার ‘মুক্তি’ কবিতা প্ৰথম ছাপা হয়। এই পত্রিকায়ই ‘ব্যথার দান’ ও ‘হেনা’ গল্প-দুটি ১৯১৯ খ্রী ছাপা হয়। এই প্রেমের গল্প-দুটিতে লেখকের দেশপ্রেম ও আন্তর্জাতিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। মার্চ ১৯২০ খ্রী. ৪৯নং বেঙ্গলী রেজিমেন্ট থেকে কলিকাতায় চলে আসেন ও পত্র-পত্রিকায় লেখা দিতে থাকেন। ‘মোসলেম ভারত’-এর প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা হওয়ার পেছনে তার অবদান ছিল।
১২-৭-১৯২০ খ্রী. তার ও মুজফফর আহমদের সম্পাদনায় দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদকীয় স্তম্ভে তিনি অনেক উদ্দীপনাময় আবেগপূর্ণ প্ৰবন্ধ লেখেন। তার অনেকগুলি ‘যুগবাণী’ নাম দিয়ে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। উক্ত পত্রিকায় তাঁর লেখা ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’ প্ৰবন্ধটির জন্য সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। পরে দু’হাজার টাকা জমা দিয়ে ‘নবযুগ’ আবার বার হয়েছিল। ১২-৮-১৯২২ খ্রী. রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী মাথায় বহন করে তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’ আত্মপ্ৰকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে সাড়া জাগায়। ১৩-১০-১৯২২ তারিখের ‘ধূমকেতু’-তে তিনি লিখলেন, ‘সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।–ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না।–প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা (বিদেশীরা) শুনবেন না।–আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে’। দ্ব্যর্থহীন পরিষ্কার ভাষায় কাগজে ঘোষণা করে পূর্ণ-স্বাধীনতার দাবিকে বাঙলা দেশে তিনিই তুলে ধরেছিলেন। স্বাদেশিকতা প্রকাশ ও প্রচারের ফলে সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় এবং রাজদ্রোহের অভিযোগে ২৩-১১-১৯২২ খ্রী তিনি গ্রেপ্তার হয়ে ১৬-১-১৯২৩ খ্রী এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
হুগলী জেলে তাকে সাধারণ কয়েদীর পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়া হলে তিনি তার রাজনৈতিক সহবন্দীদের সঙ্গে নিয়ে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। দীর্ঘদিন অনশন চলছে দেখে রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে টেলিগ্রাম করেন, ‘অনশন ত্যাগ কর। আমাদের সাহিত্য তমাকে দাবি করে (Give up hunger-strike, our literature claims you)’। ৩৯ দিন পরে অনশন প্ৰত্যাহৃত হয়। বিশেষ শ্রেণীর কয়েদী হয়ে তিনি বহরমপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে বদলী হন। নজরুল আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। জেলে বসেই ‘শিকল পরা ছিল’ ও অন্যান্য কয়েকটি গান রচনা করেন। ডিসে ১৯২৩ খ্রী জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯২৪ খ্রী. কুমিল্লার গিরিবালা দেবীর কন্যা প্ৰমীলা সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন। এই সময় তিনি হুগলীতে থাকতেন। বহু বিখ্যাত গান ও কবিতার রচনাস্থল হুগলী। ‘লাঙল’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (২৫.১২.১৯২৫) তার ‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার প্রধান পরিচালক হিসাবে তার নাম লেখা হত। পত্রিকাটির সম্পাদক হিসাবে নাম থাকত তাঁর বাঙ্গালী পল্টনের বন্ধু মণিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ১৯২৬ খ্রী. কৃষ্ণনগরে এসে বাসা করেন। বঙ্গীয় প্ৰাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য হিসাবে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত প্ৰাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী গঠন ও তাদের কুচকাওয়াজ শেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রাদেশিক সম্মেলনের জন্য ‘কাণ্ডারী হুঁসিয়ার’ গানও ঐ সময়ে রচিত হয়। ছাত্র সম্মেলনের জন্য রচনা করেন ‘আমরা শক্তি, আমরা বল, আমরা ছাত্রদল–’।
কৃষ্ণনগরে তার বাড়ির সাহিত্য বৈঠকে অনেকে আসতেন। হেমন্তকুমার সরকারের সহযোগে তিনি একটি শ্রমজীবী নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ১৯২৮ খ্রী. কৃষ্ণনগর ছেড়ে কলিকাতায় এসে গ্রামোফোন কোম্পানীতে কাজ পান। এই সময়ের মধ্যে গায়ক, গান-রচয়িতা ও সুরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ থাকার কারণে এতদিন যে ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানী তাঁকে দূরে রেখেছিল, এখন তারাই তাঁকে আহ্বান জানায়। প্ৰথমে গানের ট্রেনার ও পরে কম্পোজারও হয়েছিলেন। তার রচিত গানের সংখ্যা তিন হাজারের মত। সবাক ছবির সূচনা থেকে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গীত রচনা ছাড়া তিনি ‘বিদ্যাপতি’, ‘সাপুড়ে’, ‘ধ্রুব প্রভৃতি ছবির কাহিনীকারও ছিলেন। সুরের রাজ্যে বিচরণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আধ্যাত্মিকতার স্রোতেও ভেসে চললেন। লালগোলা হাইস্কুলের প্ৰধানশিক্ষক বরদাচরণ মজুমদারের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন।
১৯৩৯ খ্রী. তার স্ত্রী প্ৰমীলা দেবী পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যান। ঐ বছরই তিনি তার অন্যান্য পুস্তকসহ গ্রামোফোন কোম্পানীর রেকর্ডে গাওয়া তার সমস্ত গানের রয়ালটি কলিকাতা হাইকোর্টের এটর্নি অসীমকৃষ্ণ দত্তের কাছে চার হাজার টাকার জন্য বন্ধক রাখেন। ১৯৪২ খ্রী. তিনি নিজেই পক্ষাঘাতে বোধশক্তিহীন নীরব নির্বক হয়ে যান। নজরুল সাহায্য কমিটির চেষ্টায় বঙ্গীয় সরকার তাকে মাসিক দুশ টাকা সাহিত্যিক বৃত্তি মঞ্জর করেছিল। ১৯৫৩ খ্ৰী. চিকিৎসার জন্য সস্ত্রীক তাকে ইউরোপে পাঠান হয়। ১৯৭২ খ্রী. বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান তাকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার ও অন্যান্য সুযোগ দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয় এবং ১৯৭৫ খ্রীঃ শহীদ দিবসে তাকে ‘একুশে পদক’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়। ঢাকায় মৃত্যু। রাষ্ট্ৰীয় সম্মানে তার দেহ কবরস্থ করা হয়।
Leave a Reply