রেডিও তেহরান : কবি আসাদ চৌধুরী, ইরানে আসার জন্য আপনাকে প্রথমে স্বাগত জানাচ্ছি, এরপর স্বাগত জানাচ্ছি আমাদের স্টুডিওতে। তো ইরান সফরে আসার ব্যাপারে কিছু বলুন; কোথায় কোথায় গেলেন ; কেমন লাগলো আপনার।
কবি আসাদ চৌধুরী : প্রথমে রেডিও তেহরানকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাকে স্টুডিওতে এসে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য। এরপর সফর সম্পর্কে বলবো, ইরানে আমি এই প্রথম এসেছি। আমার একেবারে ছোট বেলায় বাংলাদেশে দেখতাম কিছু মেয়েরা চাকু-টাকু বিক্রি করতো; অনেকটা জিপসী স্টাইলের মেয়েরা; তখন শুনতাম এরাই হচ্ছে ইরানী। এই হচ্ছে আমার ইরান সম্পর্কে ছোট বেলার অভিজ্ঞতা। কিন্তু যে অভিজ্ঞতাটা আমার অন্য জায়গায় সেটি হচ্ছে অবশ্যই ‘শাহনামা’ ফেরদৌসী। বাঙালী মুসলমানদের নিজস্ব কোনো মাহাকাব্য বা এপিক ছিল না। রামায়ণ খুবই ভালো সাহিত্য সন্দেহ নেই; মহাভারত খুবই মহৎ সাহিত্য বাঙালী মুসলমান ‘কাহিনী’ হিসেবে এটা পড়ে আনন্দ পায়। কিন্তু আইডেনটিফাই করে না ; নিজেকে এখানে সনাক্ত করে না। কিন্তু তাহমিনার মধ্যে সোহরাবের মধ্যে রুস্তমের মধ্যে বাঙালী মুসলমান নিজেকে চিনতে পেরেছে। আমি এটা সব সময় বলি ; আমি বলতে ভালোবাসি-আমার কাছে মনে হয় ফেরদৌসী দেশ প্রেমটা একেবারে হাত ধরে শিখিয়ে দিয়েছে । আর জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসীবাদ বা নাৎসীবাদ সেটা তো পশ্চিমের কাছ থেকে অনেক রক্তের বিনিময়ে অনুগ্রহ করে পাওয়া। আর এই উচ্চকিত দেশ প্রেমটা আমি শাহনামায় দেখেছি।
আর ভালো লাগা সম্পর্কে যদি বলি- ইরান খুবই সুন্দর একটি দেশ, চমৎকার এখানকার প্রকৃতি একদিকে গরম একদিকে ঠাণ্ডা। রাস্তা ঘাটে কবিতা পড়ার সুযোগ দেখছি আমি। এখানকার মানুষ কথা বলার সময় সাদি হাফিজের কবিতা কোড করে। এখানকার ছেলেরা দেখতে সুন্দর মেয়েরাও দেখতে খুবই সুন্দর। রাস্তাঘাট সুন্দর, বাড়ী ঘর সুন্দর সব মিলিয়ে খুবই ভালো লেগেছে ইরান আমার কাছে।
রেডিও তেহরান: তো এ পর্যন্ত কোথায় কোথায় গেলেন?
কবি আসাদ চৌধুরী: কোথায় কোথায় ঘুরলাম বা বেড়ালাম সে প্রসঙ্গে বলার আগে কোথায় ঘুরিনি সে কথাটা আগে বলতে হলে বলবো একমাত্র তেহরানই দেখা হয়নি বা ঘুরতে পারিনি। বরং ইস্ফাহান কিছুটা বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছি, সিরাজে গিয়েছিলাম পার্সে পোলিস দেখেছি, সেখানে তাখতে জামশেদ দেখে আমি একেবারে মুগ্ধ হয়েছি। আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। বর্তমান সরকার এটাকে রিনোভেট করার চিন্তা করছেন এটি নিঃসন্দেহে খুব ভালো বিষয়। বিশেষ করে আমেরিকার কল্যাণে বাগদাদের মিউজিমায় ধ্বংস হওয়ার পর এদিকে তো না থাকিয়ে আর কোনো উপায় নেই।
রেডিও তেহরান : আপনার ইরান সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু বলুন ।
কবি আসাদ চৌধুরী : দেখুন! ইরানে আমার আসার ইচ্ছা অনেক দিনের এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এবারে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো ”ফার্স্ট কংগ্রেস অব ইরানিয়ান এ্যান্ড অল পোয়েটস” এর অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যে। তবে সেখানে বাংলাদেশ থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোতে আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাবলাম ইরান তো ইসলামিক রিপাবলিক হয়তো আমার দাঁড়ি দেখে দাওয়াতটা দিয়েছে। তো যাইহোক না কেন, আমি দাওয়াত পেয়ে খুবই সম্মানিত বোধ করেছি এবং আসতে পেরে খুব খুশী হয়েছি।
রেডিও তেহরান: তো সেমিনারে আপনি কি উপস্থাপন করলেন?
কবি আসাদ চৌধুরী: না এখানে সেমিনার ঠিক ঐ অর্থে হয়নি।এখানে আমরা কবিতা পড়েছি; আমাদের কবিতার ফার্সী ও ইংরেজীতে অনুবাদ হয়েছে। এর আগে আমার কবিতার ফার্সি অনুবাদ করেছিলেন ইসা শাহেদী সাহেব আর ইংরেজী অনুবাদ করেছিলেন এম এইচ রশীদ সাহেব। তো এখানে আবার নতুন করে তারা অনুবাদ করলো। এখানকার সব কিছুই ভালো লেগেছে কিন্তু খারাপ লেগেছে একটা জায়গায় সেটি হচ্ছে যদি এই আয়োজনে তৃতীয় বিশ্বের শিল্প সাহিত্যের জন্য ‘তেহরান ডিক্লেয়ারেশন’ হতো তাহলে আমার মনে হয় ভালো হতো।
রেডিও তেহরান: তেহরানে আসার পর অনেক কবি সাহিত্যিকের সাথে নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে কথা হয়েছে; তাছাড়া আপনি এমনিতেই তো ইরানের শিল্প সাহিত্য ও চলচ্চিত্র সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই মোটামুটি খোঁজ খবর রাখেন। তো সব মিলিয়ে এদেশের কবি সাহিত্যিক চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি ?
কবি আসাদ চৌধুরী : দেখুন! ইরানী চলচ্চিত্রের মেকাপ গেটাপ আমি সরাসরি বলি ফিল্মের ফটোগ্রাফির যে ফ্রেমিং সেই প্রতিটি ফ্রেমিং যেন আলাদা। ইরানী চলচ্চিত্রের এডিটিং অত্যন্ত চমৎকার তাতে কোনো সন্দেহ নেই, সাউন্ডও খুবই চমৎকার অর্থাৎ টেকনিক্যালি ইরানী ছবি তুলনাহীন। এখন কাহিনীর উপর নির্ভর করবে ছবি কতো বড় হচ্ছে কি হচ্ছে না। তবে আমি ইরানের গল্প খুব একটা বেশী পড়িনি। তবে কবিতা পড়েছি অনেক। তবে ইরানে এসে আমি প্রথমে যাকে মিস করলাম তিনি তাহেরে সাফার যাদে। আমি তার অনেক কবিতা পড়েছি। এখানে একটি তরুণ কবির কবিতা আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। তারপর এখানকার ওস্তাদ কবি যারা একটু প্রাচীন ধারায় কবিতা লেখেছেন তাদের কবিতাও বেশ ভালো লেগেছে। কিন্তু নাইনটিনথ সেঞ্চুরীর যে গদ্য কবিতার উদ্ভব যাকে এরা ব্লাঙ্ক ভার্স বলে আমি সেগুলোও শুনেছি। আমার কাছে এসব একই রকম অর্থাৎ বাংলা কবিতার মতো মনে হয়েছে। মানে পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে আছি আবার বলছি পশ্চিমের দিকে তাকাবো না। এরকম একটি লুকোচুরি চলছে কবিতায়। অবশ্য বাংলাদেশেও তাই। তবে সেখানে অবশ্য অনেকে কবিতা নকল করার চেষ্টা করছে সেটা ভিন্ন কথা।
রেডিও তেহরান: বাংলাদেশের প্রসঙ্গ যখন আনলেন তখন আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে একটু জানতে চাইবো- আপনি শিশু সাহিত্যের উপর অনেক কাজ করেছেন, গবেষণা করেছেন একাধারে শিক্ষক ছিলেন, সম্পাদনা করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, টিভি উপস্থাপনা করেছেন এবং এখনও করছেন তো সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আপনার নখ দর্পনে আছে কারণ একজন কবি যিনি; তিনি সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর দুরদর্শী এবং সচেতন একজন নাগরিক। তো সেই হিসেবে পুরো বাংলাদেশের বর্তমান সাহিত্যটাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কবি আসাদ চৌধুরী : আপনি অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন সে জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি প্রথমেই যা বলবো তা বলা উচিত না একথা স্বীকার করে বলবো- বাংলাদেশের পাট ছিল এক সময়ের সবচেয়ে অর্থকরী ফসল সেই পাটের উপর আপনি একটি ভালো কবিতা পাবেন না; অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আসার পর বা আধুনিক সাহিত্যের সূত্রপাতের পর যেখানে আধুনিক সাহিত্য মানে সমাজের দর্পন সেখানে পাটের উপর কোনো সাহিত্য বা কবিতা পাবেন না।এই যে আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা বাইরের দেশে কাজ করছে এবং তারা সেখান থেকে কত কষ্ট করে টাকা পাঠাচ্ছে বা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে; দেশের ফরেন কারেন্সির একটা বড় অংশ ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল কোনো খাত থেকে আসছে না; আসছে প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে। আপনি তাদের উপর কোনো কবিতা পাবেন না। এবং গার্মেন্টস ইন্ড্রাষ্ট্রি যেটা বাংলাদেশে একটা বিশাল ব্যাপার। বাংলাদেশের মেয়েরা দু’হাতে যে সোনা ফলিয়ে দিচ্ছে দেশকে তাদের সম্পর্কে একটি মাত্র কবিতা আবু করিম লিখেছিলেন, অবাক করার বিষয় অন্যরা কেউ লিখলেন না তাদেরকে নিয়ে কোনো কবিতা। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে আমি কেন লিখলাম না। হ্যাঁ এর জবাবে আমি আমার অক্ষমতা প্রকাশ করবই। পাটের ব্যাপারে আমার তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই, বাইরে কিছুদিন ছিলাম প্রবাসী জীবনের দুঃখ নিয়ে আমি লিখেছি। আর গার্মেন্টেসের বিষয়টি আমি ঠিকই লক্ষ্য করি দেখা যাক যদি কোনো দিন পারি তবে লিখবো। আর যেহেতু আপনি দেশের সবকিছু মিলিয়ে জানতে চাচ্ছেন সেক্ষেত্রে আমি বলবো, আমাদের দেশে যদিও একটা ভোটাভুটির ব্যাপার হয় তবে গণতন্ত্র বলতে গেলে যে মূল্যবোধগুলো থাকা দরকার; অপজিশনের ব্যাপারে শ্রদ্ধাবোধ, তাদের মতামত গুরুত্বের সংগে শোনা এই চর্চাটাই আমাদের দেশে নেই। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে বর্তমানে দেশে সরকার গঠিত হয়েছে- আর সে কারণে এই সরকারের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেছিলাম,তো এই পর্যন্তই বলি নাইবা বল্লাম আর পরের অংশ!
রেডিও তেহরান: আপনার একটা কবিতা নিশ্চয়ই আপনার মনে থাকবে ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম-সবশেষ লাইনটা ছিল এখন আছি অল্প। তো বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনি কেমন আছেন?
কবি আসাদ চৌধুরী : আমি বর্তমানে বোধহয় তারচেয়েও অল্প আছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে বলবো যাদের চুল পেকে গেছে, বয়স সত্তুরের কাছাকাছি তারপরও এখনও বেঁচে আছি এটাইতো যথেষ্ট। এভাবে যে কথা বলতে পারছি, ঘুরতে ফিরতে পারছি- কিন্তু না দেশের ব্যাপারে আমি একবার আশাবাদি হই আবার ডুবে যাই হতাশায় । মনে হয় বোধহয় একটা কিছু হলো। এই যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা হলো-এই প্রথম আমার মনে হয় কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হয়েছি। কিন্তু এই যে যুদ্ধাপরাধীদের নামে নিরীহ ছাত্রদের যেভাবে হয়রানি করা হচ্ছে; একটা ছাত্রাবাসে পবিত্র কোরআন শরীফ পাওয়া গেছে বাস তাদেরকে জঙ্গীবাদী বলে ধরে নিয়ে গেছে । আমার কাছে এ বিষয়টি খুব খারাপ লেগেছে। একটা মুসলমান ছাত্রের ঘরে কোরআন শরীফ থাকতেই পারে। আমি খুব অকপটে বলছি ; আমি জানি না এগুলোর অন্য কোনো নিয়ম কানুন আছে কিনা তবে আমার নিজের কাছে যেটা মনে হয়েছে যে ইসলাম নিজে জঙ্গীবাদ পছন্দ করেন না; আমার রাসুল- আল্লাহর রাসুল শেষ নবী তিনি কখনই জঙ্গীবাদ পছন্দ করেননি। হ্যাঁ তিনি আদর্শের জন্যে লড়াই করতে পারেন তবে পিছন থেকে ছুরি মারা মুসলমানের লক্ষ্য না; হতে পারে না। আর এগুলোকে প্রতিহত করতে হবে। কিন্তু প্রতিহত করতে হবে বিদেশী শক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী-এ বিষয়টিতে আমার আপত্তি আছে আমি এ বিষয়টির প্রতিবাদ জানাই।
এছাড়া আমার সন্দেহ হচ্ছে , যে ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখছে, ভয় অনেকটা সে রকম যে, প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করার কোনো রকম প্রবণতা কি এর মধ্যে আছে? আমিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই; কিন্তু একইসাথে বলবো সত্যিকারের যুদ্ধাপরাধীদের কঠোরতম বিচার চাই কিন্তু নিরীহ একটি মানুষ যেন কষ্ট না পায়।
রেডিও তেহরান: আপনি প্যালেস্টাইন এবং প্রতিবাদী দেশের প্রতিবাদী কবিতার সম্পাদনা করেছেন; তো বাংলাদেশে বোধহয় এই ধরণের কাজ এটাই প্রথম হয়েছে এর আগে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই-তো হঠাৎ করে এই কাজে উদ্বুদ্ধ হলেন ?
কবি আসাদ চৌধুরী: প্রথমে আমি বলে নেই হ্যাঁ প্যালেস্টাইন বিষয়ক বা প্রতিবাদী দেশের প্রতিবাদী কবিতার কাজ এটাই প্রথম, এর আগে আর এ ধরনের কাজ হয়নি। তবে কবিতা ছাপা হয়েছে, অনেকে এ বিষয়ক অনুবাদও করেছে।
এটা বলতে গেলে যাদের কাছে আমাদের চিন্তাটা ঋণি, ভাবনা ঋণি তাদের সম্পর্কে বাজে কথা বলতে হয়। আজকে প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তান এবং ইরাকের দিকে তাকালে পৃথিবীকে সভ্য কোনো জায়গা বলে মনে হয়! আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানী, ইংল্যান্ড তাদের লেখা পড়ে তাদের দার্শনিকদের ভাবনা চিন্তা পড়ে আমরা বড় হয়েছি, বলতে পারেন যে বুড়ো হয়েছি । কিন্তু বুড়ো হয়ে কি দেখছি যে এখানে নির্মমভাবে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, হাসপাতাল পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, জাদুঘর লুট হচ্ছে সেখান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে, নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করা যাচ্ছে- বিষয়টি যেন জাস্ট সিনেমা দেখছি , কোনো প্রতিক্রিয়া নেই । এদের কি বিবেক বলে কিছু আছে? তাহলে শিক্ষার অর্থ কি এই দুষ্কৃতিকারীদেরকে মেনে নেয়া । আমার খুব বিস্ময় লাগে এসব দেখে ; আমি কোনোভাবেই এটা মানতে পারছি না। আমি পৃথিবীকে এখন জীবনানন্দের ভাষায় বলবো ”পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন” জীবনানন্দ দাস গভীরতর বলেছেন আমাকে বলতে হবে গভীরতম অসুখ।
রেডিও তেহরান: আপনি যথার্থই বলেছেন, তো আপনি ইদানিং লেখালেখি কি করছেন।
কবি আসাদ চৌধুরী:ঐ ফাঁক পেলে একটু কবিতা লিখি । তবে বাচ্চাদের জন্য বেশ কিছু বই লেখার ইচ্ছা ও পরিকল্পনা আছে। বিশেষ করে কিছু জীবনী লেখার ই্চ্ছা আছে। আমি সরাসরি বলি আমি আমার ধর্মকে যেমন বাদ দিতে পারবো না তেমনি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রগতিও আমি বাদ দিতে পারবো না। আর এ দুটির মাঝে যে দেয়াল দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এ দেয়ালটাকে ভাঙা দরকার। দেয়ালটা যেভাবেই গড়ে উঠুক না কেন এটা ভাঙতেই হবে। আর আমার মনে হয় আমাদের দেশে বিজ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞানীদের জীবনী এগুলো লিখলে মানুষ কিছুটা মুক্ত বুদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।
রেডিও তেহরান: আপনার নিজের মুখে হয়তো নিজের লেখার মূল্যয়ন জানতে চাওয়া হয়তো ঠিক হবে না কিন্তু রবীন্দ্রনাথ….
কবি আসাদ চৌধুরী: না না এ ধরনের বিষয়ে আমি কথা বলবো না। আমার গুরু বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, আমার দিকের আত্মপরিচয় দেয়ার রেওয়াজ নেই। আমি এ ব্যাপারে কিছু বলবো না।
রেডিও তেহরান: রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সেটা বলে গেছেন। ফলে অন্তত একটু তৃপ্তি অতৃপ্তির কথা বলুন।
কবি আসাদ চৌধুরী: না না, এ ব্যাপারে আসলে আমি কথা বলতে চাই না, তবে এটা সত্য কথা যে আমি যে কবিতা লিখতে চাই লেখার চেষ্টা করে আসছি ওটা আজও আমার লেখা হয়নি; আমি আজও লিখতে পারলাম না।
রেডিও তেহরান: আচ্ছা ফার্সী সাহিত্য, ফার্সী ভাষা বা ফার্সী শব্দের প্রভাব একটা সময় বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক মাত্রায় আমরা লক্ষ্য করেছি। তবে বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে ফার্সী শব্দ পরিত্যাগের একটা প্রবণতা ।
কবি আসাদ চৌধুরী: ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলাদেশ আক্রমণ করার আগেই কিন্তু মসজিদ নির্মিত হয়েছিল চট্টগ্রামে ; মসজিদ হয়েছিল রংপুরে দিনাজপুরে। এখন এরা আসার পর যেটা হয়েছে যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আসার আগ পর্যন্ত ফার্সী ছিল রাষ্ট্র ভাষা। ই্স্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কতখানি চালাক যে তারা ১৮৩৪ বা ৩৫ সাল পর্যন্ত ফার্সীকে রাষ্ট্র ভাষা রেখে দিয়েছিল। এটা কিন্তু খুব অদ্ভূত ব্যাপার। তারা কিন্তু নবাবও পাল্টায়নি। তারা মির জাফরকে নবাব হিসেবে রেখেছে। মিরনকে নবাব রেখেছে মির কাশিমকে নবাব রেখেছে এর ফলে সাধারণ বাঙালী মুসলমান মনে করেছে আমাদেরই তো রাজত্ব চলছে। এবং বিত্তবান বাঙালী যারা তাদের অধিকাংশই গুজরাটে গেছে, কেউ মাদ্রাজে, কেউ দিল্লি কেউ বোম্বে বিভিন্ন জায়গায় গেছে এখন যেমন যায়। এর ফলে যেটি হয়েছে ফার্সীটা তখন সংস্কৃতির ভাষা হয়ে গিয়েছিল। তখন এমন একটা ব্যাঙ্গ ছিল মোগল পাঠান হদ্দো হলো ফার্সী পড়ে তাঁতী। মানে ফার্সীটা এতই প্রভাবিত করে যে তাঁতীও ফার্সী পড়া শুরু করেছে। কারণ এর ফলে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এই ফার্সী সাহিত্যে আমরা দেখবো বিশেষ করে হাফিজের কথা বলা যেতে পারে। দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর ছিলেন হাফিজের অন্ধ ভক্ত। আর ব্রাক্ষ্ম সমাজ হচ্ছে একেশ্বরবাদী। রাসূল (সা.) সম্পর্কে তাদের কোনো মতামত নেই মন্তব্য নেই। সব অর্থে একেশ্বরবাদী এবং কিছুটা ইমাম গাজ্জালী বা অন্যান্য দার্শনিক যারা ছিলেন তাদের চিন্তা ভাবাসৃত ছিল খানিকটা । শুধু কলোটেশিয়ানের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কিত বিষয়গুলো নেই। রাসূল (সা.) নেই, বেহেশত দোযখ এগুলো সম্পর্কে কোনো মন্তব্য নেই। এখন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমরা দেখবো হাফিজ সম্পূর্ণভাবে বাংলা বর্ণমালায় এসে গেছে। নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পার্থক্যটা হচ্ছে- নজরুল ঈমান এবং আকীদার সাথে লিখেছেন আর রবীন্দ্রনাথ একেশ্বরবাদের ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ নাই ; মূর্তির ব্যাপারে কোনো কম্প্রোমাইজ নেই; রবীন্দ্রনাথের একটি মাত্র গান আছে মূর্তি বিষয়ক । কংগ্রেসের প্রবল চাপে তিনি লিখেছেন, ”ঐ ভূবন মনো মোহিনী” এই একটি মাত্র গান। তার কোনো কবিতায় মূর্তির বিষয়গুলো কিন্তু নেই।তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের জামা কাপড়ের দিকে তাকালে দেখবেন তিনি আলখেল্লা পরছেন, টুপি পরছেন- তো এই যে নজরুল রবীন্দ্র নাথ তাদের প্রভাব তো আমাদের সাহিত্যে রয়েছে ফলে এক অর্থে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ফার্সী সাহিত্যের প্রভাব কিন্তু আমাদের সাহিত্যে আছে। কিন্তু যেটা আমার মূল প্রশ্ন সেটি হচ্ছে ফার্সী সাহিত্য মানেই কি খৈয়াম,ফার্সী সাহিত্য মানেই কি সাদি, হাফিজ, রুমি বা তাবরিজি এপর্যন্তই কি শেষ ! আধুনিক ফার্সী সাহিত্য তাহলে কি? ফেরদৌসী-হ্যাঁ ফেরদৌসি ছোট বেলায় আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের অনেককেই ফেরদৌসি প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের অনেক বাড়ীর ছেলের নাম রুস্তম অনেক বাড়ীর ছেলের নাম সোহরাব কারো কারো মেয়েদের নাম তাহমিনা। এরকম অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু আমি যেটা বলতে চাচ্ছি যে আধুনিক ইরান বাংলা সাহিত্যে এ্যাবসলুটলি নেই বলে আমার মনে হয়েছে। আধুনিক সাহিত্যের বিষয়টি ইরানীদের মধ্যে কি খুব বেশী আছে ? গত কয়েকদিন ইরানীদের সাথে মিশে, আড্ডা মেরে,কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছে ইরান মিডিল এজের সেই ক্লাসিক কবিদের যতটা আপন মনে করে কাছের মনে করে আধুনিক কবি সাহিত্যিকদের সেভাবে আপন মনে করে না। আর বাংলাদেশে তো তার চিহ্নই নেই। তাহেরে সাফার যাদের অনুবাদ হয়েছে বলেই আমি তার নাম বলতে পারলাম। এরপর যদি আর একজন ইরানী কবির নাম বলতে বলেন, সেক্ষেত্রে আমি এই সেমিনারে কবিতা পড়লেন হেকমতিয়ার নামে তরুণ এক কবি আমি তার নাম বলবো তবে তার বাইরে যদি আর কারো কথা জিজ্ঞাসা করা হয় তাহলে আমি চিন্তা করবো, ডায়েরী খুলব কাগজ দেখে তারপর হয়তো বলবো আধুনিক ফার্সী কবিতা কী রকম। পারস্য আমাদের কাছে অন্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে আর সেটি হচ্ছে ইসলামিক রেভ্যুলেশন। ইসলামিক রেভ্যুলেশন সম্পর্কে পরিস্কারভাবে আমি বলবো যে, ইমাম খোমেনী (রহ.) একজন আধ্যাত্মিক নেতা; তুলনাহীন ব্যক্তি এবং তার ব্যক্তিত্ব এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি একজন সফল নেতা এবং তার নেতৃত্বে একটি সাকসেসফুল রেভ্যুলেশন হয়েছে। ইরানের প্রশাসনের দিকে তাকালে বোঝা যায় তিনি আধুনিক কালের আধুনিক মনন সম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন। খুব অভিভূত হয়েছিলাম-মক্কা শরীফে হজ্জ করতে গিয়ে ছয় শ’র মতো ইরানী হাজীকে যখন গুলি করে মারা হলো তখন ইমাম খোমেনী (রহ.) একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন- সে কথা বলতে গিয়ে আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠছে, আমি এরকম বক্তৃতা আর কখনো পড়িনি। আমি সেই বক্তৃতা ইংরেজীতে পড়েছি, আমি তখন জার্মান রেডিওতে ছিলাম এবং সেই বক্তৃতা আমি অনুবাদ করেছি। তারপর যখন সেটা রেকড হচ্ছিল স্টুডিওতে আমার কণ্ঠে । তখন যিনি রেকডিং করছিলেন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বল্লেন আসাদ আর ইউ এ্যাংরি? আমি বল্লাম না আমি মোটেও এ্যাংরি না; মোটেও রাগ করিনি। আমি পড়তে গিয়ে যখন বলছেন যে, আল্লার মেহমানরা এভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তে নিহত হচ্ছেন আল্লাহ তুমি তাদের শাহাদাত কবুল কর। আমি কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলাম ইমাম খোমেনীর সেই বক্তৃতা পড়তে গিয়ে। লাশ গ্রহণের সময় তিনি এভাবে বলেছিলেন। আমার কাছে মনে হয়েছে এটি অসাধারণ ভাষণ।
রেডিও তেহরান: জ্বী আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তো কবি আসাদ চৌধুরীকে স্টুডিওতে পেয়ে কবিতা শোনার লোভটা সংবরণ করতে পারছি না। আমাদের শ্রোতারাও সেরকমই- তো আপনার কাছ থেকে আমরা কবিতা শোনার আগ্রহ প্রকাশ করছি।
কবি আসাদ চৌধুরী : আপনাদেরকেও ধন্যবাদ। আপনি একটু অন্যভঙ্গীতে বল্লেন। তো আমিও আপনার কথার মতো একটা সহজ উত্তর দিয়ে শুরু করি। ছোট্ট একটি কবিতা।
গোলাপ তাকায় কোন দিকে
ভালোবাসায় মন থেকে
গোলাপ ঘুমোয় কার কোলে
ড্রয়িং এবং চার কোলে
খুকুমনির মার কোলে।
এবার আমি যে কবিতাটা পড়ছি ; আমি মনে করি আমার যদি দু একটা লেখা ভালো থেকে থাকে তার মধ্যে এটি একটি। তো কবিতাটি পড়তে বেশ সময় লাগবে প্রায় তিন মিনিটের মতো। কারণ আমিও এক সময় রেডিওতে কাজ করেছি সেখানে সময়ের ব্যাপারটা আছে। তো আমি তাহলে খানিকটা পড়ে শোনাই কবিতাটি-
“সবুজ গম্বুজের নিচে”
আমার সালাম পৌঁছে দিও নবীজির রওজায়,
না এ ধ্বনি উচ্চারিত হয়নি একবারও
যারা হাত নেড়ে বিদায় জানালেন দীর্ঘ প্রবাসে;
তারাই হয়ে উঠেছিলেন আপন জন।
যাত্রা শুভ হোক ভালোয় ভালোয় দেশে ফিরুন
এ শুভ কামনার স্নিগ্ধতা করুনের বিষন্ন প্লাটফর্মকে নয় আমাকে স্পর্শ করেছিল
দু দুটো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পেরুনোর বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে
আমরা এখন জেদ্দায় সপরিবারে সৈয়দ সাহেবের বাসায়
ক্যামেরা অলঙ্কার আরো কিসব টুকি টাকি কেনা কাটা শেষ;
তারিখ তো আমার জানাই ছাড়পত্রই রয়েছে তবে বলবো না ——–
ফজরের নামাজ শেষ একসময়
আমি রহমাতুল্লিল আলামিন আপনার পাশে দাঁড়ালাম
সমুদ্র একদা আমাকে বিস্মিত করেছিল;
ভোগের এবং ত্যাগের আনন্দ আমার অজানা নয়
কিন্তু এই মুহুর্তে অনুভূতি- আমি অক্ষম পদ্যকার কেমন করে তার বর্ণনা দেব!—-
রেডিও তেহরান: তো কবি আসাদ চৌধুরী আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদের স্টুডিওতে আসার জন্য।
কবি আসাদ চৌধুরী:আমিও অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সবাইকে এবং শ্রোতাদেরকে। আর আমার কথায় যদি ভুল ক্রটি হয়ে থাকে, কোনো শ্রোতার মনে যদি সামান্য আঘাত দিয়ে থাকি নিশ্চয়ই মাফ করে দেবেন।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান, ২৩ মে ২০১০
Leave a Reply