দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহর্ষি (১৫.৫.১৮১৭ – ১৯.১.১৯০৫) জোড়াসাঁকো-কলিকাতা। প্ৰিন্স দ্বারকানাথ। শিক্ষা প্ৰথমে রামমোহন প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো-হিন্দু স্কুলে ও ১৮৩১ খ্রী. থেকে কয়েক বছর হিন্দু কলেজে পিতার বিষয়কর্মে ও ব্যবসায়ে কর্তৃত্ব পেয়ে প্রথমে বিলাসী হয়ে ওঠেন। ১৮৩৫ খ্রী. পিতামহীর মৃত্যুকালে তাঁর জীবনের গতি পরিবর্তিত হয়ে মনে ধর্মজিজ্ঞাসা প্রবল হয়ে ওঠে। ক্রমে প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্য ধর্ম এবং দার্শনিক গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করে ঈশ্বরলাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। ধর্মতত্ত্ব আলোচনার উদ্দেশ্যে ৬-১০-১৮৩৯ খ্রী. তত্ত্বরঞ্জিনী সভা স্থাপন করেন। দ্বিতীয় অধিবেশনে নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ হয়। অক্ষয়কুমার দত্তের সহায়তায় ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’ (১৮৪০) স্থাপন করেন। বিনাবেতনে বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও ধর্মশাস্ত্ৰ-বিষয়ক উপদেশ দেওয়া এই পাঠশালার উদ্দেশ্য ছিল। ১৮৪২ খ্রী. থেকে তত্ত্ববোধিনী সভা ব্ৰাহ্মসমাজের ভার গ্রহণ করে। ১৮৪৩ খ্রী. তার অর্থে ও অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র প্রকাশ আরম্ভ হয়। ২১-১২-১৮৪৩ খ্রী. ২০ জন বন্ধুসহ তিনি ব্ৰাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্ৰহণ করে ব্ৰাহ্মধর্মপ্রচারে উদ্যোগী হন। ১৮৪৬ খ্ৰী. বিলাতে পিতার মৃত্যুর পর অপৌত্তলিক মতে তিনি পিতৃশ্ৰাদ্ধ নিম্পন্ন করেন। পিতার দুটি প্রতিষ্ঠান—কার টেগোর কোম্পানী ও ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক উঠে গেলে ব্যবসায়-সংক্রান্ত পিতৃঋণ পরিশোধের ব্যাপারে তিনি সততা রক্ষা করেন। ১৮৫৩ খ্রী. তত্ত্ববোধিনী সভার সম্পাদক হন। ১৮৫৯ খ্রী. ব্ৰহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৬০ খ্ৰী. ব্ৰাহ্মসমাজের বেদীতে বসেন। এর পূর্বেই পুত্ৰ সত্যেন্দ্ৰনাথ ও শিষ্য কেশবচন্দ্ৰ সহ সিংহল ভ্ৰমণ করেন। ২৬-৭-১৮৬০ খ্রী. দ্বিতীয়া কন্যাকে ব্ৰাহ্মমতে বিবাহ দেন। এই বিবাহে শালগ্রাম শিলা ইত্যাদি বর্জনের ফলে সমাজে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। হিন্দুপূজা পার্বণাদি বন্ধ করে তিনি মাঘোৎসব (১১ মাঘ), নববর্ষ, দীক্ষাদিন (৭ পৌষ) ইত্যাদি নূতন কতকগুলি উৎসবের প্রবর্তন করেন। ১ আগস্ট ১৮৬১ খ্রী. তার অর্থানুকূল্যে ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকা প্ৰকাশিত হয়। কেশবচন্দ্রের কয়েকটি সমাজসংস্কারমূলক কাজে তিনি সায় দিতে না পারায় কেশবচন্দ্র তাকে ত্যাগ করে নভেম্বর ১৮৬৬ খ্ৰী. নূতন সমাজ গঠন করেন। এ সময় থেকে তার প্রবর্তিত সমাজ ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয়। খ্রীষ্টধর্মের প্রভাব থেকে যুবকদের রক্ষা করার জন্য রাধাকান্ত দেব কর্তৃক তিনি ‘জাতীয় ধর্মের পরিরক্ষক’ উপাধি প্ৰাপ্ত হন। ১৮৬৭ খ্ৰী. ব্ৰাহ্মগণ তাকে ‘মহর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৮৭৬ খ্ৰী বীরভূমের ভুবনডাঙ্গার একটি বিস্তৃত ভূমিখণ্ড কিনে সেখানে যে আশ্রম নির্মাণ করেন তা-ই আজকের ‘শান্তিনিকেতন’। তিনি ‘জ্ঞানান্বেষণ সভা’র সভ্য এবং হিন্দু চ্যারিট্যাবল ইনস্টিটিউশনের অন্যতম স্থাপয়িতা। বিধবা-বিবাহে উৎসাহী এবং শিশু ও বহু-বিবাহের বিরোধী ছিলেন। কিছুদিন রাজনীতিতে অংশ নেন। রাজনৈতিক বক্তব্য রাখার জন্য কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ১৪৭৯-১৮৫১ খ্রী. ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন স্থাপন করেন এবং সম্পাদকপদে বৃত হন। ক্রমে এই সংস্থাটি ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান সোসাইটির সঙ্গে মিশে যায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে স্বায়ত্তশাসনের দাবি-সংবলিত একটি দরখাস্ত পাঠান। তিনি বেথুন সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণ প্ৰকাশ করেছিলেন। তত্ত্ববোধিনী সভায় বাংলায় বক্তৃতা দিতেন। রচিত গ্ৰন্থ : ‘জ্ঞান ও ধর্মের উন্নতি’, ‘পরলোক ও মুক্তি’, ‘ব্রাহ্ম ধর্মের ব্যাখ্যা’, ‘আত্মজীবনী’ প্রভৃতি। অনেক ব্ৰহ্মসঙ্গীতও রচনা করেছেন। তার কৃতী সন্তানদের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ অন্যতম।
পূর্ববর্তী:
« দেবেন্দ্রনাথ ঘটক
« দেবেন্দ্রনাথ ঘটক
পরবর্তী:
দেবেন্দ্রনাথ দাস »
দেবেন্দ্রনাথ দাস »
Leave a Reply