জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (৪.৫.১৮৪৯ – ৪.৩.১৯২৫) জোড়াসাঁকো — কলিকাতা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। গৃহেই শিক্ষারম্ভ। তারপর সেন্ট পলস, মন্টেগু অ্যাকাডেমি ও হিন্দু স্কুলে পড়াশুনা করেন; সবশেষে ব্ৰহ্মানন্দ প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা (অ্যালবার্ট) কলেজ থেকে প্ৰবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন (১৮৬৪)। প্রেসিডেন্সী কলেজে এফ-এ পড়ার সময় পারিবারিক জোড়াসাঁকো থিয়েটার সংগঠনের চেষ্টায় কলেজ ত্যাগ করেন। ১৮৬৭ খ্রী. অগ্ৰজ সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথের কর্মস্থল আমেদাবাদে গিয়ে সেতারবাদন, অঙ্কনবিদ্যা এবং ফরাসী ও মারাঠী ভাষা শিক্ষা করেন। কলিকাতায় ফিরে এসে আদি ব্ৰাহ্মসমাজের সম্পাদকরূপে ১৮৬৯ – ৮৮ খ্রী. কাজ করেন। ১৯২৪ খ্রী. বালগঙ্গাধর তিলক রচিত ‘গীতা রহস্যে’র বঙ্গানুবাদ করেন। চৈত্র বা হিন্দুমেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘উদ্বোধন’ নামে একটি স্বদেশ-প্ৰেমোদীপক কাব্য পাঠ করেন (১৮৬৮)। ১৮৭৪ – ৭৫ খ্রী. মেলার যুগসম্পাদক নিযুক্ত হন। এর আগেই তাঁর রচিত জাতীয় ভাবোদীপক ঐতিহাসিক নাটক ‘পুরুবিক্রম’-এর সাফল্যমণ্ডিত অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার নাট্যকার জীবনের সূত্রপাত হয়। রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে ও তার উদ্যোগে ‘সঞ্জীবনী’ সভার সূচনা সম্ভবত ১৮৭৬ খ্রী. হয়। এই গুপ্ত স্বদেশী সভার প্রকাশ্য কর্মতৎপরতার ফলে দেশলাই প্ৰস্তুত ও দেশী কাপড় বোনার চেষ্টা হয়। দেশী স্টীমার সার্ভিস চালু করার চেষ্টায় (১৮৮৪) এবং কিছু আগে নীলচাষ ও পাটের ব্যবসায়ে তিনি অনেক আর্থিক ক্ষতি সহ্য করেন। প্ৰধানত অনভিজ্ঞতা মূল কারণ হলেও ইংরেজ ব্যবসায়ীদের অপচেষ্টার ফলেই এইসব দেশী ব্যবসায় ধবংস হয়।
স্ত্রী-শিক্ষা ও নারী-মুক্তি আন্দোলনের পুরোধা তিনি এক সময়ে ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’ প্ৰহসন রচনার জন্য দুঃখ প্ৰকাশ করেন। নিজ স্ত্রী কাদম্বরীকে শুধু শিক্ষার সুযোগই দেন নি, পরন্তু সকল সামাজিক বাধা উপেক্ষা করে কলিকাতার প্রকাশ্য ময়দানে অশ্বচালনায় পারদর্শিনী করে তোলেন। কুলীন বহুবিবাহ-প্ৰথাকে ব্যঙ্গ করে রামনারায়ন রচিত ‘নবনাটক’ তারই চেষ্টায় জোড়াসাঁকো থিয়েটারে অভিনীত হয়। তাঁর সাহিত্যকর্ম বহুবিস্তৃত। ‘পুরুবিক্রম’ ছাড়া ‘স্বপ্নময়ী’, ‘সরোজিনী’, ‘অশ্রুমতী’ ইত্যাদি নাটকগুলি বিখ্যাত হয় ও কোন-কোনটি হিন্দী, গুজরাটী ও মারাঠী ভাষায় অনূদিত হয়। ‘অলীক বাবু’, ‘এমন কর্ম আর করব না’ প্ৰভৃতি তার উল্লেখযোগ্য প্রহসন। বেশ কয়েকটি নাটক পেশাদার রঙ্গমঞ্চ ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে’ সাফল্যলাভ করে। তরুণ বয়সে স্বয়ং মঞ্চাভিনয়ে খ্যাতি পান। ‘বিদ্বজ্জনসমাগম’ (১৮৭৪) এবং ‘সারস্বত সমাজ’ (১৮৮২) নামে দুইটি সংগঠনের মাধ্যমে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির চেষ্টা করেন। ‘ভারতী’ পত্রিকা প্ৰতিষ্ঠার অন্যতম প্ৰধান উদ্যোগী (১৮৭৭)।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন (১৯০২–০৩)। ইতিহাস, দর্শন, ভ্ৰমণ-কাহিনী এবং বহু গল্প ও উপন্যাস ফরাসী সাহিত্যসম্পদ থেকে আহরণ করে বাংলায় অনুবাদ করেন। অনেকগুলি সংস্কৃত নাটকও বাংলায় অনুবাদ করেন। চিত্রাঙ্কনে পারদর্শী তার ছবির খাতায় বহু খ্যাত-অখ্যাত ব্যক্তির প্রতিকৃতি সংগৃহীত আছে। বিখ্যাত ইংরেজ শিল্পী রদেনস্টাইনের আগ্রহে তার চিত্রাবলীর একটি স্বনির্বাচিত সংগ্ৰহ ১৯১৪ খ্ৰী. বিলাতে প্ৰকাশিত হয়। প্ৰায় দু হাজার চিত্রের অধিকাংশই রবীন্দ্ৰ ভারতী সমিতির সংগ্ৰহভুক্ত। তার সাঙ্গীতিক অবদানও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম শিক্ষা ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীত-শিক্ষক বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর নিকট। বোম্বাইয়ে সেতারশিক্ষার পর কলিকাতায় ফিরে পিয়ানো, বেহালা ও হারমোনিয়ান অনুশীলন করেন। ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ সময়ে নূতন নূতন সূর সৃষ্টি করিতেন ও রবীন্দ্রনাথ-সেগুলিকে কথায় বাধিবার চেষ্টায় নিযুক্ত থাকিতেন।’ রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘মায়ার খেলা’র ও সমসাময়িক কালে রচিত অন্তত ২০টি গান জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরে গঠিত। হিন্দী ধ্রুপদাঙ্গের অনুসরণে অনেকগুলি ব্ৰহ্মসঙ্গীত রচনা করেন।
বাঙলাদেশে আকারমাত্রিক স্বরলিপির উদ্ভাবন ও প্রচলনে তার দান স্মরণীয়।
তার রচিত ‘স্বরলিপি গীতিমালা’ ও কাঙ্গালীচরণ সেন সঙ্কলিত ‘ব্ৰহ্মসঙ্গীত স্বরলিপি’ পুস্তকে তার অনেক গান প্রকাশিত। ‘বীণাবাদিনী’ ও ‘সঙ্গীত প্ৰকাশিকা’ তার সম্পাদিত মাসিকপত্র। ‘ভারতীয় সঙ্গীত সমাজ’ স্থাপন (১৮৯৭) তাঁর অন্যতম কীর্তি।
Leave a Reply