জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগী (৭.১.১৮৯১ – ১৩.২.১৯৫৬) বেড়কুচিনা–ময়মনসিংহ। ব্ৰজগোপাল। গয়া শহরে জন্ম। পাটনার রামমোহন রায় সেমিনারী ও বি-এনকলেজে এবং কলিকাতা সিটি কলেজে শিক্ষালাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় ১৯০৫ খ্রী. বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। ক্রমে তার কর্মোদ্যম সমাজসেবায় নিবদ্ধ হয়। শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে তিনি ‘ব্যান্ড অফ হোপ’ (আশাবাহিনী) গঠন করেন।
১৯১৬ খ্রী. টেম্পারেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নিযুক্ত হন। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রের আদর্শে তিনি বন্ধুদের নিয়ে কলিকাতায় (১/৫ রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট) ‘শ্রমজীবী বিদ্যালয়’ নামে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করে আমৃত্যু তার পরিচালনা করেন। সেখানে প্ৰাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে পুস্তক-বাধাই, দর্জির কাজ, ছাতা ও চামড়ার দেওব্যাদি তৈরীর কাজ, সাইনবোর্ড আঁকা প্রভৃতি কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হত। ঐ বিদ্যালয়ের ১৮টি শাখাকেন্দ্ৰে শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়াও বস্তিবাসী ও অনুন্নত শ্রেণীর উন্নয়নমূলক কাজ এবং বিনামূল্যে চিকিৎসাদি সাহায্যের ব্যবস্থাও ছিল। তিনি ডা দ্বিজেন্দ্ৰনাথ মৈত্র প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল সোশ্যাল সার্ভিস লীগের অন্যতম সংগঠক ও কর্মসচিব ছিলেন।
১৯১৪ খ্রী. দামোদরের বন্যা ও ১৯১৯ খ্রী. আত্রাই নদীর বন্যায় ত্ৰাণকার্যে যোগ দেন। তখন থেকে ক্ৰমে তার কর্মকেন্দ্ৰ গ্ৰামাঞ্চলে প্রসারিত হয়। তিনি গ্রামোন্নয়ন আন্দোলন সংগঠন করে ‘পল্লীশ্ৰী সঙ্ঘ’ স্থাপন করেন। এরপর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের প্রেরণায় ও আনুকূল্যে ‘দেশবন্ধু পল্লীসংস্কার সমিতি’ সংগঠনে ব্ৰতী হন। উভয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি সরল ও নিরক্ষর লোকদের মধ্যে চেতনা-সঞ্চার ও শিক্ষা প্রসারের জন্য ম্যাজিক ল্যান্টার্ন সহযোগে বক্তৃতা দ্বারা প্রচারের ব্যবস্থা করেন। এ দেশে এরূপ অভিনব রীতির তিনিই প্রবর্তক। জনশিক্ষা এবং সেই সঙ্গে গ্রামে গ্রামে কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচারও তিনি ম্যাজিক ল্যান্টার্নের সাহায্যে চালু করেন। তার বিভিন্ন বক্তৃতাদি তখন ‘দেশের ডাক’, ‘বিপ্লবী বাংলা’, ‘ভারতে তুলার চাষ’, ‘ভারতে কাপড়ের ইতিহাস’, ‘বিলাতী বস্ত্ৰ বৰ্জন করিব কেন’ ইত্যাদি নামে পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করেছিলেন। ‘দেশের ডাক’ ও ‘বিপ্লবী বাংলা’ ইংরেজ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। রাজদ্রোহের অপরাধে কয়েকবার তিনি কারাদণ্ডও ভোগ করেন। প্ৰতি বছর শারদীয়া পূজার পুর্বে তিনি স্বদেশী মেলার আয়োজন করতেন। বড়বাজারে একটি স্থায়ী প্ৰদৰ্শনী এবং কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে ‘স্বদেশী ভাণ্ডার’ নামে একটি পণ্যবিপণি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কলিকাতা পৌর-প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তৎকালীন মেয়র সুভাষচন্দ্ৰ বসুর অনুরোধে কলিকাতার কলেজ স্ট্রীট মার্কেটের দোতলায় ‘কমার্শিয়াল মিউজিয়াম’ নামে একটি স্থায়ী প্রদর্শনী জনসাধারণের সম্মুখে উন্মুক্ত করেন এবং উক্ত মিউজিয়ামের অধিকর্তারূপে ‘বাই স্বদেশী’ (Buy Swadeshi) আন্দোলন পরিচালনা করেন। দেশজ পণ্যের প্রচার ও প্রসারের এবং কুটীর শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্প রক্ষণের জন্য ‘ইন্ডিজেনাস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন’ স্থাপন করে অপূর্ব সংগঠনী শক্তির পরিচয় দেন। এজন্য একটি ‘সেলসম্যান ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ খুলেছিলেন। স্বাধীন ভারতে তিনি দেশীয় পণ্য-সামগ্ৰী ও আঞ্চলিক শিল্পের নমুনাদি সহ রেলগাড়ীতে ভ্ৰাম্যমাণ প্ৰদৰ্শনীও খুলেছিলেন। ১৯৪৮ খ্রী. কলিকাতা ইডেন উদ্যানের প্ৰথম সর্বভারতীয় প্রদর্শনীর সার্থক ব্যবস্থাপনা তার একটি বিশিষ্ট কীর্তি। এসময়ে তিনি ‘ন্যাশনাল চেম্বার্স অফ কমার্স’ স্থাপন ও ‘অল ইন্ডিয়া ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন’ সংগঠন করেন। ‘ম্যানুফ্যাকচারার্স’ নামে একটি পত্রিকাও তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। দুর্গাপুর শিল্পনগরী পত্তনের প্রাথমিক অনুসন্ধান ও পরিচালনার কাজ তিনিই করেছিলেন।
১৯৪২ খ্রী. ‘ভারত-ছাড়’ আন্দোলনের সময় তিনি আত্মগোপনকারী নেতাদের মধ্যে সংবাদ সরবরাহ ও সাজ-সরঞ্জামাদি আদান-প্রদানে সাহায্য করেছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্ৰহ্মদেশ থেকে আগত ভারতীয় শরণার্থীদের এবং দেশবিভাগের পর পূর্ববঙ্গের অসংখ্য উদ্বাস্তু নরনারীর বিপদে আর্থিক ও মানসিক সাহায্য এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থায়ও তিনি অগ্ৰণী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গকে বিহার রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা হলে তিনি তাঁর প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তুলতে ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুনর্গঠন সংযুক্ত পরিষৎ’ স্থাপন করেন। বঙ্গ-বিহার সংযুক্তিরোধ আন্দোলন পরিচালনা-কালে ‘শ্রমজীবী বিদ্যালয় ভবনে’ তাঁর মৃত্যু হয়।
Leave a Reply