জগদীশচন্দ্ৰ বসু (৩০.১১.১৮৫৮ – ২৩.১১.১৯৩৭) ময়মনসিংহ। আদি নিবাস রাড়িখাল-ঢাকা। ভগবানচন্দ্র। বিশ্ববিশ্রুত পদার্থবিদ ও জীববিজ্ঞানী ডেপুটি কালেক্টর পিতার কর্মক্ষেত্র ফরিদপুরে বাল্য-শিক্ষা শুরু। পরে কলিকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ও কলেজে শিক্ষা লাভ করে ১৮৮০ খ্রী গ্র্যাজুয়েট হন। কেমব্রিজ থেকে বিজ্ঞানে অনার্স সহ বি-এ, এবং লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএস-সি পাশ করেন। দেশে ফিরে ১৮৮৫ খ্রী. প্রেসিডেন্সী কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হন। তিন বছর পর্যন্ত বেতন গ্রহণে অস্বীকার করেন, কেননা এ-সময়ে ভারতীয় ও ইংরেজদের বেতনের মধ্যে বৈষম্য ছিল।
১৮৮৭ খ্রী. সমাজসংস্কারক দুৰ্গামোহন দাসের কন্যা অবলাকে বিবাহ করেন। অর্থকৃচ্ছ্রতার জন্য প্রথমে চন্দননগরে, পরে কলিকাতায় ভগিনীপতি মোহিনীমোহন বসুর সঙ্গে বাস করতেন। এ সময়ে তার বৈজ্ঞানিক নেশা ছিল ফোটোগ্ৰাফী ও শব্দগ্ৰহণ। কলেজের এডিসনের ফোনোগ্ৰাফী যন্ত্রে তিনি নানারকম শব্দগ্রহণ ও পরিস্ফুটনের পরীক্ষা করতেন। ফোটোগ্রাফ বিষয়ে গভীর গবেষণায় মনোনিবেশ করে বাড়ির বাগানে একটি স্টুডিও তৈরী করেন। ৩৫ বছর বয়সে ‘বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গ’ সম্বন্ধে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন ও পরের বছর থেকেই এই বিষয়ে নিবন্ধ প্ৰকাশ শুরু করেন। তার গবেষণা তিনটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের বস্তুনিচয় সম্পর্কে স্ব-উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র যন্ত্রের সাহায্যে অতি ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক তরঙ্গেও দৃশ্য-আলোকের সকল ধর্ম বর্তমান—এই তত্ত্ব প্রমাণ করেন। এই সময়ে তিনি বিনা তারে বার্তা প্রেরণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তার এই গবেষণা ইউরোপের বেতার-গবেষণার দ্বারা প্ৰভাবিত হয় নি। সেই হিসাবে একে যুগান্তকারী আবিষ্কার বলে অভিনন্দিত করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এই সময়েই (১৮৯৬) তাকে ডিএস-সি উপাধি প্ৰদান করে। প্যারীর আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যা কংগ্রেসে (১৯০০) পঠিত তার প্রবন্ধের নাম ‘জড় ও জীবের মধ্যে উত্তেজনাপ্রসূত বৈদ্যুতিক সাড়ার সমতা’। দ্বিতীয় পর্যায়ের গবেষণার বিষয়বস্তু তাঁর রচিত Responses in the Living amd Non-Living গ্রন্থে (১৯০২) পাওয়া যায়। পরে এই গবেষণায় তিনি ধাতু ও উদ্ভিদ ও প্রাণীর পেশীর উপর নানা পরীক্ষা করেন ও দেখান যে, বৈদ্যুতিক, রাসায়নিক ও যান্ত্রিক উত্তেজনায় ঐ তিন বিভিন্নজাতীয় পদার্থ একই ভাবে সাড়া দেয়। তার রচিত ‘comparative Electrophysiology’ গ্রন্থে এইসব গবেষণার কথা লিপিবদ্ধ হয়। মানুষের স্মৃতিশক্তির যান্ত্রিক নমুনা (Model) তিনিই সম্ভবত প্রথম প্রস্তুত করেন। আধুনিক রেইডার যন্ত্র, ইলেকট্রনিক কমপিউটার প্রভৃতির সৃষ্টি অংশত মৌলিক চিন্তার অনুসরণ করেই সম্ভব হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ের শারীরবিদ্যা-বিষয়ক গবেষণায় জড় ও প্রাণীর মধ্যগত বস্তু হিসাবে উদ্ভিদের উপর প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উত্তেজনার ফলাফল সম্বন্ধে বিশদ পরীক্ষা করেন। প্রাকৃতিক উত্তেজনার মধ্যে তাপ, আলোক ও মাধ্যাকর্ষণের ফলাফল, কৃত্রিম উত্তেজনার মধ্যে বৈদ্যুতিক ও তাপীয় আঘাত-তার পর্যালোচনার বিষয় ছিল। তিনি ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে সূক্ষ্ম সঞ্চালনকে বহুগুণ বর্ধিত করে দেখান যে তথাকথিত অনুত্তেজনীয় উদ্ভিদও বিদ্যুতিক আঘাতে সঙ্কুচিত হয়ে সাড়া দেয়। এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ক্রেস্কোগ্রাফ ছাড়া স্ফিগমোগ্রাফ, পোটোমিটার ও ফোটোসিন্থেটিক-বাবলার প্রভৃতি স্বয়ংলেখ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। উদ্ভিদের জলশোষণ ও সালোকসংশ্লেষ সম্বন্ধে তার বিশদ গবেষণাও উল্লেখযোগ্য।
১৯১৫ খ্রী. অধ্যাপনার কাজ থেকে অবসর-গ্রহণের পর ‘বসুবিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করে (৩০-১১-১৯১৭) আমৃত্যু সেখানে গবেষণা চালান। গিরিডিতে মৃত্যু। তিনি রয়্যাল সোসাইটির সদস্য (১৯২০), লীগ অফ নেশনসের ইনটেলেকচুয়্যাল কো-অপারেশন কমিটির সদস্য (১৯২৬–৩০), ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি (১৯২৭), ভিয়েনার অ্যাকাডেমী অফ সায়েন্সের বৈদেশিক সদস্য (১৯২৮) এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি (১৩২৩–২৫ ব) ছিলেন। যৌবনে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মন্দির, গুহা-মন্দির এবং প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ধ্বংসাবশেষ ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করেন ও স্থিরচিত্র গ্ৰহণ করেন। তার বাংলা রচনা ‘অব্যক্ত’র মধ্যে তাঁর সৌন্দৰ্য-পূজারী শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বসুবিজ্ঞান মন্দিরের বিভিন্ন অংশ প্রাচীন স্থাপত্যের অনুকরণে সজ্জিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্রের পরস্পরকে লিখিত পত্রাবলীতে গবেষক ও সাধক জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান-জগতে নিঃসঙ্গ পদক্ষেপের অপরূপ কাহিনী পরিস্ফুট হয়েছে। তার অন্যান্য রচনাবলী : Plant Responses as a Means of Physiological Investigations, Physiology of the Ascent of Sap, Physiology of Photosynthesis, Nervous Mechansim of plants, Collected Physical papers, Motor Mechanism of plants Growth and Tropic Movement in plants প্রভৃতি। ১৯০২ খ্রী. সিআই, ১৯১১ খ্রী. সিএসআই, ১৯১৪ খ্রী বিজ্ঞানাচার্য ও ১৯১৬ খ্রী. স্যার উপাধিতে ভূষিত হন।
Leave a Reply