ডিরোজিও, হেনরী লুই ভিভিয়ান (১০.৪.১৮০৯ – ২৩.১২.১৮৩১) কলিকাতা–এন্টালি, পদ্মপুকুর। ফ্রান্সিস। এই বিশিষ্ট অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান শিক্ষাব্ৰতী, কবি ও সাংবাদিক নিজেকে ভারতীয় বলে দাবি করতেন এবং বাঙলার মনীষিগণও তাকে বাঙালী বলে গর্ববোধ করেন। স্কচ প্রেসবিটারিয়ান যুক্তিবাদী খ্ৰীষ্টান ডেভিড ড্রামন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে শিক্ষাকালে (১৮১৫–১৮২২) তিনি ইতিহাস, দর্শন ও ইংরেজী সাহিত্যে বুৎপত্তি লাভ করেন ও সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারমুক্ত যুক্তিবাদী হয়ে ওঠেন।
১৮২৩ খ্রী. মাত্র ১৪ বছর বয়সে সওদাগরী অফিসে চাকরি নিয়ে ভাগলপুরে যান। সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশে সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা করেন। ‘জুভেনিস’ ছদ্মনামে কলিকাতার ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ এ তাঁর কয়েকটি কবিতা প্ৰকাশিত হয়। ১৮২৬ খ্রী. কলিকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষকরূপে যোগদান করেন। ইতিহাস ও ইংরেজী সাহিত্য পড়াতেন। অল্পদিনেই ছাত্রদের অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কলেজে পড়াবার সময় এবং কলেজের বাইরে তিনি অ্যাডাম স্মিথ, বেস্থাম, বার্কলে, লক, মিল, হিউম, রীড, স্টুয়ার্ট, পেইন্ট, ব্ৰাউন প্রমুখ বিখ্যাত মনীষীদের রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাখ্যা ও প্রচার দ্বারা ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানের ও যুক্তির ভিত্তি পাকা করে দেন। তার শিষ্যদলের আটজন — কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ শিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্র, শিবচন্দ্র দেব ও দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় পরবর্তী কালে বাঙলা তথা ভারতের প্রগতিমূলক আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। তারাই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে খ্যাত। তাদের ও অন্যান্য ছাত্রদের নিয়ে ডিরোজিও ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে বিতর্ক-সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সভা থেকে ক্ৰমে সাতটি পৃথক সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্ৰত্যেকটিতেই ডিরোজিও যোগ দিতেন। এখানে পৌত্তলিকতা, জাতিভেদ, আস্তিকতা, নাস্তিকতা, অদৃষ্টবাদ, সাহিত্য, স্বদেশপ্রেম প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা ও মত-বিনিময় হত। ডেভিড হেয়ারের আগ্রহে ডিরোজিও পটলডাঙ্গা স্কুলেও বক্তৃতা করতেন। এখানেও হিন্দু কলেজ ও অন্যান্য বিদ্যালয়ের ছাত্ররা বক্তৃতা শুনতে আসত। তার বহু বিতর্কসভায় হেয়ার, বিশপস কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর মিল প্রমুখ তৎকালীন বিখ্যাত ব্যক্তিরা উপস্থিত থেকে আলোচনায় যোগ দিতেন।
১৮৩০ খ্রী. তার প্রেরণায় হিন্দু কলেজের ছাত্ররা ‘পার্থেনন’ নামে একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক প্ৰকাশ করেন। কিন্তু কলেজ-কর্তৃপক্ষের আদেশে পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংখ্যা প্ৰকাশ হবার আগেই তা বন্ধ হয়ে যায়। যুগ পরিপ্রেক্ষিতে ‘পার্থেননে’র একটি মাত্র সংখ্যার রচনাগুলির বিষয়বস্তু দেখলেই এই নিষেধাজ্ঞার কারণ বোঝা যাবে। স্ত্রী-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, ভারতকে ইউরোপীয়দের উপনিবেশে পরিণত করার চেষ্টার বিরোধিতা, আদালতের বিচারকার্যে ব্যয়বাহুল্য কমান এবং হিন্দুধর্মে প্রচলিত বিবিধ কুসংস্কারের প্রতি তীব্র আক্রমণ প্রভৃতি প্ৰবন্ধগুলির বিষয়বস্তু ছিল। ছাত্ৰগণ কেবল হিন্দুধর্মেরই নয়, প্রচলিত খ্ৰীষ্টধর্মেরও বিরোধিতা করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে ডিরোজিও প্রচারিত যুক্তিনিষ্ঠ বিচার ও সর্বপ্রকার অন্ধ বিশ্বাস পরিহার করার শিক্ষায় ছাত্ৰগণ ধর্মীয় আচার-ব্যবহারের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। ক্রমে ছাত্রদের মধ্যে মদ্যপান, নিষিদ্ধদ্রব্য ভক্ষণ ও আচারভ্ৰষ্টতায় হিন্দুসমাজে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
১৮৩০ খ্ৰীষ্টাব্দে হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্র ও শিক্ষকদের ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ক সভা-সমিতিতে যোগ দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। ফলে ছাত্ররা আরও উগ্র হয়ে ওঠে। এই সময় কলেজ ভবনে মিশনারী আলেকজান্ডার ডাফের খ্ৰীষ্টধর্ম-প্রচারমূলক বক্তৃতার প্রতিবাদ করে ‘ইন্ডিয়া গেজেটে’ এক লেখা বেরুলে সবাই ধরে নেন-এটি ডিরোজিওর লেখা। ২৩-৪-১৮৩১ খ্রী. কলেজের পরিচালন সমিতির পক্ষ থেকে হেনরী হেম্যান উইলসন ডিরোজিওকে দোষী সাব্যস্ত করে পদত্যাগ করতে চিঠি দেন। ২৫ এপ্রিল ১৮৩১ খ্রী. তীব্ৰ প্ৰতিবাদসহ অভিযোগ খণ্ডন করে ডিরোজিও পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি ‘হেসপারাস’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা আরম্ভ করেন এবং ১ জুন
১৮৩১ খ্ৰী. ‘ঈস্ট ইন্ডিয়ান’ নামে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের একমাত্র মুখপত্ৰ প্ৰকাশ করেন। এ সময়ে অন্যান্য পত্রিকাদিতেও তার প্ৰবন্ধ প্রকাশিত হত। মাত্র তেইশ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তাঁর সুযোগ্য শিষ্যদল তার প্রবর্তিত আন্দোলন ও ‘এনকোয়ারার’, ‘জ্ঞানান্বেষণ’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে সত্যানুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যান। তারা আজ বাঙলার নবযুগের ভগীরথ বলে স্বীকৃত। তৎকালীন হিন্দু কলেজ সম্বন্ধে বলা হত—’Hindu College at the time of Derozio-Master Spirit of the Era’।
ডিরোজিওর ২টি কাব্যগ্রন্থ ও ২টি কবিতা-সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে ‘‘ফকির অফ জাঙ্ঘিরা’ বিখ্যাত। ডিরোজিওর সমস্ত কবিতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন বিষাদের ছায়া পাওয়া যায়। তার রচিত ‘To My Native Land’ কবিতায় আছে-My Country! In The days of Glory Past/A beauteous halo cicled round thy brow/And worshipped as deity thou wast/Where is the Glory, Where that reverence now? ছাত্রদের উদ্দেশ করে তিনি লিখেছিলেন, ‘Expanding like the petals of young flowers / I watch the gentle opening of Your minds……’
Leave a Reply