চৈতন্যদেব (১৮/১৯.২.১৪৮৬ – ১৫৩৩) নবদ্বীপ-নদীয়া। জগন্নাথ মিশ্র। পিতৃদত্ত নাম বিশ্বম্ভর। পিতামহ উপেন্দ্র মিশ্রের আদিনিবাস ছিল শ্ৰীহট্ট। গৌরীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক এই মহাপুরুষ নিমাই, গৌরাঙ্গ, মহাপ্ৰভু, শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য, সংক্ষেপে চৈতন্যদেব প্রভৃতি নামে উল্লিখিত। তাঁর ৬/৭ বছর বয়সের সময় অগ্ৰজ বিশ্বরূপ গৃহত্যাগ করেন ও সন্ন্যাস নিয়ে নিরুদ্দিষ্ট হন। উপনয়নের পর বিশ্বম্ভর গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে ব্যাকরণ, কাব্য ও অলঙ্কার অধ্যয়ন করে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৬ বছর বয়সে অধ্যাপনা শুরু করে লক্ষ্মীপ্রিয়াকে বিবাহ করেন। কিছুকাল নবদ্বীপে অধ্যাপনার পর পিতৃভূমি শ্ৰীহট্টে যান ও সেখানে কয়েক মাস বিদ্যা বিতরণ করে নবদ্বীপে ফিরে এসে জানলেন, লক্ষ্মীপ্রিয়ার সর্পদংশনে মৃত্যু হয়েছে। পুত্রের বৈরাগ্য লক্ষ্য করে মাতা শচীদেবী সুন্দরী বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেন। কিছুদিন পর তিনি পিতৃকৃত্যের জন্য গয়ায় যান এবং ঈশ্বর পুরীর নিকট দশাক্ষর গোপাল-মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এর অনেক কাল পূর্বে নবদ্বীপে অদ্বৈত আচার্য, যবন হরিদাস, শ্ৰীবাস পণ্ডিত প্রভৃতির চেষ্টায় এক বৈষ্ণব গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। তাদের ভক্তি-বিহ্বলতায় আকৃষ্ট হয়ে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে ক্ৰমে সংকীর্তনে মনোনিবেশ করেন। ক্রমশ এই বৈষ্ণব গোষ্ঠী বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২৪ বছর বয়সে তিনি কাটোয়ায় কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস দীক্ষা নিয়ে (১৫১০) নীলাচল (পুরী) ভ্ৰমণে যান। সেখান থেকে দক্ষিণ ভারতের তীর্থসমূহ ও পশ্চিম ভারত ঘুরে কিছুসংখ্যক পণ্ডিতকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করে পুরীতে ফেরেন। দুই বছর পুরীতে বাস করে তিনি গৌড়ে আসেন। পথে রাজমন্ত্রী রূপ ও সনাতন তার শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করেন। তারপর মাতার অনুমতি নিয়ে তিনি বারাণসী, প্ৰয়াগ, মথুরা ও বৃন্দাবন দর্শন করে পুরীধামে ফেরেন এবং জীবনের অবশিষ্ট কাল সেখানেই কাটান। ‘চৈতন্যমঙ্গলে’র রচয়িতা জয়ানন্দ ভিন্ন তাঁর সমসাময়িক অপর কোন চরিতকার চৈতন্যদেবের তিরোধানের কথা উল্লেখ করেন নি। উক্ত জীবনীকাব্যে আছে যে রথের সম্মুখভাগে নর্তনকালে পায়ে ইটের কুচি বিদ্ধ হওয়ায় ব্যাধিকবলিত হয়ে তার দেহাবসান ঘটে। চৈতন্যদেবকে নূতন ধর্মমতের স্রষ্টা বলা অপেক্ষা ধর্মের নূতন ব্যাখ্যাতা বলা ভাল। প্ৰেম-বিহ্বল ভক্তিরসের প্রবাহে ঈশ্বর-সাধনার যে স্বরূপ তিনি তার জীবন দিয়ে উদঘাটিত করেছেন, তাতে দেবতা মানুষের আপনজন হয়ে ধরা দিয়েছে এবং মানুষের মধ্যে দেবতা প্রকট হয়ে উঠেছে। এই প্ৰেমধর্মের কাছে জাতি-বর্ণ-ধর্ম-শ্রেণী-নির্বিশেষে সব মানুষই ঈশ্বরের জীব। জীবে দয়া, ঈশ্বরে ভক্তি প্রভৃতি সনাতন আদর্শে সবারই সমান অধিকার-এই মতবাদে উদার ধর্মের যে বন্যা তিনি প্রবাহিত করেছিলেন, তাতে শুধু দর্শনশাস্ত্ৰেই নয়, সাহিত্য, কাব্য ও সঙ্গীতেও নূতন চিন্তা শুরু হয়।
পূর্ববর্তী:
« চেরাগালি শাহ
« চেরাগালি শাহ
পরবর্তী:
ছবি বিশ্বাস »
ছবি বিশ্বাস »
Leave a Reply