চিত্তরঞ্জন দাশ, দেশবন্ধু (৫.১১.১৮৭০ – ১৬.৬.১৯২৫) কলিকাতা। অ্যাটর্নী ভুবনমোহন। পৈতৃক নিবাস তেলিরবাগ-ঢাকা। বাঙলার প্রখ্যাত দেশনেতা ও দাতা। ভবানীপুর লণ্ডন মিশনারী স্কুলে বিদ্যারম্ভ। ১৮৯০ খ্রী. প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি-এ, পাশ করেন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য বিলাত যান। ১৮৯৩ খ্রী. ব্যারিস্টার হয়ে স্বদেশে ফিরে এসে আইন ব্যবসায় শুরু করেন। ছাত্রজীবনেই প্রেসিডেন্সী কলেজে সুরেন্দ্রনাথ প্রবর্তিত স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য। বিলাতে বাসকালেও রাজনৈতিক ব্যাপারে তৎপর ছিলেন। ‘অনুশীলন’ বিপ্লবী দলের সঙ্গে এবং অরবিন্দ ঘোষ ও ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। বরাবর রাজনৈতিক মামলায় অংশগ্ৰহণ করতেন। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার আসামী (বারীন ঘোষ, অরবিন্দ প্রমুখ) পক্ষ সমর্থনে ব্যারিস্টার ও দেশপ্রেমিকরূপে প্ৰভূত খ্যাতি অর্জন করেন। এই সময় থেকেই আইন ব্যবসায়ে বিপুল অর্থোপার্জন হতে থাকে। পিতৃবন্ধুর ঋণের দায়িত্ব গ্রহণের ফলে ১৯০৬ খ্ৰী. পিতাপুত্র উভয়কেই দেউলিয়া হতে হয়েছিল; ১৯১৩ খ্রী তিনি পিতৃঋণ পরিশোধ করে দেউলিয়া নাম খণ্ডন করেন। ১৯০৬ খ্রী. কলিকাতা কংগ্রেসের প্রতিনিধি ও ১৯১৭ খ্রী. বঙ্গীয় প্ৰাদেশিক রাজনৈতিক সম্মেলনের সভাপতি হন। মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন-সংস্কার, পাঞ্জাবে সরকারী দমননীতি ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলেন। পাঞ্জাবে সরকারী নীতি-বিষয়ে কংগ্রেসগঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯২০ খ্রী. মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় আইনসভা-বর্জন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। পরে স্বয়ং অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব কংগ্রেস অধিবেশনে উত্থাপন করেন। এবং গান্ধীজীর ডাকে বহু সহস্র টাকা মাসিক আয়ের ব্যারিস্টারী পেশা ত্যাগ করে দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এই সময় তিনি ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ব্যারিস্টাররূপে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। স্বয়ং ভারত সরকার প্রখ্যাত মিউনিশনস বোর্ডঘটিত মামলায় প্রচলিত নজির উপেক্ষা করে সাহেব অ্যাডভোকেট-জেনারেলের অপেক্ষা অধিক পারিশ্রমিক দিতে স্বীকৃত হয়ে তাকে সরকারী কৌঁসূলী নিযুক্ত করেন। অসহযোগ আন্দোলনে আইন ব্যবসায় পরিত্যাগ করার জন্য তিনি এ কাজও পরিত্যাগ করেন। তাঁর অসামান্য ত্যাগের ফলে সারা দেশ অনুপ্রাণিত হয় ও বাঙলার মানুষ তাকে ‘দেশবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। নিজের ও পরিবারবর্গের বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাসিসুলভ অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতে থাকেন। ছাত্রদের গোলামখানা (বিশ্ববিদ্যালয়) ত্যাগের আহ্বান জানান। আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বাঙলার পরিচালকরূপে প্রথমেই নিজ পত্নী বাসন্তী দেবী ও ভগ্নী ঊর্মিলা দেবীকে কারাবরণ করতে আদেশ দেন। এই প্ৰথম মহিলাগণ প্ৰকাশ্য সত্যাগ্রহে অংশ নিলেন। সারা দেশে বাসন্তী দেবীর গ্রেপ্তারী-সংবাদে উত্তেজনা চরমে ওঠে। ১৯২১ খ্রী. নিজে আইন অমান্য করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ফলে আমেদাবাদ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েও অনুপস্থিত ছিলেন। পরের বছর কারামুক্ত হয়ে গয়া কংগ্ৰেসে সভাপতিত্ব করেন এবং সরকারী নীতির বিরোধিতা করার জন্য আইনসভায় প্রবেশের পক্ষে অভিমত দেন। গান্ধীজী কারাগারে ছিলেন, কিন্তু তার অনুগামীদের বিরোধিতায় এ নীতি কংগ্রেস কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়। দেশবন্ধু কংগ্রেস সভাপতিত্ব ত্যাগ করে ‘স্বরাজ্য দল’ গঠন করে জনমত সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালান। মতিলাল নেহেরু এবং দেশবন্ধুর নেতৃত্বে এই দল ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ফলে পরের বছর ১৯২৩ খ্রী. কংগ্রেস আইনসভায় প্রবেশের নীতি গ্ৰহণ করে। এই বছর হিন্দু-মুসলমান ঐক্য রক্ষার জন্য স্বরাজ্য দল ও মুসলমান নেতাদের যে চুক্তি হয় তা ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে খ্যাত। ১৯২৩ খ্রী. নির্বাচনে স্বরাজ্য দল বিশেষ সাফল্য লাভ করে। ১৯২৪ খ্রী. তারকেশ্বরের মোহন্তের অনাচারের বিরুদ্ধে সত্যাগ্ৰহ করেন। তিনিই কলিকাতা কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র এবং সুভাষচন্দ্ৰ প্ৰথম প্রধান। অফিসার। ১৯২৪ খ্রী. সরকার বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স জারী করে সুভাষচন্দ্ৰ, সুরেন্দ্রমোহন প্রমুখ নেতাদের গ্রেপ্তার করলে তিনি নিজ বাড়িতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকের আহ্বান জানান। এবার গান্ধীজীও উপলব্ধি করেন যে, স্বরাজ্য দলকে দমনের জন্যই এই অর্ডিন্যান্স। এরপর থেকে দেশবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। অত্যধিক পরিশ্রম ও কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে দেশবন্ধু দুর্বল হয়ে পড়েন। মৃত্যুর পূর্বে পৈতৃক বসতবাটি জনসাধারণকে দান করেন। এখন সেখানে তার নামাঙ্কিত ‘চিত্তরঞ্জন সেবাসদন’ প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতির মধ্যে থেকেও তিনি রীতিমত সাহিত্যচর্চা করতেন। সে সময়ের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘নারায়ণ’ তিনিই প্ৰতিষ্ঠা করেছিলেন (১৩২১ ব)। কবি ও লেখক হিসাবে তার পরিচিতি ‘মালঞ্চ’, ‘সাগরসঙ্গীত’ ও ‘অন্তর্যামী’ গ্রন্থের জন্য। তার রচিত ‘ডালিম’ গল্পের নাট্যরূপ মিনার্ভায় (আলফ্রেড) পরিবেশিত হয় (১৫.৭.১৯২৪)। শিশির ভাদুড়ীকে জাতীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দার্জিলিংয়ে মৃত্যু। কলিকাতায় তার শেষযাত্রায় অভূতপূর্ব লোকসমাগম হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন—‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্ৰাণ/মরণে তাঁহাই তুমি করে গেলে দান’।
পূর্ববর্তী:
« চিত্তরঞ্জন গোস্বামী
« চিত্তরঞ্জন গোস্বামী
পরবর্তী:
চিত্তরঞ্জন মাইতি »
চিত্তরঞ্জন মাইতি »
Leave a Reply