চারু মজুমদার (১৯১৫ – ২৮.৭.১৯৭২) হাগুরিয়া-রাজশাহী। বীরেশ্বর। মধ্যস্বত্বভোগী ভূম্যধিকারী পরিবারে জন্ম। শিলিগুড়ি বয়েজ হাই স্কুল থেকে ১৯৩৩ খ্রী. ম্যাট্রিক পাশ করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। ক্রমে সাম্যবাদী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষক সংগঠনে মনোনিবেশ করেন। ১৯৩৬ খ্রী. তার কর্মক্ষেত্র ছিল জলপাইগুড়ি জেলা। ৬ বছর আত্মগোপন করে থাকেন। এই সময় কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পান। ১৯৪২ খ্রী. জলপাইগুড়িতে গ্রেপ্তার হয়ে দুই বছর নিরাপত্তা বন্দীরূপে থেকে ১৯৪৪ খ্রী. মুক্ত হন। উত্তরবঙ্গে ফিরে গিয়ে চা-বাগানের শ্রমিক-সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৯ খ্রী. ভারতের কম্যুনিস্টপাটি বে-আইনী ঘোষিত হলে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন। ১৯৫২ খ্ৰী. মুক্তি পেয়ে পার্টির সহকর্মিণী লীলা সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন। অতঃপর তরাই অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে কাজ করতে থাকেন। ১৯৫৭ খ্রী. নকশালবাড়ি অঞ্চলের কেষ্টপুরে চা-বাগিচার মালিকদের বিরুদ্ধে সংগ্ৰাম করে গ্রেপ্তার হন। ৪ মাসের জন্য কারারুদ্ধ হলেও পরে কৃষক পক্ষের জয় হয়। এই সময় থেকে তাকে কৃষক পক্ষের হয়ে বহু মামলা পরিচালনায় সও্যাল-জবাব করতে দেখা যায়। এ সব মামলা অনেক সময় নিজ অর্থব্যয়ে চালাতেন। ১৯৬২ খ্রী. নির্বাচনে শিলিগুড়ি কেন্দ্ৰে প্ৰতিদ্বন্দ্বিতা করে কংগ্রেস প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এই বছর ভারত-চীন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কম্যুনিস্ট পার্টিতে মতদ্বৈধ দেখা দেয়। তিনি ভারতরক্ষা বিধানে গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৬৩ খ্রী. থেকে চীনের রাষ্ট্রগুরু মাও-সে-তুং-এর আদর্শে প্রভাবিত হয়ে ওঠেন। ১৯৬৫ খ্রী. পাক-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার হন। এই বছরই একটি সার্কুলার প্রচার করেন, যা পরে মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির [CPI(M)] নেতৃবৃন্দ কর্তৃক আপত্তিকর বলা হয়। ১৯৬৬ খ্রী পুলিস হেফাজতে তিনি হাসপাতালে স্থানান্তরিত হন এবং এই বছরই মুক্তি পান। ১৯৬৭ খ্ৰী. পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয় ও যুক্ত বামপন্থী ফ্রন্ট কর্তৃক সরকার গঠন বিষয়ে CPI(M) দলের নেতৃত্বের সঙ্গে তার বিরোধ শুরু হয়। এই বিরোধ থেকে ক্ৰমে কম্যুনিস্ট ডেশন (১৯৬৮) ও শেষে ১৯৬৯ খ্রী ১ মে কম্যুনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেলিনবাদী [CPI(ML)] দল গঠন করে একজন সাধারণ কৃষককর্মী থেকে সারা ভারতে সর্বাধিক উচ্চারিত নামের বিপ্লবী নেতারূপে পরিচিত হন। সাধারণভাবে এই দলটি নকশালপন্থী নামে পরিচিত। নকশালবাড়িতে প্রকৃত কৃষকদের জমির মালিকানা-লাভের আন্দোলন থেকেই এই নামের উৎপত্তি। ১৯৬৯–৭১ খ্রী. প্ৰায় দুই বছর এই নবগঠিত দল পশ্চিমবাঙলার সব চেয়ে পরাক্রান্ত, সুগঠিত এবং মারমুখী বিপ্লবী দলরূপে বর্তমান ছিল। এই দলের প্রভাব বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। চলতি সমাজ-ব্যবস্থার আশু আমূল পরিবর্তনের আশায় বেশ কিছু প্রতিভাবান যুবক-যুবতী এই দলের শক্তিবৃদ্ধি করেন। কিন্তু তার নির্দেশে কৃষিবিপ্লব এবং রাজনৈতিক আন্দোলন ক্রমশ শহরাঞ্চলে ব্যক্তিগত হত্যা, বরেণ্য দেশনেতা, শিক্ষাবিদ ও মনীষীদের মূর্তিভাঙা, স্কুল-কলেজ পোড়ানো প্রভৃতি বিকৃত আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। প্রথম দিকে চীন প্রকাশ্যে CPI(ML)-এর কৃষিবিপ্লবের নীতি সমর্থন করলেও পরে তাদের কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করে। এই সমালোচনা এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে CPI(ML) ক্রমশ কয়েকটি উপদলে ভাগ হতে শুরু করে। সরকার এই দলটির বিরুদ্ধে অতি কঠোর দমন-নীতি প্ৰয়োগ করেন। এই ব্যাপারে দলের বহু কর্মী নিহত এবং অনেকে কারারুদ্ধ হন; পুলিস এবং অনেক সাধারণ লোকও মারা পড়ে। ১৯৭২ খ্রী. নির্বাচনে কংগ্রেস দল ক্ষমতায় আসে। ১৬-৭-১৯৭২ খ্রী. তিনি গোপন আবাস থেকে গ্রেপ্তার হন। ২৮ জুলাই ১৯৭২ খ্রী. ভোরে হৃদরোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল বলে সরকারপক্ষ ঘোষণা করেন।
পূর্ববর্তী:
« চাম্পা গাজী
« চাম্পা গাজী
পরবর্তী:
চারু মাস্টার (চাকমা) »
চারু মাস্টার (চাকমা) »
Leave a Reply