চারুচন্দ্র দত্ত (১৬.৬.১৮৭৬ – ২২.১.১৯৫২) মেরাল—বর্ধমান। দেওয়ান কালিকাদাস পিতার কর্মস্থল কুচবিহারে জন্ম। সেখানে তিনি শিকারও শিখেছিলেন। কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি-এ পাশ করে ১৮৯৫ খ্রী. বিলাত যান। ছাত্রাবস্থায় সুবোধচন্দ্ৰ মল্লিকের ভগিনীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। ১৮৯৯ খ্রী. আইসিএস হয়ে বোম্বাই-সিন্ধু প্রদেশের উচ্চশ্রেণীর কর্মচারী হিসাবে যোগ দেন। আমেদাবাদ, বিজাপুর এবং পশ্চিম ভারতের নানা রাজ্যে তার কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত ছিল। বোম্বেতে প্ৰথমে ম্যাজিষ্ট্রেট ও পরে জজ হন। এখানেই দেশসেবার কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে জনসেবা সঙ্ঘ এবং শিল্প ও ব্যায়ামের কেন্দ্ৰ স্থাপন করেন। আইসিএস তকমা সত্ত্বেও তিনি অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের গোপনচক্ৰে ‘ত্ৰয়ী’ নেতার অন্যতম ছিলেন; অপর দুজন অরবিন্দ ঘোষ ও সুবোধ মল্লিক। ১৯০২-০৩ খ্রী. বোম্বাইতে অরবিন্দ, বালগঙ্গাধর তিলক, গণেশ দেউস্কর প্রমুখ নেতাদের সঙ্গে ভারতে সশস্ত্ৰ বিপ্লব ও ভবানী মন্দিরের পরিকল্পনা রূপায়ণের চেষ্টা করেন। ১৯০৮ খ্রী. আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলায় অরবিন্দ গ্রেপ্তার হলে অরবিন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কারণে স্বগ্রামে দু’বছর অন্তরীণ থাকেন। ১৯১০ খ্রী তিনি বোম্বাই অঞ্চলে পূর্বকাজে যোগ দেন এবং ১৯২৫ খ্রী. অবসর-গ্ৰহণ করেন। বিপ্লবী গুপ্ত সংস্থা কর্তৃক অভিযুক্ত অত্যাচারী ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ডের বিচারসভায় চারুচন্দ্র একজন বিচারক ছিলেন। দাৰ্জিলিং-এ এনড্রু সাহেবকে হত্যার পরিকল্পনার মধ্যেও তিনি ছিলেন এবং সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সে ব্যর্থতার দায়িত্বও একা বহন করেছেন। সিভিলিয়ান চারুচন্দ্ৰ চাকরি বজায় রেখেও স্বদেশিক কাজকর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকেছেন। ১৯২৮ খ্রী. জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ভারতীয় কংগ্রেসের ইতিহাস-রচনার ভার তাঁর ওপর পড়েছিল। এই ইতিহাসের তিনিই প্ৰথম রচয়িতা। ১৯৩১ খ্রী. ‘পরিচয়’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর সঙে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। এই পত্রিকায় কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা সংবলিত আত্মজীবনী ‘পুরানো কথা’ লিখতে থাকেন। পরে এই আত্মজীবনী গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৩১ – ৩৮ খ্ৰীতিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে ছিলেন। তার মধ্যে পাঁচ বছর বিশ্বভারতীর উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। সাহিত্যিক, গল্পরসিক চারুচন্দ্ৰ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—তার গল্পে থাকে ‘নিরাসক্ত ঔৎসুক্য’ তথা ‘কৌতুহলের উৎস থেকে’ জাত কৌতুক-ফেনিল মনের পরিচয়। তার ‘দুনিয়াদারী’ গল্পগ্রন্থের কোন গল্পেই একটুও বিলিতি গন্ধ নেই। তাঁর রচিত ‘কৃষ্ণরাও’, ‘দেবারু’, ‘মায়ের আলাপ’ বইগুলিও গল্পরসে সমৃদ্ধ। তাঁর ‘পুরানো কথা’ নামক এমন নিরাসক্ত আত্মস্মৃতি বাংলা ভাষায় খুব কমই লেখা হয়েছে। অপর গ্রন্থ : ‘মায়া’ (উপন্যাস); ‘নানাকথা’ (ছোটদের বিজ্ঞান), ‘পুরানো কথা—উপসংহার’ প্রভৃতি। ১৯৪০ খ্ৰীকলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্ৰণক্ৰমে ‘রামদাস ও শিবাজী’ নামে যে বক্তৃতা দেন, তা তৎকালীন চিন্তাবিদগণকর্তৃক সংবর্ধিত হয়েছিল। স্বদেশ ও সাহিত্যে উৎসগীকৃত চারুচন্দ্রের প্রাণ একটি পারমার্থিক কেন্দ্ৰে এসে স্থির হয়ে গিয়েছিল। শ্ৰীঅরবিন্দ ছিলেন সেই কেন্দ্রের অধিষ্ঠিত পুরুষ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ব্ৰাহ্ম সমাজের প্রগতিশীল চিন্তাধারা। ১৯৪৬ খ্রী. তিনি পুরোপুরি শ্ৰীঅরবিন্দের পণ্ডিচেরী আশ্রমে যোগ দিয়ে সেখানের শিক্ষাবিস্তারের বিবিধ উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায় এবং বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় শ্ৰীঅরবিন্দের দৰ্শন-সম্পর্কে নানা রচনায় আমৃত্যু জীবন অতিবাহিত করেছেন।
পূর্ববর্তী:
« চারুচন্দ্র ঘোষ
« চারুচন্দ্র ঘোষ
পরবর্তী:
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় »
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় »
Leave a Reply