কেশবচন্দ্র সেন (১৯.১১.১৮৩৮ – ৮.১.১৮৮৪) কলিকাতা। প্যারীমোহন। পিতামহ দেওয়ান রামকমল সেনের বিশিষ্ট পারিবারিক পরিবেশে বর্ধিত হন। হিন্দুকলেজে (১৮৪৮-১৮৫৮) ও কিছুদিনের জন্য হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজে (১৮৫৩) শিক্ষালাভ করেন। ১৮৫৬ খ্রী. বিবাহ। ১৮৫৭ খ্রী. ব্ৰাহ্মসমাজে যোগ দেন। হিন্দু কলেজে ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, ন্যায়, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করেন। দর্শনে, বিশেষ করে ধর্মবিষয়ে আকর্ষণ ছিল। অচিরেই দেবেন্দ্ৰনাথের প্রিয়পাত্র এবং ব্ৰাহ্মসমাজের নেতা হন। ব্ৰাহ্মগণ হিন্দুধর্মের বর্ণপ্ৰথা বিলোপের চেষ্টায় অসবর্ণ বিবাহে উৎসাহী হন এবং অব্ৰাহ্মণ কেশবচন্দ্ৰকে ‘ব্ৰহ্মানন্দ’ উপাধিসহ সমাজের আচাৰ্যপদে নিয়োজিত করেন (১৮৬২)। অসাধারণ বাগ্মিতা ও স্বদেশপ্রীতির জন্য দেশজোড়া খ্যাতি ছিল। ‘গুডউইল ফ্রেটারনিটি’ সভার (১৮৫৭) ও ভারতসভার উদ্যোক্তা হিসাবে ‘ইংরেজদের সদিচ্ছায় ভারতিয়দের উন্নতিসাধন’ এইজাতীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ‘ব্ৰহ্ম বিদ্যালয়’ (১৮৫৯) ও ‘সঙ্গত সভা’ (১৮৬০) গঠন করে ছাত্র সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করেন। ১৮৬১ খ্ৰী ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ পাক্ষিক পত্রিকা এবং পরে ‘সানডে মিরর’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। বিধবা-বিবাহে উৎসাহী ছিলেন এবং ১৮৫৯ খ্রী. অনুষ্ঠিত ‘বিধবা বিবাহ নাটক’ অভিনয়ে মঞ্চাধ্যক্ষ ছিলেন। প্ৰচলিত শিক্ষানীতি সংস্কারের জন্য ‘কলিকাতা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৬২)। ১৮৬৪ খ্রী. ভারত পরিক্রমা করে ব্ৰাহ্ম সমাজকে সর্বভারতীয় রূপ-দানে উদ্যোগী হন। মেয়েদের জন্য ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা (১৮৬৩) প্ৰকাশ ও ‘ব্রাক্ষিকা সমাজ’ (১৮৬৫) স্থাপিত হয়। মদ্যপান, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। হিন্দুধর্ম থেকে স্বাতন্ত্র্যরক্ষার জন্য ‘ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান’ পুস্তিকা প্রচার করেন। ফলে দেবেন্দ্রনাথকে উপবীত ত্যাগ করতে হয় এবং ঐ সময় থেকেই ব্ৰাহ্মমতে বিবাহকার্য শুরু হয়। হিন্দুধর্মবিরোধী প্রচার ইত্যাদির ফলে দেবেন্দ্ৰনাথ ও কেশবচন্দ্রের অনুগামীদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয় এবং ১৮৬৬ খ্রী. কেশবচন্দ্ৰ ‘ভারতবর্ষীয় ব্ৰাহ্মসমাজ’ এবং ১৮৬৯ খ্রী. ভারতবর্ষীয় ব্ৰাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। শ্লোকসংগ্ৰহ গ্ৰন্থ প্ৰকাশ, মাতৃভাষায় ব্রহ্মোপাসনা ও নগরসংকীর্তন প্রবর্তিত হয়। ১৮৭০ খ্ৰী. ধর্মপ্রচারার্থ বিলাত যান। সেখানে সম্রাজী ভিক্টোরিয়া ও অন্যান্যরা তাকে বিপুল সংবর্ধনা জানান। ব্ৰাহ্মবিবাহের সুবিধার্থ ১৮৭২ খ্রী. যে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট আইন প্রণীত হয়, তার মূলে ছিলেন কেশবচন্দ্ৰ। ১৮৭১ খ্রী. জাতীয় সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ‘ইণ্ডিয়ান রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা ও এক পয়সা মূল্যের ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। বয়স্কা মহিলাদের শিক্ষা, শিক্ষয়িত্রী গঠন, বালিকাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ১৮৭১ খ্রী. ‘নেটিভ লেডিজ নর্মাল এণ্ড এডাল্ট স্কুল’ স্থাপন করেন। ক্রমে উচ্চশিক্ষা সংযুক্ত হয়ে এটিই ১৮৮৩ খ্রী. ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিত হয়। নূতন রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের জন্য ‘এলবার্ট ইনস্টিটিউট গঠন করেন (১৮৭৬)। ‘এলবার্ট হল’-এরও তিনি প্রতিষ্ঠাতা। তার সম্পাদনায় ‘বালক বন্ধু’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় (১৮৭৮)। কন্যা সুনীতির বিবাহ উপলক্ষে নিজ সৃষ্ট ‘উপবীতত্যাগ’ প্রথা এবং মেয়েদের বিবাহের নিম্নতম বয়সসীমা লঙ্ঘন করেন (১৮৭৮)। এই বিবাহ অনুষ্ঠানে ব্ৰাহ্মপদ্ধতি ক্ষুন্ন হয়েছে মনে করে শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ একদল নেতৃস্থানীয় ব্ৰাহ্ম আন্দোলন করেন এবং ‘সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজ’ নামে একটি পৃথক সমাজ স্থাপিত হয়। বাকী জীবন তিনি ধ্যান, যোগ ইত্যাদিতে কাটান। ‘নববিধান’ বা ‘সমন্বয় ধর্ম’ নামে নূতন নূতন সাধন প্রবর্তন করেন। বহু সুখ্যাত বক্তৃতা ছাড়া, কোরান শরীফ ও মেসকাত শরীফের প্রথম বঙ্গানুবাদ করান। গীতা, ভাগবত ও বেদান্তের ভাষ্যকার, শ্ৰীকৃষ্ণ, শ্ৰীচৈতন্য, গুরু নানক, খ্ৰীষ্ট ও মুসলমান সাধকদের জীবন-চরিতাকার এবং ‘যোগ’, ‘নবসংহিতা’ (১৮৮৩), ‘জীবন বেদ’ প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর ম্মাতা সারদাসুন্দরী দেবীর বিবৃত আত্মকথা ১৯১৪ খ্ৰী. গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
পূর্ববর্তী:
« কেশবচন্দ্র রায়
« কেশবচন্দ্র রায়
পরবর্তী:
কেশবচন্দ্ৰ আচাৰ্য চৌধুরী »
কেশবচন্দ্ৰ আচাৰ্য চৌধুরী »
Leave a Reply