কালীচরণ ঘোষ১ (১৮শ শতাব্দী)। কলিকাতার সুকিয়া স্ট্রীটের বাসিন্দা এবং ইংরেজ সরকারের সমর-বিভাগের কেরানী ছিলেন। তৃতীয় মহারাষ্ট্র যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যের ভরতপুর অবরোধের সময় হঠাৎ জেনারেলের মৃত্যু হলে তিনি মৃত জেনারেলের পোশাক পরে যুদ্ধ পরিচালনা করে জয়লাভ করেন। কিন্তু বিনানুমতিতে ঐভাবে পোশাক ব্যবহারের জন্য সামরিক আইনে প্ৰথমে তার জরিমানা হয়। কিন্তু পরে যুদ্ধজয়ের জন্য তিনি হাজার টাকা পুরস্কার পান। সেই থেকে তিনি জেনারেল বা জাদরেল কালু ঘোষ নামে আখ্যাত হন।
কালীচরণ ঘোষ২ (? – ৩০.১.১৯৭৩) পালপাড়া, চন্দননগর। উদয়চাঁদ। দুর্গাদাস শেঠের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হন। ‘স্বদেশী বাজার’ পত্রিকায় প্ৰবন্ধাদি লিখতেন। তার একটি প্রবন্ধ রাজদ্রোহমূলক বিবেচিত হওয়ায় সম্পাদক দুৰ্গাদাস শেঠ ও প্রকাশক রামেশ্বর দে ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। তারই চেষ্টায় চন্দননগরে যুব সমিতি স্থাপিত হয়। এই সমিতির অভ্যুদয়ে চন্দননগরে বৈষম্যমূলক নির্বাচন-নীতি নাকচ হয় ও পৌর নির্বাচনে যুব সমিতির সভ্যগণ জয়ী হন। ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও সমিতির যোগ ছিল। ১৯৩০ খ্রী. লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে মেদিনীপুরে গ্রেপ্তার হন ও এক বছর কারারুদ্ধ থাকেন। পরে চন্দননগরে এসে ‘স্ফুলিঙ্গ’ পত্রিকা প্ৰকাশ করেন। কয়েকটি সংখ্যা প্ৰকাশের পর সরকার তা বন্ধ করে দেয়। তখন তিনি বিপ্লবী দল গঠনের উদ্দেশ্যে মেদিনীপুরে যান। কিছুদিন পরে গ্রেপ্তার হন এবং বিনা বিচারে রাজবন্দী হিসাবে দীর্ঘদিন দেউলী, হিজলী ও বক্স ক্যাম্পে আটক থাকেন। এসময়ে পুস্তকাদি পাঠ করে তিনি সাম্যবাদের দিকে আকৃষ্ট হন। ১৯৩৭ খ্রী. মুক্তি পাবার পর হুগলী জেলা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৩৯ খ্রী. ঐ পার্টি বে-আইনী ঘোষিত হলে কয়েক মাস জেলে আটক থাকেন। পরে তার উপর নিষেধাজ্ঞা প্ৰত্যাহৃত হলে হুগলী জেলার গ্রামে গ্রামে পার্টি-সংগঠনে উদ্যোগী হন। ১৯৪৪ খ্ৰী. ফরাসী ভারতের মুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পণ্ডিচেরীতে একটি কেন্দ্ৰ স্থাপন করেন। ১৯৪৮ খ্রী. পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে গোপন আবাস থেকে গ্রেপ্তার হন। এ সময়ে জেলে যক্ষ্ণারোগে আক্রান্ত হন। তার একটি ফুসফুস বাদ দিতে হয়। চন্দননগর মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের প্রথম বোর্ডে তিনি কাউন্সিলার নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৭ খ্রী. পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সভ্য ছিলেন।
কালীচরণ ঘোষ৩ (২৩.৬.১৮৯৫ – ২৫.১২.১৯৮৪) হরিনাভি, কোদালিয়া-চব্বিশ পরগনা। শ্যামাচরণ। অতিশৈশবে পিতৃহারা হয়ে আদর্শবান, দেশপ্রেমিক জ্যেষ্ঠতাত উমাচরণের কাছে প্ৰতিপালিত হন। হরিণাভি ইঙ্গ-সংস্কৃত উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯১৩ খ্রী. ম্যাট্রিক ও পরে বি-এ, বি-এল পাশ করে ইংরেজীতে এম.এ পড়ার সময় রাজনীতি ও সমাজসেবার কাজে বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়ে পরীক্ষা পাশ করা হয়ে ওঠেনি। প্রখ্যাত চিকিৎসক ও শিল্পপতি ডাঃ কাৰ্তিকচন্দ্ৰ বসু প্রতিষ্ঠিত বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠান ‘স্বাস্থ্য-ধর্ম-সঙ্ঘ’-এর সর্বক্ষণের সম্পাদক হিসাবে দক্ষিণ-চব্বিশ পরগনার অনুশীলন সমিতির সভ্যদের নিয়ে দীর্ঘদিন নিজ হাতে চাষ-আবাদ, তাঁত ও বিভিন্ন কুটীর শিল্প পরিচালনা করা ছাড়াও উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্ৰী বাজারে বসে বিক্রি করতেন। ‘স্বাস্থ্য সমাচার’ ও ‘Health and Happiness’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের পদে কাজ করেছেন। আইন ব্যবসাতে থাকাকালে ‘ফরোয়ার্ড’ এবং ‘বাংলার কথা’ পত্রিকাদুটিতে রাজনৈতিক মামলার রিপোর্ট লিখতেন। দমনমূলক আইন নিয়ে তার রচনা ‘দি ল্যলেস ল্যজ’ ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও আলোড়ন তুলেছিল। এরপর তিনি আইন ব্যবসা ছেড়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০-৫৫ খ্রী. আনন্দবাজার পত্রিকার বাণিজ্য বিভাগের সম্পাদনা করেছেন। কলিকাতা মিউনিসিপ্যাল মিউজিয়মের কিউরেটর ছিলেন। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ ইনফরমেশন অফিসর নিয়োগ করেন। ‘মডার্ন রিভিউ’ ও ‘প্রবাসী’র নিয়মিত লেখক ছিলেন। ভারতবর্ষ ও বসুধারায় গবেষণামূলক প্ৰবন্ধ লিখতেন। চারিখণ্ডে লেখা তার ‘ভারতের পণ্য’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তার ‘ফেমিনস অব বেঙ্গল’ (১৭৭০ – ১৯৪৩) প্রামাণ্য গ্ৰন্থরূপে সমাদৃত। জাতীয় আন্দোলনের শহীদদের প্রামান্য জীবনকথা ও কর্মোদ্যম-সমন্বিত গ্রন্থ ‘দ্য রোল অব অনার’ নানা ভাষায় অনুদিত হয়ে তাকে বিপুল খ্যাতি দিয়েছে। ‘ফুট প্রিন্টস অব দ্য ফ্রিডম ফাইটার’ এবং বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস ‘জাগরণ ও বিস্ফোরণ’ (২ খণ্ড) তার অপর দুখানি মূল্যবান গ্ৰন্থ। নেতাজীর আত্মজীবনী ‘ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ রচনাকালে তাকে তিনি অনেক ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্ৰহ করে দিয়েছেন। তিনি পল্লীসংস্কার, সমবায় আন্দোলন, নারীর অধিকার রক্ষণ, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রভৃতি কাজেও বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন।
Leave a Reply