উদয়শঙ্কর (১৯০০—২৬.৯.১৯৭৭) কালিয়াগ্রাম–যশোহর। উদয়পুরে ঝালোয়ার রাজার দেওয়ান শ্যামশঙ্কর। উদয়শঙ্করের জন্ম উদয়পুরে। স্কুলের শিক্ষা কখনও কালিয়াতে, কখনও মাতামহের নিবাসস্থল গাজীপুরে, কখনও কাশীর বাঙ্গালীটোলা হাই স্কুলে। বোম্বাই-এর জে. জে. আর্ট স্কুলে কিছুদিন থাকার পর ১৯১৯ খ্রী. লণ্ডনের রয়েল কলেজ অব আর্টসে ভর্তি হন। সেখানকার পাঁচ বছরের কোর্স তিন বছরেই সমাপ্ত করে এ.আর.সি.এ. ডিগ্ৰী এবং কম্পোজিশনে ডিপ্লোমা ও প্রাইজ পান। ‘প্রিক্স রোমা’ নামে সর্বোচ্চ বৃত্তিলাভ করেন। ঐ সময়ে লণ্ডন আট কলেজের অধ্যক্ষ রোটেনস্টাইনের মাধ্যমে বিখ্যাত রুশ নৃত্যশিল্পী আনা পাভলোভার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তার অনুরোধে ভারতীয় বিষয়ের দুটি নৃত্য ‘হিন্দু বিবাহ’ ও ‘রাধাকৃষ্ণ নৃত্য’ রচনা করেন ও আনা পাভলোভার সঙ্গে নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন এবং এভাবে নৃত্যশিল্পী-জীবনের পালা শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে রয়েল অপেরা হাউসে, কভেন্ট গার্ডেনে ও সমস্ত অভিজাত প্রেক্ষাগহে তার নৃত্যকলা প্ৰদৰ্শন করতে থাকেন। আনা পাভলোভা তাকে পশ্চিমী নৃত্যকলা অনুসরণ না করে প্রাচ্যের শিল্পকলা ও সংস্কৃতিকে নৃত্যের মাধ্যমে দেখাতে অনুপ্রাণিত করেন। তাছাড়া সুইডিস মহিলা-শিল্পী (ভাস্কর্য ও চিত্র) এলিস বোনারও ভারতীয় নৃত্যের ঐতিহ্যের দিকে তাঁর দৃষ্টি খুলে দেন। তাঁর সঙ্গেই ভারতের কাশ্মীর থেকে মালাবার হিলস পর্যন্ত ভ্ৰমণ করার ফলে নিজের দেশের জীবনধারা ও নৃত্যকলার সঙ্গে পরিচিত হন। ত্ৰিশের দশকে ইউরোপ সফরে মিস বোনারই তার নৃত্য-প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতেন। ১৯২২ খ্ৰী. লণ্ডনের জেমস পার্কে অনুষ্ঠিত একটি ‘সাহায্য-রজনী’-তে তার ‘অসিনৃত্য’ দেখে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ব্যক্তিগতভাবে তাকে অভিনন্দন জানান। নৃত্যকলায় রীতিমত শিক্ষা তিনি কখনই পাননি। কৈশোরে ও যৌবনে দেখা গ্ৰাম্য ও দেশীয় নৃত্যগুলি তার বিভিন্ন নাচের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। ভারতের ক্ল্যাসিকাল নৃত্যকে বিভিন্ন আঙ্গিকে ভেঙ্গেচুরে নতুন নতুন ভাবে সৃষ্টি করেছেন। গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রি তাঁর অনুরোধে কথাকলি আঙ্গিকে ‘কার্তিকেয় নৃত্য’ রচনা করে দেন। কোন বিশেষ আঙ্গিকেই বন্ধনেই তাঁর নৃত্যকলা সীমিত ছিল না। ইউরোপে তার নৃত্য-সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিলেন ফরাসী নৃত্যশিল্পী সিমকী, অনুজ রবিশঙ্কর, ভগিনী কনকলতা, পিতৃব্য ভবানীশঙ্কর ও আত্মীয় রাজেন্দ্ৰশঙ্কর। তাদের নিয়ে ১৯৩১-৩৩ খ্রী. ইউরোপ ও আমেরিকায় নৃত্য প্ৰদৰ্শন করেছেন। প্ৰায় ১১ বছর পরে তার শিল্পিদলকে নিয়ে ভারতে আসেন। প্ৰযোজক হরেন। ঘোষ তার নাচের অনুষ্ঠানগুলির ব্যবস্থা করতেন। এ-সময়কার বিখ্যাত নাচগুলির মধ্যে ‘অসিনৃত্য, ‘কার্তিকেয় নৃত্’’, ‘নটরাজ’, ‘হরপার্বতী’ নৃত্য উল্লেখযোগ্য। এসব নাচ তিনি একক বা সিমকীর সঙ্গে নেচে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। তার নৃত্যসম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগ দেন তখনকার বিখ্যাত শিল্পীরা, যেমন, তিমিরবরণ, শচীন দেববর্মণ, কৃষ্ণচন্দ্ৰ দে, আলাউদ্দীন খাঁ ও আলি আকবর খাঁ। ১৯৩৩ খ্রী. রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে বিশ্বভারতীতে তাঁর সম্প্রদায় নিয়ে ইন্দ্ৰ নৃত্যাদি প্রদর্শন করে কবির আশীৰ্বাদধন্য হন। ১৯৩৯ খ্রী. আলমোড়াতে ‘উদয়শঙ্কর কালচার সেন্টার’ স্থাপন করেন। সেখানে নৃত্য, সঙ্গীত ও নাট্রের অনুশীলনও হত। অর্থাভাবে ও অন্যান্য কারণে কয়েক বছর পরে কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। এখানেই বিখ্যাত ব্যালে ‘Rhythm of Life’, ‘Labour and Machine’-এর সৃষ্টি হয়। ১৯৪২ খ্রী. দলের অন্যতম নৃত্যশিল্পী অমলা নদীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। এর পর রামায়ণ অবলম্বন করে ‘রামলীলা’ ছায়ানাট্য দেখান। ১৯৪৭ খ্রী. ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্ৰ দেশবাসীকে উপহার দেন। ভারতীয় নৃত্যকলাই এর উপজীব্য। ব্রাসেলস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এটি শ্রেষ্ঠ কাহিনী-চিত্রের স্বীকৃতি ও সম্মান পায়। রবীন্দ্ৰ শতবার্ষিকী উৎসবের সময় ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটি অবলম্বন করে এবং ১৯৬৬ খ্রী. রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’ অবলম্বনে ‘প্রকৃতি ও আনন্দ’ নামে দুটি বিশিষ্ট নৃত্যনাট্য উপস্থিত করেন। ১৯৬৮ খ্রী. শেষবার পুরানো ও নূতন শিল্পীদের নিয়ে দু’মাসের জন্য কানাডা ও মার্কিন সফরে যান। শেষের দিকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে সানডিয়াগোতে অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৯-৭০ খ্ৰী. আবার নূতন সৃষ্টির পরিচয় দেন সিনেমা মঞ্চাভিনয় নৃত্য মিলিয়ে ‘শঙ্করস্কাপ’-এ। পরে তার বাড়িতে ‘উদয়শঙ্কর সেন্টার অব ড্যান্স’ প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্ৰ ভারতীর শুরু থেকেই তার নৃত্যশাখার ‘উন’ হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ খ্রী. ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মবিভুষণ’ ও ১৯৭৬ খ্ৰী. বিশ্বভারতী ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সঙ্গীত-নাটক আকাদেমির ফেলো ও আকাশবাণীতে ‘প্রডিউসার অ্যামেরিটাস’ নিযুক্ত ছিলেন।
পূর্ববর্তী:
« উদয়নাচাৰ্য ভাদুড়ী
« উদয়নাচাৰ্য ভাদুড়ী
পরবর্তী:
উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী »
উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী »
Leave a Reply