আলাউদ্দীন খাঁ (৮-১০-১৮৬২ – ৬-৯-১৯৭২) শিবপুর-ত্রিপুরা। সদু খাঁ। সঙ্গীত-জগতের প্রতিভাধর পুরুষ-’সেনী ঘরানার সঙ্গীতসুধা যা রাজদরবারে আবদ্ধ ছিল, তার বন্ধনমুক্তি ঘটিয়ে তিনিই তাকে সাধারণের কাছে নিয়ে আসেন। শৈশবেই সেতারী পিতার কাছে সেতার শেখেন। যাত্রার সঙ্গীতে আকর্ষণ বোধ করতেন। জারী, সারি, বাউল, ভাটিয়ালী প্রভৃতি গীত ও বাঙলার কীর্তন, পীরের পাঁচালী-জাতীয় ধর্ম-সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি সুরজগতের সঙ্গে পরিচিত হন। একদিন এই সুরের আকর্ষণেই বরিশালের ‘নাগ-দত্ত সিং যাত্ৰাদলের সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। ঘুরতে ঘুরতে কলিকাতায় হাজির হন। সঙ্গীতশিক্ষা-মানসে এখানে প্ৰায় ভিক্ষা করে জীবন কাটান। পরিচয়হীন বালক গান গেয়ে পাথুরিয়াঘাটার শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে মুগ্ধ করলেন। তাঁরই ব্যবস্থাপনায় গোপালচন্দ্র চক্রবর্তীর (নুলো গোপাল) কাছে গানের তালিম নিতে থাকেন। গলা সাধার সঙ্গে সঙ্গে মৃদঙ্গ ও তবলা বাজনাও শিখতে থাকেন। ৭ বছর পর ১৯০৩ খ্রী. গোপালচন্দ্রের মৃত্যুর পর ‘ষ্টার থিয়েটারে’র সঙ্গীত-পরিচালক হাবু দত্তের সংস্পর্শে আসেন। এখানে তিনি বেহালা ও বংশীবাদনে খ্যাত হন এবং তবলা ও পাখোয়াজে দক্ষতা লাভ করেন। এ সময়ে মির্নাভা থিয়েটারে তবলাবাদকের কাজ পান। নাট্যকার অভিনেতা গিরিশচন্দ্র থিয়েটারে তাঁর নাম বদলে রাখেন প্রসন্ন বিশ্বাস। মেছোবাজারের হাজারী ওস্তাদকে সন্তুষ্ট করে তাঁর কাছে সানাইয়ের তালিম নেন এবং অনেক বাধাবিপত্তি কাটিয়ে ফোর্ট উইলিয়মের ব্যান্ডের বেহালাবাদক লবো সাহেবের কাছে বেহালা শেখেন। ঘর থেকে বেরুবার ৯ বছর পর একদিন বড় ভাই বংশীবাদক আফতাবউদ্দীন তাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ৯ বছরের মদনমঞ্জরীর সঙ্গে বিবাহ হয়। বিয়ের রাত্রে ঘুমন্ত নববধূর যৌতুকের টাকার পুঁটুলীটি নিয়ে ঘর ছেড়ে কলিকাতায় এসে একটি বেহালা ও একটি ক্ল্যারিওনেট কেনেন। একবেলা আহার — ছাতুবাবুর বাজারের লঙ্গরখানায়। পরে ময়মনসিংহের জমিদার মুক্তাগাছার রাজা জগৎকিশোর তাকে নিজ সভায় নিয়ে যান। এখানে ওস্তাদ আহমেদ আলী খানের কাছে সরোদ শেখেন। যদিও খা-সাহেব নিজের ঘরানার বাজনা শেখালেন না-শুনে শুনে তিনি গুরুর অবর্তমানে অভ্যাস করতে থাকেন। আহমেদ আলী তাঁকে নিয়ে রামগড়ে ফেরেন। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা আলমকে (ছোটবেলায় কলিকাতায় কেউ তার নাম জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘আমার মাথাটা বড় কিনা, তাই সবাই আমাকে আলম বলে ডাকে) আহমেদ আলীর ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। তা সত্ত্বেও গুরু হঠাৎ তার সরোদ বাজনা শুনে বংশের জিনিস অন্যের হাতে চলে যাচ্ছে দেখে তাকে সেখান থেকে বিদায় দেন। উল্লেখ্য, তিনি সহজাত প্রতিভায় সরোদে ‘দিরি দিরি সুরক্ষেপণের পরিবর্তে ‘দারা দারা’ সুরক্ষেপণের প্রয়োগ। করেন-যা আগে ছিল অপ্রচলিত রীতি। নিরাশ্রয় অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই ঘটনাচক্ৰে এক নাইটক্লাবের ব্যান্ড মাস্টারের চাকরি পান, কিন্তু বেশিদিন সেখানে থাকতে পারেন নি। এরপর রামপুরের নবাব হামিদ আলি খাঁর কাছে বহুকষ্টে আর্জি নিয়ে দাঁড়ালেন — নবাবের গুরু তানসেনের বংশধর ভারত–বিখ্যাত উজীর খ্যার কাছে বীণা শিখবেন। নবাবের অনুরোধে। উজীর খাঁ বীণা নয়, সরোদ শেখাতে রাজী হয়ে তাঁর হাতে নাড়া বেঁধে সত্য করালেন–বিদ্যা কুপাত্রে দেব না, কুসঙ্গে যাব না, বিদ্যা ভাঙ্গিয়ে ভিক্ষা করব না, বাঈজী বারাঙ্গনাদের সঙ্গীত শেখাব না। নবাব বলেছিলেন, ‘এ বিদ্যা অর্থের বিনিময়ে কেউ উজীর খাঁর কাছ থেকে। পাবে না, খিদমৎ করে আদায় করতে হবে’। তিনি খিদমৎ করতে থাকেন। তার একাগ্ৰতা দেখে উজীর খাঁর শিষ্য মহম্মদ হুসেন খাঁ তাকে বীণা শেখাতে শুরু করলেন। আড়াই বছর পরে উজীর খ্যার নজরে এলেন তিনি। শুরু হল সাধনা। ১২ বছর পর গুরু জানালেন, তার শিক্ষা সমাপ্ত-এখন দেশভ্রমণ। কলিকাতার, শ্যামলাল ক্ষেত্রীর উদ্যোগে মধ্যপ্রদেশের মাইহারের রাজা ব্ৰজনাথ সিং-এর দরবারে যান। রাজা তার শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করেন। কিন্তু তিনি গুরুদক্ষিণা নিতে রাজী হননি। সঙ্গীতবিদ্যা অর্জনের জন্য নিজে তিনি সারাজীবন কষ্ট করেছেন। তাই বলতেন, সত্যিকারের শিখতে যে চাইবে তাকে তিনি অমনিই শেখাবেন। রাজা তাকে তার দেবোত্তর সম্পত্তির ম্যানেজার করে দেন। এতদিনে দেশ থেকে স্ত্রীকে নিয়ে এসে মাইহারে সংসার পাতালেন।। এরপর একদিন রামপুর থেকে উজীর খাঁ তাকে ডেকে পাঠিয়ে জানালেন-পুত্র পিয়ার মিঞার মৃত্যুতে এখন তাঁকেই তিনি সব বিদ্যা দিয়ে যেতে চান। আরও তিন বছর বেঁচে ছিলেন উজীর খাঁ। গুরুর মৃত্যুর পর তিনি মাইহারে ফিরে আসেন। সেনী ঘরানার সঙ্গীতধারাকে তিনি এবার সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে এলেন। টেড়া পিটিয়ে অনাথ, অন্ধ, নামগোত্রহীন এক শ’ জনকে জড় করলেন সঙ্গীত শিক্ষা দিতে। তার বাড়ী হল দীনদরিদ্রের লঙ্গরখানা। উদ্ভাবন করলেন নতুন নতুন যন্ত্ৰ-মনোহরা,। চন্দ্রসারং, কাষ্ঠতরঙ্গ প্রভৃতি। তবলার তালিম দেন এক অন্ধকে। নিরক্ষার দরিদ্র লোক নিয়ে তৈরী করলেন ভারতখ্যাত ‘মাইহার ব্যান্ড’। ভারতীয় যন্ত্রসঙ্গীতের প্রতিটি ধারাতেই তার সৃজনশীল হাতের স্পর্শ লেগেছে।। উজীর ধার কাছে থাকার সময় একবার গুরুভাইদের হাসিমস্করার জবাবে জানিয়েছিলেন, যা তাঁরা ডান হাতে বাজান তা তিনি বাঁ হাতে বাজাতে পারেন। সত্যিই বাঁ হাতে ঘুরিয়ে ধরলেন। সেই থেকে তারের যন্ত্র বাজাতেন বাঁ হাতে আর ডান হাতে বাজাতেন চামড়ার বাদ্য। গৌরীপুরের জমিদার বীরেন্দ্ৰকিশোর আচার্য ধুরীর আমন্ত্রণে কিছুদিন গৌরীপুরে বাস করে তাকে রুশৃঙ্গার শেখান। তার আগ্রহে কিছুদিন তিনি পণ্ডিচেরীর আশ্রমেও ছিলেন। শ্ৰীঅরবিন্দ তার সরোদবাদন শুনে তাকে সঙ্গীতের মাধ্যমে ঈশ্বরলাভের কজন বিশিষ্ট সাধক মনে করেন। ১৯৩৫ খ্ৰী. নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে ইউরোপ ভ্ৰমণে যান। ১৯৫২ শ্ৰী হিন্দুস্থানী যন্ত্রসঙ্গীতের জন্য সঙ্গীত আকাদেমী পুরস্কার পান। ১৯৫৪ খ্রী. আকাদেমীর ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ খ্রী. খাঁ-সাহেব ‘পদ্মভূষণ’ এবং ১৯৬১ খ্রী. বিশ্বভারতী কর্তৃক ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন। সঙ্গীতাচার্যের অসংখ্য শিষ্যের মধ্যে উল্লেখ্য তার পুত্ৰ আলি আকবর ও কন্যা অন্নপূর্ণা এবং জামাতা রবিশঙ্কর। এ ছাড়া বংশীবাদক পান্নালাল ঘোষ, সঙ্গীত—পরিচালক তিমিবরণ ও তাঁর পুত্ৰ ইন্দ্ৰনীল, সেতারে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বেহালায় শিশিরকণা, শরণারানী ও রবীন ঘোষ খা-সাহেবের শিক্ষণপ্রতিভার উজ্জ্বল নিদর্শন। বেরিলীর পীর সাহেবের প্রভাবে তিনি যোগ, প্ৰাণায়াম ও শেখেন। বংশীবাদক আফতাবউদ্দীন খাঁ এবং সুরবাহারবাদক আয়েত আলী খাঁ (১৮৮৩–১৯৬৭) তাঁর দুই ভ্রাতা। মাইহারে ‘সারদেশ্বরী মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করে নিত্য পূজাৰ্চনা ও ধ্যান করতেন।
Leave a Reply