গাজীউল হক (১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৯ – ১৭ই জুন, ২০০৯) ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মওলানা সিরাজুল হক ছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। গাজীউল হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় মক্তবে। এরপর কাশিপুর স্কুল। ১৯৪১ সালে গাজীউল হক বগুড়া জেলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
বগুড়া জেলা স্কুল থেকেই তিনি ১৯৪৬ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমানে এসএসসি) পাস করে আইএতে ভর্তি হন বগুড়া আজিজুল হক কলেজে। সেখানে অধ্যক্ষ ভাষাবিজ্ঞানী ড· মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সংস্পর্শে আসেন গাজীউল। আন্দোলনমুখর কলেজজীবনেও তিনি তারকা নম্বর নিয়ে আইএ পাস করেন। এবার চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইতিহাস বিভাগে স্মাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থী হিসেবে।
১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছর কুষ্টিয়ায় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯৪৮ সালে পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি হন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৯৪৮ সালে। ঢাকায় এসেই নানা রকম প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে আবার ভর্তি হন আইন বিভাগে। তবে এ সময় তাঁকে আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়। পরে অবশ্য ছাত্রদের সংগ্রামের মুখে বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়। ১৯৫৩ সাল থেকে আড়াই বছর কারাগারে থাকার সময় তিনি রমেশ শীল, মুনীর চৌধুরী, অজিত গুহ, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখের সান্নিধ্যে আসেন।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যে সভা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার সভাপতি ছিলেন গাজীউল হক। একুশ নিয়ে তাঁর লেখা ‘ভুলব না, ভুলব না, ভুলব না এই একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ গান দিয়েই প্রথম দিকে প্রভাতফেরি হতো।
ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোয় গাজীউল হক বগুড়ায় থেকেই ১১ দফা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মাত্র ২৭ জন যুবক নিয়ে গাজীউল হক পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন। সঙ্গে পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের জওয়ানরাও যোগ দেন। এপ্রিলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র জয়বাংলা পত্রিকার বিক্রয় বিভাগের দায়িত্বসহ আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে রণাঙ্গনের সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন।
১৭ই জুন, ২০০৯ বুধবার বিকেল পাঁচটায় তিনি তাঁর পূর্ব হাজিপাড়ার বাসায় মারা যান। তিনি ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভুগছিলেন। গাজীউল হক সুপ্রিম কোর্টে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত থেকে আজীবন বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি বগুড়াতেই আইন ব্যবসা করতেন।
পুরস্কার-সম্মাননাঃ
গাজীউল হক বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০০০ সালে তিনি একুশে পদক পান। এ ছাড়া ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ‘জাহানারা ইমাম পদক’, শেরেবাংলা জাতীয় পুরস্কার, বাংলা একাডেমীর সম্মানসূচক ফেলো, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সম্মাননা, তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে মাতৃভাষা পদক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
Leave a Reply