বিজন ভট্টাচার্য (১৭-৭-১৯১৫ – ১৯-১-১৯৭৮) খানখানাপুর—ফরিদপুর। ক্ষীরোদবিহারী। বাংলা নাট্যমঞ্চের খ্যাতনামা ব্যক্তি, সুঅভিনেতা। শিক্ষক পিতার আদর্শ জীবনযাত্রা, সাহিত্য ও সঙ্গীতগ্ৰীতি এবং শেকসপীয়র-চর্চার প্রভাব তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। পিতারসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে থাকার সময় গ্রামের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নানা দিকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। সমস্ত অঞ্চলের যাত্রা, কথকতা ও মেলায় গিয়ে অংশ গ্ৰহণ করতেন। ফলে আঞ্চলিক কথ্য ভাষার সঙ্গেও কিশোরকাল থেকেই তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটেছিল। পরবর্তী জীবনে তাঁর নাটকগুলিতে এসব অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। ১৯৩০ খ্রী. থেকে কলিকাতায় প্ৰথমে আশুতোষ কলেজে ও পরে রিপন কলেজে পড়েন। ১৯৩১–৩২ খ্রী. শরীরচর্চার সঙ্গে জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেন ও মহিষবাথানে লবণ সত্যাগ্ৰহ আন্দোলনে অংশ গ্ৰহণ করেন। বি.এ. পড়ায় ছেদ পড়লেও ১৯৩৪–৩৫ খ্রী. ছাত্র আন্দোলনের উৎসাহী কর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৩৮–৩৯ খ্রী. আলোচনা, ফিচার ও স্কেচ লিখতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতে মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার প্রতিষ্ঠিত ‘অরণি’ পত্রিকায় যোগ দিয়ে গল্প ও অন্যান্য বিষয়ে লিখতে থাকেন। ‘আগামী চক্র’ সাহিত্যবাসরেও বহু সাহিত্যিক ও লেখকের সঙ্গে পরিচিত হন। রেবতী বর্মণের সাম্যবাদ-সম্পর্কিত বইগুলির প্রভাবে কমিউনিস্ট মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৪২ খ্রী. কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সর্বক্ষণের কর্মী হন। অনিয়মিত জীবনযাত্রা ও অযত্নে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন। ১৯৪২ খ্ৰী. একদিকে চলে ‘ভারত-ছাড়’ আন্দোলন ও ‘জনযুদ্ধ’ নীতির প্রচার, অন্যদিকে হয় ফ্যাসীবিরোধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘ স্থাপন এবং সেখান থেকে প্ৰগতি লেখক সঙ্ঘ ও ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ (আইপিটিএ-) গঠন। এর সবগুলির সঙ্গেই তিনি জড়িত ছিলেন। তাঁর প্রথম নাটক ‘আগুন’ ১৯৪৩ খ্রী. নাট্যভারতীতে অভিনীত হয়। বিনয় ঘোষের ‘ল্যাবরেটরি’ গ্রন্থের নাট্যরূপ দিয়ে তিনি অভিনয় করেন। এরপর ‘অরণি’তে প্ৰকাশিত হয় তাঁর ‘জবানবন্দী’ নাটক। বিয়াল্লিশের দুর্ভিক্ষের ও মন্বন্তরের পরিপ্রেক্ষিতে লেখেন ‘নবান্ন’ নাটক। ১৯৪৪ খ্রী. আইপিটি-এ অভিনীত ঐ নাটকে প্রধানের ভূমিকায় অভিনয় করেন। বাঙলাদেশে ও অন্যান্য প্রদেশেও নাটকটির অভিনয় হয়। নিজে গান জানতেন এবং সুরও দিতে পারতেন সহজে। মানুষের বেদনা ও সামগ্রিক জীবনকে তিনি প্ৰকাশ করতে পেরেছেন বিভিন্ন পটভূমিকায় লেখা নাটকে। ১৯৪৩ খ্রী. লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়, তবে তা স্থায়ী হয়নি। ১৯৪৬ খ্ৰী. দাঙ্গার পটভূমিকায় ‘জীয়নকন্যা’ লেখেন। স্বরচিত ‘মরাচাঁদ’ নাটকে পবন বাউলের ভূমিকায় গান গেয়ে জনসাধারণের সংগ্রামকে উদ্দীপিত করেছেন। ১৯৪৮ খ্রী. মতান্তর হওয়াতে ‘গণনাট্য সঙ্ঘ’ ছেড়ে জীবিকার তাগিদে বোম্বাই গিয়ে কয়েকটি ফিল্মে অভিনয় করেন ও স্ক্রিপট লেখেন। ১৯৫০ খ্রী. কলিকাতায় ফিরে ‘ক্যালকাটা থিয়েটার গ্রুপ’ সংগঠিত করে। ২০ বছর ধরে বিভিন্ন নাটক লিখে, অভিনয় করে ও শিক্ষা দিয়ে তা পরিচালনা করেছেন। জোতদারের বিরুদ্ধে কৃষকদের সম্মিলিত প্রতিরোধ ও অসুরদলনী দেবীর মর্ত্যে আগমন-এই গ্ৰাম্য বিশ্বাসের পটভূমিকায় লেখা তাঁর ‘দেবীগর্জন’ নাটক গ্রামে খুবই উৎসাহের সঞ্চার করেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা ‘কলঙ্ক’ নাটক। দেশবিভাগের দরুণ বাস্তুচু্যত শিক্ষকের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘গোত্রান্তর’। অন্যান্য নাটক : ‘ছায়াপথ’, ‘মাস্টারমশাই’, ‘ধর্মগোলা’, ‘জননেতা’, ‘হাঁসখালির হাঁস’ প্রভৃতি। ১৯৭০ খ্ৰী. ‘ক্যালকাটা থিয়েটার গ্রুপ’ ছেড়ে ‘কবচকুণ্ডল’ নামে নাট্যপ্রতিষ্ঠান তৈরি করে শেষ দিন অবধি সেখানেই ছিলেন। এ সময় তাঁর লেখা ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘আজ বসন্ত’, ‘স্বর্ণকুম্ভ’, ‘সোনার বাংলা’, ‘চলো সাগরে’—প্রায় সবগুলি স্টেজে অভিনীত হয়েছে। শেষের দিকের নাটকগুলিতে মার্ক্সীয় দর্শনের সঙ্গে লোকায়ত ধর্ম, হিন্দুধর্ম ও দর্শন জড়িয়ে গেছে—এজন্য সমালোচনাও কম হয়নি। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘তথাপি’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবৰ্ণরেখা’, ‘পদাতিক’, ‘স্বপ্ন নিয়ে’, ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। ‘রাজদ্ৰোহ’ ও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নাটকে মঞ্চাভিনয় করেছেন। স্ক্রিপট লিখেছেন ‘নাগিন’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘বসু পরিবার’, ‘তৃষ্ণা’, ‘ডাক্তারবাবু’ ইত্যাদির। তেভাগা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘জনপদ’ ও দেশবিভাগের পটভূমিকায় ‘রাণী পালঙ্ক’ তাঁর লেখা গল্প-দুটি উল্লেখ্য। দেরিতে হলেও কেন্দ্রীয় সঙ্গীত নাটক একাডেমি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য একাডেমি এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরস্কার ও মানপত্র পেয়েছেন। তাঁর স্বপ্ন ও কল্পনা ছিল নাটকে গ্রামের সমস্যাবহুল জীবনের কথা গ্রামের লোকদের দিয়ে অভিনয় করবেন। চালচলনে নিজে কিছুটা অগোছালো ও এলোমেলো ছিলেন। তবে সর্বদাই সংগ্ৰামী জনসাধারণের সঙ্গে থেকেছেন। আর্থিক কষ্টকে গ্রাহ্য করেন নি।
Leave a Reply