অনিল করঞ্জাই (জন্ম জুন ২৭, ১৯৪০ – মৃত্যু মার্চ ১৮, ২০০১) ভারতবর্ষের একজন খ্যাতনামা বাঙালি চিত্রশিল্পী যিনি হাংরি আন্দোলন এর মাধ্যমে বাংলায় প্রথম পোস্টার কবিতার প্রচলন করেন ।
জীবনী
অনিল করঞ্জাই অবিভক্ত বঙ্গের রংপুরে (বর্তমান বাংলাদেশ০ জন্মগ্রহণ করেন । রংপুরে মৃত্তিকার পাড়ায় শৈশব অতিবাহিত করায় তিনি মাটির মূর্তি গড়ায় ছোটবেলা থেকেই আগ্রহী হন । দেশভাগের ফলে ১৯৪৭ সালে তঁদের পরিবার ভারতবর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে জীবিকার সন্ধানে ঘোরাঘুরির পর বেনারসের বাঙালিটোলায় থিতু হয় । অত্যধিক দারিদ্রের কারণে ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি আনুষ্ঠানিক পড়াশুনা ছেড়ে ১৯৫৬ সালে প্রখ্যাত শিল্পী কর্ণমান সিংহের অধীনে ভারতীয় কলা কেন্দ্রে ভাস্কর্য শেখার বৃত্তি নিয়ে ১৯৫৯ পর্যন্ত ছাত্র ছিলেন । কিন্তু ক্রমশ তিনি ছবি আঁকায় আগ্রহী হন এবং ১৯৬০ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারত কলা ভবনে মিনিয়েচার পেইনটিঙ শেখার ক্লাসে ভর্তি হন । বেনারসে ছিত্রশিল্পী করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, এবং আরও কয়েকজন চিত্রশিল্পীর সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘গেরিলা পেইনটার্স’ নামে একটি গোষ্ঙী গড়ে তোলেন । বাঙালিটোলায় তাঁদের স্টুডিওর পত্তন হয় এবং স্হানীয় প্যারাডাইস কেফেকে তাঁরা চিত্র প্রদর্শনীর গ্যালারিরূপে ব্যবহার আরম্ভ করেন । তার আগে বেনারে কোনো গ্যালারি ছিল না ।
হাংরি আন্দোলন
১৯৬৩ সালে কলকাতায় অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যাবের সঙ্গে হাংরি আন্দোলন -এর স্রস্টা মলয় রায়চৌধুরীর পরিচয় হয় । হাংরি আন্দোলন এর ভাবতত্ব, কর্মকাণ্ড ও তৎসম্পর্কিত সংবাদ তাঁদের দুজনকে আকৃষ্ট করে এবং তাঁরা হাংরি আন্দোলন এ যোগ দেন । আন্দোলনের প্রয়োজনমত তাঁরা দুঃস্বপ্নময় পোস্টার ও প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন এবং তা দ্রুত সাড়া ফ্যালে । অনিলের আঁকা কবিতা পোস্টারগুলি ছিল বাংলা সাহিত্যে প্রথম কবিতা-পোস্টার । গেরিলা পেইনটার্সের স্টুডিওয় বাঙালিটোলার হিপি-তরুনী অধ্যুষিত এলাকায় হাংরি আন্দোলনকারীদের যৌনতা ও মাদকের কর্মকান্ড সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে কিম্বদন্তিতে পরিণত হয় । ১৯৬৫ সালে নেপাল সরকারের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা বাসু শশির আমন্ত্রণে আন্যান্য আন্দোলনকারীসহ অনিলও কাঠমাণ্ডু যান এবং সেখানে নিজের পেইনটিঙের প্রদর্শনী করেন । প্রদর্শনীর শেষে করুণানিধান নিজের পেইনটিঙগুলি পুড়িয়ে দেয়ায় তা সেখানের সংবাদপত্রে বিশেষ আকর্ষণীয় ব্যাপার হয়ে ওঠে । হাংরি আন্দোলন-এর ছবি আঁকা সম্পর্কিত ৪৮ নম্বর ইশতাহারটি লিখেছিলেন অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । হিন্দি ভাষায় তাঁদের দখল থাকায় ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডে হাংরি আন্দোলনকে দ্রত ছড়িয়ে দিতে তাঁরা সাহায্য করেন । এই সময় অনিল একজন মার্কিন হিপি মহিলাকে হিন্দু মতে বিবাহ করেন । ১৯৭২ সালে অনিল ললিতকলা অকাদেমি পুরস্কার পান ।
আমেরিকা
১৯৬৫ সালে মামলা – মকদ্দমার দরুন হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায় এবং বামপন্হী আন্দোলন একটি ভিন্ন মাত্রায় দেখা দিলে অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় বামপন্হী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যোগ দেন । ষাট দশকের শেষে নকশাল আন্দোলন আরম্ভ হওয়ায় তাঁরা দুজনে বৈপ্লবিক বামপন্হায় যোগ দেন; প্রশাসন তাঁদের বিরক্ত করা আরম্ভ করলে অনিল করঞ্জাই তাঁর বিদেশিনী স্ত্রীকে নিয়ে দিল্লি এবং করুণানিধান মুখোপাধ্যাব পাটনায় চলে যান । দিল্লিতেও বামপন্হী আন্দোলন জওহারলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কারণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল । প্রশাসন অনিলকে সতর্ক করলে আনিলের স্ত্রী আতঙ্কিত হন এবং আনিলকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যান । তাঁর ছবি আঁকার নূতন দরজা খুলে যাবে, এই আশায় অনিল আমেরিকা যেতে রাজি হন । কিন্তু আমেরিকায় তাঁর স্ত্রী নিজের পৈত্রিক বাসা ওয়াশিংটন ডি সি শহরে থাকার নির্ণয় নিলে অনিল মুষড়ে পড়েন । তাঁর স্ত্রী ওয়াশিংটন ডি সিতে ভালো চাকরি পাবার দরুন তাঁদের জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়ে ওঠে বটে তবে তা আনিলের পক্ষে সুখকর হয়নি । ওয়াশিংটন ডি সি শিল্পীদের শহর নয় । নিউ ইয়র্কে গিয়ে থাকার জন্য ওয়াশিংটন ডি সিতে অনিল কয়েকটি প্রদর্শনী করেন কিন্তু দারিদ্র ও দঃস্বপ্নময় তৈলচিত্রগুলি বেশি দাম পায় না । স্ত্রীকে বিবাহবিচ্ছেদ দিয়ে অনিল ভারতবর্ষে ফিরে আসেন ।
নূতন উদ্যম
ভারতবর্ষে ফিরে আসার পর অনিল করঞ্জাই পুনরায় বামপন্হী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যোগ দেন এবং সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে ব্রিটিশ গবেষক জুলিয়েট রেনোল্ডসের পরিচয় হয় । তাঁরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ না হলেও একত্রে থাকতেন । আনিলকে নূতন উদ্যমে জীবন্ত করে তোলেন জুলিয়েট; সে সম্পর্ক তাঁদের আজীবন ছিল ।জুলিয়েটের সংস্পর্শে অনিলের ছবিগুলি বিক্রয়যোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছিল ।অনিল যখন দেশে ফিরলেন তখন করুণানিধান মুখোপাধ্যায় পাটনা থেকে দিল্লিতে চলে এসেছিলেন । অনিলের মৃত্যুর পর অনিলের কাজের সংরক্ষণ এবং অনিল সম্পর্কে গবেষণার কাজ চালিয়ে গেছেন জুলিয়েট । অনিল দেশে ফেরার পর বামপন্হী সাংস্কৃতিক আন্দোলন তৃণমূল স্তর পর্যন্ত শিকড় বিস্তার করে ফেলেছিল; অনিল ও জুলিয়েট ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেতেন এবং ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের লৌকিক ছবি আঁকার শৈলীর সঙ্গে পরিচিত হতেন । এই অভি্ঞ্জতা বিপুল পরিবর্তন এনেছিল আনিলের ছবি আঁকায় এবং লেখায় । শ্রীমতী রেনোল্ডস ছিলেন ভারতীয় ভাস্কর্য বিষেশজ্ঞ ।
পুরস্কার
১৯৭২ সালে ললিতকলা অকাদেমি পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কারে সন্মানিত ।
—————————-
সূত্রঃ ৪
Leave a Reply