অশ্বিনীকুমার দত্ত (২৫.১.১৮৫৬ – ৭.১১.১৯২৩) বাটাজোড়—বরিশাল। ব্রজমোহন। সাবজজ পিতার কর্মস্থল পটুয়াখালিতে জন্ম। বরিশালের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা। তাঁরই জীবনব্যাপী লোকসেবা ও দেশসেবার ফলে বরিশাল এক সময়ে স্বদেশী আন্দোলনের কেন্দ্ৰস্থল ও পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল। ১৮৭০ খ্রী. রংপুর থেকে প্রবেশিকা, ১৮৭৮ খ্ৰী. কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে বি-এ, ১৮৭৯ খ্রী. এম.এ, বি-এল–পাশ করে সাত মাসের জন্য শ্ৰীরামপুর চাতরা ইংরেজী বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত ছিলেন। পরের বছর ওকালতি করার জন্য বরিশালে আসেন। কলিকাতায় রাজনারায়ণ বসুর প্রভাবে ব্ৰাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ১৮৮২ খ্রী. বরিশালে ব্ৰাহ্মসমাজের সদস্যপদ গ্ৰহণ করেন। ওকালতি ত্যাগ করে বরিশালের তদানীন্তন ম্যাজিষ্ট্রেট স্থাপন করেন (২৭-৬-১৮৮৪)। ১৮৮৫ খ্রী. বরিশাল মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের কমিশনার নিযুক্ত হন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য পিপল্স্ অ্যাসোসিয়েশন স্থাপন করেন ও জাতীয় কংগ্রেসের অনুমোদন লাভ করেন (১৮৮৬)। এই বছরই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নিকট দীক্ষা নেন। তার চেষ্টায় বাখরগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড স্থাপিত হয় (১৮৮৭)। স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে বাখরগঞ্জ হিতৈষিণী সভা’ এবং বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন (১৮৮৭)। বাঙলার প্রতিনিধি দলের সদস্যরূপে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে যোগ দেন। ১৮৮৮ খ্রী. বরিশাল মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৮৮৯ খ্রী. ব্ৰজমোহন কলেজ স্থাপন করে। পঁচিশ বছর সেখানে বিনা বেতনে কাজ করেন। ১৮৯৮ খ্রী. কলেজটি প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত হয়। ব্ৰজমোহন স্কুল ও কলেজ কেবল ছাত্রদের লেখাপড়া ও ব্যক্তিগত চরিত্রগঠনের দিক দিয়েই আদর্শ। স্থাপন করে নি, অশ্বিনীকুমার তার যাবতীয় সৎকর্মের সঙ্গে ব্ৰজমোহন বিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের যুক্ত করেছিলেন। বিদ্যালয়ের মূলমন্ত্র ছিল ‘সত্য প্রেম পবিত্রতা’। যে-কোনও সর্বজনীন কাজে তিনি এক ডাকে শত শত স্বেচ্ছাসেবক একত্রিত করতে পারতেন। স্বদেশগ্ৰীতি ও স্বদেশী ভাবের অনুশীলন ছাত্রদের শিক্ষার আবশ্যিক অঙ্গ বলে মনে করতেন। ‘স্বদেশী’তে এবং ‘বিদেশী বয়কটের ব্যাপারে বরিশালের কৃতিত্ব যে সারা ভারতবর্ষে সর্বাগ্রগণ্য হয়েছিল, তার কারণ বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের অনেক আগে থেকেই বরিশালে তিনি স্বদেশী প্রচার ও জনসাধারণের মধ্যে কাজ আরম্ভ করেছিলেন এবং সে সময় তীর মত প্রকৃত অর্থে জননায়ক বিরল ছিল। ১৮৯৭-৯৮ খ্রী. সরকারী বার্ষিক শিক্ষাবিবরণীতে ব্ৰজমোহন বিদ্যালয় সম্বন্ধে মন্তব্য ছিল ‘The school is unrivalled in point of discipline and effeciency. It is an institution that Ought to serve as a model to all Schools, government and private’. এই সরকারই স্বদেশী আন্দোলনের কালে এই বিদ্যালয়কে পিষে মারার চেষ্টায় ব্ৰজমোহন স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা পরীক্ষায় বৃত্তিলাভের যোগ্য নম্বর পেয়ে পাশ করলেও সরকারী বৃত্তি তাদের দেওয়া হল না। দৃষ্টান্ত-দেবপ্রসাদ ঘোষ প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েও বৃত্তি থেকে বঞ্চিত হন; মধুসূদন সরকার তৃতীয় স্থান অধিকার করেও বৃত্তি পান নি। ১৮৯৭ খ্রী. তিনি বরিশাল মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হন। অমরাবতী কংগ্রেসে এক বক্তব্য রাখেন যে, কংগ্রেসকে শক্তিশালী করতে হলে কতিপয় ইংরেজী-শিক্ষিত ব্যক্তির বাৎসরিক তামাশা না করে গ্রামে গ্রামে সর্বসাধারণের সক্রিয় সহযোগিতা সংগ্ৰহ করা প্রয়োজন। স্বদেশী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’ ঐতিহাসিক প্ৰসিদ্ধি লাভ করেছিল। ১৯০৮ খ্রী. সমিতি ও তার শাখাগুলিকে সরকার যখন বে-আইনী ঘোষণা করে, সেই সময়ে সমিতির ১৭৫টি শাখা ছিল। পরের বছর বরিশালে ‘প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতি’র অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নিযুক্ত হন। এই অধিবেশনে আইন অমান্য করা হয়। এটি রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রথম সত্যাগ্ৰহ আন্দোলন। পুলিস লাঠিচার্জ করলে নেতৃস্থানীয়রা আহত হন। এই বছরই কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশনে তিনি অভ্যর্থনা সমিতির অন্যতম সম্পাদক হন এবং কুখ্যাত বরিশাল দুর্ভিক্ষে অতুলনীয় সেবা-কাজ করেন। ১৯০৭ খ্ৰী. সুরাট কংগ্রেস পণ্ড হবার পর তিনি নরম ও চরমপন্থীদের ঐক্যের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। ১৯০৮ খ্রী. রাজনৈতিক নেতারূপে গ্রেপ্তার হয়ে লক্ষ্মেী জেলে আটক ছিলেন। এই সময় থেকে সরকারী রোষ ব্ৰজমোহন স্কুল ও কলেজের ওপর পড়ে। সরকারের নানারকম নিপীড়নের জন্য শিক্ষালয়-দুটির অবস্থা ক্ৰমেই অবনতির দিকে যায়। ১৯১০ খ্রী. কারামুক্তির পর শিক্ষালয়-দুটির অবনতি রোধের জন্য ১৯১১ খ্রী। তিনি সরকারী সাহায্য গ্ৰহণ করেন। পরের বছর কলেজ ও স্কুল পৃথক করে কলেজ-পরিচালনা ট্রাস্টি কাউন্সিলের হাতে দিতে বাধ্য হন। ১৯১৩ খ্রী. ঢাকায় প্ৰাদেশিক রাষ্ট্ৰীয় সমিতির অধিবেশনে সভাপতি হন এবং ১৯১৮ খ্রী. কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে যোগদান করেন। বরিশাল ঝড়ের বছর (১৯১৯) আর্তব্ৰাণে তার স্মরণীয় ভূমিকা ছিল। ১৯২১ খ্ৰী. বরিশাল প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হন এবং এই বছরই কংগ্রেসের কলিকতা অধিবেশনে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাবে সক্রিয় সমর্থন জানান। জাতীয় বিদ্যালয়ে পরিণত হয় (১৯২১)। এই বছর মহাত্মা গান্ধী প্ৰথম বরিশালে এসে জেলার অদ্বিতীয় নেতা অশ্বিনীকুমারকে শ্রদ্ধা জানান। ১৯২২ খ্রী. আসামের চা-বাগানের কুলিদের প্রতি অত্যাচারের প্ৰতিবাদে আসাম-বাংলা রেলপথ ও স্টীমার কোম্পানীর ধর্মঘটে অসুস্থ অবস্থায়ও বরিশাল সমিতির সভাপতিত্ব করেন। তার রচিত পুস্তক : ‘ভক্তিযোগ’, ‘কর্মযোগ’, ‘প্রেম’, ‘দুর্গোৎসবতত্ত্ব’, ‘আত্মপ্রতিষ্ঠা’ ও ‘ভারতগীতি’। স্থাপিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান : ‘লিটুল ব্রাদার্স অফ দি পুওর’, ‘ব্যাণ্ড অফ হোপস’, ‘ব্যাণ্ড অফ মার্সি’। মুদী দোকানদার যজ্ঞেশ্বর অশ্বিনীকুমারের প্রেরণায় চারণকবি মুকুন্দদাস নামে খ্যাত হয়েছিলেন। বরিশালের স্বভাবকবি হেমচন্দ্ৰকেও তিনি স্বদেশী সঙ্গীত রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন।
পূর্ববর্তী:
« অশ্বিনীকুমার চট্টোপাধ্যায়
« অশ্বিনীকুমার চট্টোপাধ্যায়
পরবর্তী:
অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় »
অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় »
Leave a Reply