অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই আগস্ট, ১৮৭১- ৫ই ডিসেম্বর, ১৯৫১) জোড়াসাঁকো-কলিকাতা। গুণেন্দ্রনাথ। প্ৰিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রথম ভারতীয় চিত্রশিল্পী। শিক্ষা-প্রধানত ঠাকুরবাড়ির প্রথানুযায়ী গৃহশিক্ষকের কাছে। কিছুদিন সংস্কৃত কলেজেও পড়েছিলেন। ইংরেজী, ফরাসী, সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যে দখল ছিল। কিছুদিন সঙ্গীতচর্চাও করেছিলেন। ঠাকুরবাড়িতে শিল্পচর্চা ছিল শিক্ষার অঙ্গ। জ্যেষ্ঠ গগনেন্দ্রনাথ, কনিষ্ঠা সুনয়নী দেবী স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। ইটালিয়ান গিলার্ডি ও ইংরেজ পামার-এর কাছে প্যাস্টেল, জল রং, তেল রং ও প্রতিকৃতি অঙ্কন পাশ্চাত্য রীতিতে শিক্ষা করেন। কিন্তু এই রীতিতে চিত্রাঙ্কন করে পরিতৃপ্ত হননি। শুরু হয় ভারতীয় চিত্রাঙ্কন-রীতি পুনরুদ্ধারের সাধনা। কলিকাতাস্থ আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ হ্যাভেল সাহেব উৎসাহ দিলেন এবং অনেক চেষ্টায় তাকে রাজী করালেন কলেজের উপাধ্যক্ষ হতে (১৮৯৮)। ভারতীয় রীতিতে আঁকা প্ৰথম চিত্রাবলী কৃষ্ণলীলা-বিষয়ক। বজমুকুট, ঋতুসংহার, বুদ্ধ ও সুজাতা প্রভৃতি চিত্রে ভারতীয় আঙ্গিক অনুকরণের চেষ্টা পরিস্ফুট। টাইকান নামক জাপানী শিল্পীর কাছে জাপানী অঙ্কন-রীতি শিক্ষা করেন। টাইকানও অবনীন্দ্রনাথের নিকট ভারতীয় রীতি শিক্ষা করেন। পরবর্তী ওমর চিত্রাবলীতে এই শিক্ষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অচিরে ভারতীয় শিল্পের নবজন্মদাতারূপে স্বীকৃতি লাভ করেন। পরবর্তী যুগের বহু বিখ্যাত শিল্পী এই সময়ে তার শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করেন ও পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে ব্যাপক করে তোলেন। ১৯২০ ও ১৯৩০ খ্রী. তার শিল্পীরীতি নূতনতর পর্যায়ে বিকশিত হয়। শেষ-জীবনে ‘কাটুম-কুটুম’ নামে পরিচিত আকারনিষ্ঠ বিমূর্তরূপ-সৃষ্টি তার পরিণত শিল্পী মনের অভিব্যক্তি। হ্যাভেল সাহেব অবসর নেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও আর্ট কলেজ পরিত্যাগ করেন। ভগিনী নিবেদিতা, স্যার জন্য উডরফ, হ্যাভেল প্রমুখ সুধী ব্যক্তিরা উদ্যোগী হয়ে তার শিল্পাদর্শ জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ‘ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটি’ স্থাপন করেন (১৯০৭)। ১৯১১ খ্রী. দিল্লী দরবার উপলক্ষে কলিকাতা অনুষ্ঠানের মণ্ডপ অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুবর্তীদের সাহায্যে সজ্জিত হয়। ১৯১৩ খ্রী. লন্ডনে ও প্যারিসে শিল্পী ও তার শিষ্যদের চিত্ৰ-প্ৰদৰ্শনী হয়। ভারতের বাইরে দ্বিতীয় প্ৰদৰ্শনী হয়। জাপানে ১৯১৯ খ্রী.। স্যার আশুতোষের আগ্রহে ১৯২১ খ্রী. তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ৰথম বাগেশ্বরী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৪২ খ্রী. বিশ্বভারতীর আচাৰ্য-পদ গ্ৰহণ করেন। শিল্পীর দ্বিতীয় পরিচয় লেখক-রূপে। ছোট ও বড়দের উপযোগী বহু কাহিনী ও প্ৰবন্ধ রচনা করেন। গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয় নি এমন আরও অনেক রচনা বিভিন্ন পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। বিষয়বস্তু, ভাষাশৈলী ও রসসঞ্চারে এইসব রচনা বহুবিচিত্র। রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘রাজকাহিনী’, ‘ভারত-শিল্পের ষড়ঙ্গ’, ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্ৰবন্ধাবলী’, ‘ভারত-শিল্প’ ও ‘শিল্পায়ন’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শ্রুতি-লেখিকার সাহায্যে বর্ণিত তাঁর গ্রন্থদ্বয় ‘ঘরোয়া’ ও ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’। শিল্পীর বিখ্যাত চিত্রাবলীর কয়েকটির নাম—সাহাজাদপুর দৃশ্যাবলী, আরব্যোপন্যাসের গল্প, কবিকঙ্কণ চণ্ডী। বিখ্যাত একক চিত্র-প্রত্যাবর্তন, জারনিস এন্ড, সাজাহান প্রভৃতি। একসময়ে তিনি বহু বিচিত্র রকমের মুখোশের পরিকল্পনাও রচনা করেছিলেন।
পূর্ববর্তী:
« অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়
« অবনীনাথ মুখোপাধ্যায়
পরবর্তী:
অবনীন্দ্রনাথ বসু ঠাকুর »
অবনীন্দ্রনাথ বসু ঠাকুর »
Leave a Reply