বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮) ছিলেন বাংলার সেন রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা। কুলজি গ্রন্থসমূহ থেকে জানা যায় যে, বিজয় সেনের পুত্র এবং উত্তরসূরি বল্লাল সেন বাংলায় সামাজিক সংস্কার, বিশেষ করে কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তনকারী হিসেবে পরিচিত।
বল্লাল সেনের সময়কার দুটি লিপি-প্রমাণ (নৈহাটি তাম্রশাসন এবং সনোকার মূর্তিলিপি) এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলিতে বল্লাল সেনের বিজয় সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই। অবশ্য তাঁর কিছু সামরিক কৃতিত্ব ছিল বলে মনে হয়। অদ্ভুতসাগর গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, গৌড়ের রাজার সঙ্গে বল্লাল সেন যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন। এই গৌড়রাজকে পাল বংশের রাজা গোবিন্দপালের সঙ্গে অভিন্ন বলে শনাক্ত করা হয়। আনন্দভট্টের বল্লালচরিতে (১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত) এ তথ্যের দৃঢ় সমর্থন পাওয়া যায়। এমনও হতে পারে যে, বল্লাল সেন মগধে পালদের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানেন। অদ্ভুতসাগর গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, পিতা বিজয় সেনের শাসনকালে বল্লাল সেন মিথিলা জয় করেছিল। এটি মোটেই অসম্ভব নয় যে, বল্লাল সেন পিতা বিজয় সেনের মিথিলা অভিযানের সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন। অবশ্য সেন সাম্রাজ্যে মিথিলার অন্তর্ভুক্তি সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায় না এবং বিজয় সেনের প্রতিপক্ষ নান্যদেবের উত্তরাধিকারিগণ দীর্ঘকাল ব্যাপী মিথিলা শাসন করেন।
এটি বিশ্বাস করা হয় যে, কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে বল্লাল সেন সামাজিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন করেন। কুলগ্রন্থ বা কুলজিশাস্ত্রসমূহ হচ্ছে কৌলীন্য প্রথার আদি ইতিহাস সম্পর্কে জানার মূল উত্স। অধিকন্ত বল্লাল সেনের সময়কালের পাঁচ-ছয়শত বছর পরে রচিত এসকল গ্রন্থ অসামণ্জ্ঞস্যতায় পূর্ণ এবং এগুলি নানা ধরনের পরস্পর বিরোধী তথ্য ধারণ করে আছে। সুতরাং এসকল গ্রন্থে লিপিবদ্ধ তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এছাড়া কোন সেন-লিপি-প্রমাণেও কৌলীন্য প্রথার উল্লেখ নেই। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় কৌলীন্য প্রথার বহুল প্রচলন দেখা যায় এবং এ প্রথার উদ্যোক্তা বাঙালি ব্রাহ্মণগণ নিজেদের দাবি জোরদার করার উদ্দেশ্যে একে ঐতিহাসিক ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে বিগত হিন্দু শাসনকালে অর্থাত্ সেনযুগের রাজা বল্লাল সেনের সময় থেকে এ প্রথার উত্পত্তি হয়েছে, এমন মতবাদ পণ্ডিতরা প্রচার করেছেন।
সেনদের লিপি-প্রমাণ এবং কিংবদন্তি থেকে এটি প্রমাণিত যে, বল্লাল সেন ছিলেন একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ও প্রসিদ্ধ লেখক। ১১৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দানসাগর রচনা করেন। ১১৬৯ খ্রিষ্টাব্দে অদ্ভুতসাগর লেখা শুরু করলেও তা শেষ করতে পারেন নি। পিতার মতো তিনিও শিবের উপাসক ছিলেন। অন্যান্য রাজকীয় উপাধির সঙ্গে তিনি ‘অরিরাজ নিঃশঙ্ক শঙ্কর’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। চালুক্য রাজকন্যা রামদেবীকে তিনি বিবাহ করেন। এ বিবাহ আদি পুরুষদের বাসস্থানের সঙ্গে সেনদের নির্দেশ করে। অদ্ভুতসাগর গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বৃদ্ধ বয়সে বল্লাল সেন রাজ্যভার নিজ পুত্র লক্ষ্মণ সেনকে অর্পণ করেন। বল্লাল সেন জীবনের শেষ দিনগুলি সস্ত্রীকে নিয়ে ত্রিবেণীর কাছে গঙ্গাতীরবর্তী একটি স্থানে অতিবাহিত করেন। তিনি প্রায় ১৮ বছর সাফল্যের সঙ্গে রাজত্ব করেন।
সূত্রঃ ৪
Leave a Reply