মুকুন্দদাস, চারণকবি (১৮৭৮ – ১৮-৫-১৯৩৪) বানারী গ্রাম-ঢাকা। গুরুদয়াল দে। পিতৃদত্ত নাম যজ্ঞেশ্বর। তাঁর পিতামহ ছিলেন নৌকার মাঝি। পিতা বরিশালে এক ডেপুটির আদালতে কাজ করতেন। ফলে পরিবারটি বরিশালে চলে আসে। স্কুলের শিক্ষা বেশিদূর ছিল না। পিতারমুদী দোকানে বসা ও পল্লীর অশান্ত ছেলেদের নিয়ে গুণ্ডামি করা তাঁর প্রধান কাজ ছিল। বরিশালের তৎকালীন নায়েব-নাজীর বীরেশ্বর গুপ্তের কীর্তনের দলে ১৯ বছর বয়সে যোগ দেন। ক্রমে নিজেই একটি কীর্তনের দল গড়ে তোলেন। পূজা-পার্বণে বরিশালে যেসব বিখ্যাত কীর্তনীয়ার দল আসত তিনি তাদের গান শুনে টুকে রাখতেন। এইসব উপাদানে তাঁর কীৰ্তন-সঙ্গীত গ্রন্থটি সঙ্কলিত। ১৯০২ খ্রী. রাসানন্দ বা হরিবোলানন্দ নামে এক ত্যাগী সাধুর কাছে দীক্ষা নিয়ে মুকুন্দদাস নাম গ্ৰহণ করেন। মুদী দোকানের দুরন্ত যুবককে স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে চারণকবিতে পরিণত করেন বরিশালের অদ্বিতীয় নেতা অশ্বিনীকুমার দত্ত। বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষিত হলেও তাঁর সাধন-সঙ্গীতে শ্যাম ও শ্যামার অপূর্ব সমন্বয় ছিল। তিনি কোন সম্প্রদায়ভুক্ত হন নি। কালী ও রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সঙ্গে মুসলমান মালীর জন্য মসজিদের ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। কীর্তনীয়া যোগেশ পালের বৈঠকখানায় যে কীর্তনের আসর ছিল তিনি সেখানেও নিয়মিত যেতেন। তিনি নিজে গান ও যাত্রাপালা রচনা করতেন এবং ‘বরিশাল হিতৈষী’ পত্রিকায় লিখতে আরম্ভ করেন। মনোমোহন চক্রবর্তীর গানই বেশি গাইতেন। হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং অশ্বিনীকুমার দত্তের গানও করতেন। ক্রমে যাত্রাগানে সারা বরিশাল মাতিয়ে তোলেন। বিভিন্ন দেশপূজ্য নেতা এবং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর গান শুনে চমৎকৃত হন। তাঁর ‘মাতৃপূজা’ যাত্রাপালাটি যুবকদের মনে চাঞ্চল্য আনে। বিদেশী বর্জন আন্দোলনে তিনি বিশেষ ভূমিকা গ্ৰহণ করেন। গ্রামে গ্রামে দেশাত্মবোধক গান ও স্বদেশী যাত্ৰাভিনয়ের জন্য তিনি বরিশালে ইংরেজ সরকারের কোপদৃষ্টিতে পড়েন। ১৯০৮ খ্রী. ১০৮ ধারায় গ্ৰেপ্তার হয়ে জামিনে মুক্তি পান। ভবরঞ্জন মজুমদার সম্পাদিত ‘মাতৃপূজা’ গীত-সঙ্কলনে মুকুন্দ দাস-রিচিত ছিল ধানগোলা ভরা, শ্বেত ইদুরের করল। সারা’ এই সঙ্গীতের জন্য তাঁর তিন বছর কারাদণ্ড ও জরিমানা হয়। জরিমানার টাকা দিতে পৈতৃক দোকান বিক্রি হয়ে যায়। অসহযোগ আন্দোলন (১৯২২) এবং আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০) কালে তিনি তাঁর যাত্রা পালা দিয়ে জনসাধারণকে দেশপ্রেমে উদ্ধৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য রচনা : ‘সাধন সঙ্গীত’, ‘পল্লীসেবা’, ‘ব্রহ্মচারিণী’, ‘পথ’, ‘সাথী’, ‘সমাজ’, ‘কর্মক্ষেত্র’ প্রভৃতি। এই কবি সারাজীবনে ৭ শত মেডেল ও বহু পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু বাঙলার জনগণের দেওয়া ‘চারণকবি’ নামেই তিনি সবার মধ্যে বেঁচে আছেন।
পূর্ববর্তী:
« মুকুন্দ মাহাতো
« মুকুন্দ মাহাতো
পরবর্তী:
মুকুন্দদেব মুখোপাধ্যায় »
মুকুন্দদেব মুখোপাধ্যায় »
Leave a Reply