রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭-৫-১৮৬১ –- ৭-৮-১৯৪১) জোড়াসাঁকো-কলিকাতা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী এবং বিশ্ববিখ্যাত কবি। ওরিয়েন্টাল সেমিনারী, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমী, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যাশিক্ষার জন্য তাঁকে পাঠান হলেও তিনি স্কুলের পাঠ শেষ করতে পারেন নি। এজন্য পরিণত বয়সে বিভিন্ন রচনায় তিনি কখনও শিক্ষক, কখনও প্রতিষ্ঠান, কখনও পাঠ্যপুস্তককে দায়ী করেছেন। স্কুলের প্রথাগত শিক্ষা তাঁর না হলেও বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে জ্ঞানার্জনের কোন ত্রুটি ঘটেনি। শিক্ষায় সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ ঠাকুর বাড়ির পরিবেশে তিনি বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত ও অঙ্কন বিষয়েও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। কাব্য-সাধনার ক্ষেত্রে প্রথম জীবনে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং তাঁর পত্নী কাদম্বরী দেবী বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। ১৭ বছর বয়সে একবার ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তাঁকে বিলাত পাঠান হয়। কিন্তু দেড় বছর পর পিতারআদেশে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ছাপার অক্ষরে স্বনামে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ (৩০-১০-১২৮১ ব)। ১৮ বছর বয়সের মধ্যে তিনি ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’ ও ‘রুদ্রচণ্ড’ রচনা করেন। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ভুবনমোহিনী প্ৰতিভা’ তাঁর প্রথম গদ্য প্ৰবন্ধ। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ভারতী’ (১৮৭৭) ও ‘বালক’ (১৮৮৫) পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ এবং প্রথম উপন্যাস ‘করুণা’ প্ৰকাশিত হয়। বিলাতবাস কালে তাঁর রচনা ‘ভগ্নতরী’। বিলাত থেকে ফিরে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-রচিত ‘মানময়ী’তে মদনের ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করেন। এক বছর পর স্বরচিত ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ নাটকে নাম-ভূমিকায় অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৮৮২ খ্রী. ‘সারস্বত সম্মেলন’-এর সম্পাদক হন এবং এই সময়ে তিনি ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি রচনা করেন। ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ (১৮৮২) প্ৰকাশ হবার পর সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে জয়মাল্য লাভ করেন। কবির কম বয়সের রচনা নিয়ে সমালোচনার ঝড় তেমন ওঠে নি। কিন্তু পরের রচনা ‘কড়ি ও কোমল’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চোখের বালি’ প্রভৃতি প্ৰকাশিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে বাঙলার সাহিত্যক্ষেত্রে রবীন্দ্র-বিরোধী একটি সমালোচক দলের সৃষ্টি হয়। এই দলে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মত বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও ছিলেন। কম বয়সে কবি নিজেও চন্দ্ৰনাথ বসু, বঙ্কিমচন্দ্ৰ প্রভৃতিকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করেন নি। ২২ বছর বয়সে নিজেদের জমিদারী সেরেস্তার এক কর্মচারীর একাদশবর্ষীয়া কন্যা ভবতারিণীর (পরিবর্তিত নাম মৃণালিনী) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় (৯-১২-১৮৮৩)। ১৮৮৪ খ্রী. থেকে পিতারআদেশে তিনি বিষয়কর্ম পরিদর্শনে নিযুক্ত হন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারী দেখতে গিয়ে প্রকৃতির সুন্দর পরিবেশ তাঁকে অনেক রচনার প্রেরণা জুগিয়েছে। এই সূত্রে শিলাইদহ, সাহাজাদপুর কুঠিবাড়ির নাম বাঙালী পাঠকের কাছে পরিচিত হয়েছে। পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমস্যা থেকেই কবির বোলপুর ব্ৰহ্মচৰ্য আশ্রমের সৃষ্টি হয় (২২-১২-১৯০১)। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে’ রূপান্তরিত হয়েছে। ১৯০৫ খ্রী. বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব থেকে দেশের মধ্যে যে রাজনৈতিক ঝড় উঠেছিল তাতে তিনিও শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েন। এই উপলক্ষে তিনি ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ গীতটি রচনা করেন। ১৬-১০-১৯০৫ খ্রী বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে একটি শোভাযাত্রা পরিচালনা ও রাখী উৎসব প্ৰচলন করেন। পরে অবশ্য তিনি সক্রিয় ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু তাঁর জীবনে যখনই ব্রিটিশ শাসনযন্ত্র তার আক্রোশ নির্মমতার সঙ্গে প্রকাশ করেছে তখনই তিনি শক্তিমানের তীব্ৰ প্ৰতিবাদ জানিয়েছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের (১৩-৪-১৯১৯) প্ৰতিবাদে তিনি তাঁর সরকার-প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন (২৯-৪-১৯১৯)। ১৯১২ খ্রী. তিনি বিলাত যান। এই সময় বিখ্যাত ইংরেজ শিল্পী রোদেনস্টাইন কবির ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ পাঠ করে মুগ্ধ হন এবং মে সিনক্লেয়ার, এজরা পাউন্ড, ইয়েটস প্রভৃতি খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সঙ্গে এই কাব্য ও কবির পরিচয় করিয়ে দেন। নভেম্বর ১৯১২ খ্রী. গীতাঞ্জলির ইংরেজী অনুবাদ বা ’Song Offerings’ প্ৰকাশিত হয়। এরপর তিনি আমেরিকা ভ্ৰমণে গিয়ে বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা করেন। সেপ্টেম্বর ১৯১৩ খ্রী. দেশে ফেরেন। অক্টোবর ১৯১৩ খ্রী. প্রথম ভারতবাসী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট (১৯১৪) এবং সরকার স্যার (১৯১৫) উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯১৬ খ্রী দেশভ্রমণে বেরিয়ে তিনি জাপান, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা প্রভৃতি স্থানে যান। চীন নূতন প্রজাতন্ত্রী সরকারের আমন্ত্রণে ২১-৩-১৯২৪ খ্রী. চীনে গিয়েছিলেন। মুসোলিনীর আমন্ত্রণে ১৯২৬ খ্রী. ইটালীতে গিয়ে শিল্পতত্ত্ববিদ বেনেদেত্তো ক্রোচে ও ফরাসী মনীষী রোম্যা রলার সঙ্গে পরিচিত হন। সারা ইউরোপ ভ্ৰমণ ও বক্তৃতা করে ফেরার পথে কায়রো হয়ে আসেন। ১৯২৭ খ্রী. ওলন্দাজ অধ্যাপক বাকের নিমন্ত্রণে দূরপ্রাচ্য সফর করেন। শিক্ষা-বিশেষজ্ঞদের সম্মেলনে যোগদানের জন্য ১৯২৯ খ্রী. কানাডা যান। ১৯৩০ খ্রী. ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া ও পরে পারস্য ভ্ৰমণ করেন। প্যারিসে শ্ৰীমতী ওকাম্পোর অর্থানুকূল্যে এবং কঁতেস দ্য নোয়াই-এর সাহায্যে কবির ছবির প্রদর্শনী হয়। বার্লিনেও তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। সেখানে তিনি বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইনের সঙ্গে আলোচনা করেন। রাশিয়া ভ্ৰমণকালে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার সমাজ, বিশেষ করে তার শিক্ষা-ব্যবস্থা কবিকে মুগ্ধ করেছিল। ১৯৩৪ খ্ৰী কবি শেষবার সিংহল ভ্ৰমণ করেন। দেশে ও বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে তিনি যে অর্থ পেতেন তার সাহায্যে তিনি শান্তিনিকেতনের খরচ মেটাতেন। বৃদ্ধ বয়সে শান্তিনিকেতনের অর্থাভাব মেটাতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সারা ভারতে নৃত্যনাট্য দেখিয়ে অর্থসংগ্ৰহ করেছেন। কবির স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে গান্ধীজী ১৯৩৬ খ্রী. তাকে ৬০ হাজার টাকা সাহায্য করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট উপাধি দেবার জন্য ৭-৮-১৯৪০ খ্রী. শান্তিনিকেতনে সমাবর্তন উৎসব করে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রচনা-রীতিতে পরিবর্তন দেখা যায়। শেষ-বয়সের রচনা ‘পুনশ্চ’, ‘শেষ সপ্তক’, ‘শ্যামলী’ প্রভৃতি গদ্যছন্দে লেখা। ১৯৪১ খ্রী. তাঁর জন্মদিনে তিনি তাঁর বিখ্যাত রচনা সভ্যতার সঙ্কট পাঠ করেন। রবীন্দ্রনাথের একক চেষ্টায় বাংলাভাষী সকল দিকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছে। কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্ৰবন্ধ, গান প্রত্যেক বিভাগেই তাঁর অবদান অজস্র এবং অপূর্ব। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্যপ্রযোজক এবং স্বদেশপ্রেমিক। বিজ্ঞানে তাঁর অপরিসীম আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থে। বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান-সাধনায় তিনি প্রয়োজনে সাহায্য করতেন। তাঁর চিত্রাবলীর কয়েকটি অনুলিপির সংগ্ৰহ-গ্ৰন্থ প্রচলিত আছে। রচিত দুই হাজারের উপর গানের স্বরলিপি আজও প্রকাশিত হচ্ছে। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (ভারত ও বাঙলাদেশ) জাতীয় সঙ্গীত-রচয়িতারূপে একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই নাম পাওয়া যায়।
পূর্ববর্তী:
« রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
« রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
পরবর্তী:
রবীন্দ্রনারায়ণ ঘোষ »
রবীন্দ্রনারায়ণ ঘোষ »
Leave a Reply