মধুসূদন দত্ত, মাইকেল (২৫-১-১৮২৪ – ২৯-৬-১৮৭৩) সাগরদাঁড়ী-যশোহর। সদর দেওয়ানী আদালতের প্রতিষ্ঠাপন্ন উকিল রাজনারায়ণ। গ্রামে মাতা জাহ্নবী দেবীর তত্ত্বাবধানে শৈশবে শিক্ষারম্ভ হয়। সাত বছর বয়সে কলিকাতায় আসেন। এখানে প্ৰথমে দু’বছর খিদিরপুর স্কুলে পড়বার পর ১৮৩৩ খ্রী. হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। ১৮৩৪ খ্রী. কলেজের পুরস্কার বিতরণী সভায় ইংরেজী ‘নাট্য-বিষয়ক প্রস্তাব আবৃত্তি করেন। হিন্দু কলেজে ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক প্রমুখ তাঁর সহপাঠী থাকলেও মধুসূদন ‘উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক’ বলে গণ্য ছিলেন। কলেজের পরীক্ষায় বৃত্তি পেতেন। নারীশিক্ষা-বিষয়ে প্ৰবন্ধ লিখে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ে তাঁর রচিত কবিতা ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘Bengal Spectator’, ‘Literary Gleamer’, ‘Calcutta Literary Gazette’, ‘Literary Blossom’, ‘Comet’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তরুণ বয়স থেকেই বিলাত যাবার স্বপ্ন দেখতেন এবং বিশ্বাস ছিল, বিলাত গেলেই তিনি বড় কবি হতে পারবেন। এই সময়ে তাঁর পিতা তাঁর বিবাহের জন্য উদ্যোগী হন। বিবাহ এড়াতে এবং বিলাত যাবার সুযোগ পাওয়ার জন্য হিন্দু কলেজ ত্যাগ করে ৯-২-১৮৪৩ খ্রী. খ্ৰীষ্টধর্ম গ্ৰহণ করেন। এইদিন থেকে তাঁর নামের আগে ‘মাইকেল’ শব্দটি যুক্ত হয়। ধর্মান্তরের প্রায় দু’বছর পরে বিশপস কলেজে ভর্তি হন। তিন বছর গ্ৰীক, ল্যাটিন এবং সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। ১৮৪৭ খ্রী. পিতা অর্থসাহায্য বন্ধ করলে বিশপস কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন। ১৮৪৮ খ্রী. গোড়ার দিকে মাদ্রাজে গিয়ে ১৮৫৬ খ্রী. পর্যন্ত কাটান। সেখানে প্ৰথমে মাদ্রাজ মেল অরফ্যান অ্যাসাইলাম বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৮৫২–১৮৫৬ খ্রী. পর্যন্ত তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত বিদ্যালয় বিভাগের দ্বিতীয় শিক্ষক ছিলেন। মাদ্রাজ প্ৰবাসকালেই তিনি সাংবাদিক ও কবি হিসাবে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এখানে ‘Madras Circulator and General Chronicle’, ‘Athenaeum’ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত এবং ‘Spectator’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। একসময়ে তিনি ‘Athenaeum’ ও ‘Hindu Chronicle’ পত্রিকা দুটির সম্পাদকও হয়েছিলেন। মাদ্রাজে থাকা কালে ‘Timothy Penpoem’ ছদ্মনামে ‘The Captive Ladie’ এবং ‘Visions of the Past’ গ্ৰন্থ দুটি প্রকাশ করেন। এইসময় কলিকাতার গুণগ্ৰাহী বন্ধুরা তাকে মাতৃভাষায় লেখার জন্য তাগিদ দেন। তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় বিবাহ মাদ্রাজেই ঘটে যথাক্রমে রেবেকা ও হেনরিয়েটার সঙ্গে। পিতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ফেব্রুয়ারী ১৮৫৬ খ্ৰী. পত্নী হেনরিয়েটার সঙ্গে কলিকাতায় আসেন। এখানে প্ৰথমে পুলিস-কোর্টের কেরানী ও পরে দ্বিভাষিকের পদ পান। এই সময় তিনি প্ৰবন্ধ রচনা করেও অর্থোপার্জন করতেন। ১৮৬২ খ্রী কিছুদিন তিনি ‘Hindoo Patriot’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর জীবনের এই পর্ব সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল। ১৮৫৮ খ্রী. রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজী অনুবাদ করতে গিয়ে বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। তারপর একে একে ‘শৰ্মিষ্ঠা’, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘বড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’ প্রভৃতি রচনা করেন। ‘পদ্মাবতী’ নাটকেই তিনি প্ৰথম অমিত্ৰাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে বিতর্কের উত্তরে ‘তিলোত্তমাসম্ভাবকাব্য’ প্ৰণয়ন এবং ক্ৰমে ‘ব্ৰজাঙ্গনা কাব্য’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ও ‘বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেন এবং দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। ১৮৬০ খ্রী. জ্ঞাতিদের বিরুদ্ধে মামলা করে পিতৃসম্পত্তি ফিরে পান। ৯-৬-১৮৬২ খ্রী. ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য বিলাত যান। ১৮৬৫ খ্রী. তিনি ব্যারিস্টার হন। ইউরোপ প্ৰবাসকালে ইংরেজী সনেট-এর অনুসরণে বাংলায় ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ রচনা করেন। ৫৮১-১৮৬৭ খ্রী. ভারতে ফেরেন এবং বহু বাধা-বিপত্তির পর কলিকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন। যথেষ্ট অর্থগম শুরু হলেও ব্যয়বাহুল্যের জন্য ঋণগ্ৰস্ত হয়ে ব্যারিস্টারি ত্যাগ করে একাধিক চাকরি গ্ৰহণ করেন। পরিশেষে অসুস্থ হয়ে কিছুদিন উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরী গৃহে বাস করেন। স্ত্রীর মৃত্যুর ঠিক তিনদিন পরে বঙ্গের এই মহত্তম কবি কপর্দকহীন অবস্থায় জেনারেল হাসপাতালে মারা যান। কবির গ্রন্থাকারে প্রকাশিত বাংলা রচনার সংখ্যা ১২ ও ইংরেজী গ্রন্থের সংখ্যা ৫। এই মহাকবির সাধনায় বাংলা কাব্য-সাহিত্যে নবযুগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
পূর্ববর্তী:
« মধুসূদন দত্ত
« মধুসূদন দত্ত
পরবর্তী:
মধুসূদন দেব মজুমদার »
মধুসূদন দেব মজুমদার »
Leave a Reply