দেবী রায় (জন্ম আগস্ট ৪, ১৯৪০ ১৯শে শ্রাবণ), পরিবারপ্রদত্ত নাম হারাধন ধাড়া (যা তিনি হলফনামা দ্বারা ১৯৬৪ সালে পরিবর্তন করেন ), হাংরি আন্দোলন -এর জনকদের অন্যতম, এবং বাংলা আধুনিক কবিতার জগতে প্রথম নিম্নবর্গীয় কবি ।
পারিবারিক পরিচয় ও শিক্ষা
মাহিষ্য কৃষক পরিবারে জন্ম হলেও, তাঁদের কোনো চাষজমি পৈতৃক ভিটা মেদিনীপুরে ছিল না । তাঁর পিতা – মাতা দুই সন্তানসহ হাওড়া শহরে নেতাজি সুভায রোদের বস্তিতে বসবাস করতেন । পিতা – মাতা উভয়েই নানা প্রকার শ্রমজীবী কাজের মাধ্যমে দুই ছেলেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন । পড়াশুনার পাশাপাশি দেবী রায়ও বাবা – মাকে মজদুরি করে সাহায্য করতেন । স্নাতক পর্যন্ত পড়াশুনার খরচ তিনি নিজেই নানা প্রকার কাজ করে রোজগার করে ১৯৫৯ সালে বাংলায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হন । সেই বছরই ভারতীয় ডাক বিভাগে চাকরি পান এবং ছোট ভাইয়ের শিক্ষা ভার নেন । তাঁর পরিবারে তিনিই প্রথম স্কুল – কলেজে পড়া মানুষ । চাকরি পাবার পর তিনি সরকারি বিভিন্ন হিন্দী পরীক্ষায় পাশ করেন, যা তাঁকে সাহিত্য অকাদেমির অনুবাদকরূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ।
হাংরি আন্দোলন
১৯৬০ সালে ছোটগল্প পত্রিকার দপতরে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেবী রায়ের পরিচয় হয় এবং তা একটি গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয় । ১৯৬১ সালে সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও মলয় রায়চৌধুরী হাংরি আন্দোলন ঘটানোর জন্য পাটনায় যে প্রথম বৈঠকটি করেছিলেন তাতে নির্ণয় নেয়া হয় যে, প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিতব্য বুলেটিনগুলির সম্পাদনার ভার নেবেন দেবী রায় । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত যতগুলি বুলেটিন প্রকাশিত হয়েছিল, প্রতিটিতে দেবী রায়ের হাওড়াস্হিত চালাবাড়ির ঠিকানা ব্যবহৃত হয়েছে । হাংরি আন্দোলনএ যাঁরা যোগ দিতে চাইতেন তাঁরা দেবি রায়ের বস্তিবাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন । অনেক তরুণ কবি ও লেখক বস্তির ঘর দেখে শেষাবধি যোগ দিতে পারেননি, কেন না ১৯৬০ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য মোটামুটি ছিল উচ্চবিত্তের আয়ত্তে । চল্লিশের বেশি সদস্য সংখ্যা হয়ে গেলে, ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি থেকে যখন যার যেমন ইচ্ছা নিজে বুলেটিন প্রকাশের নির্ণয় নেবার পর, দেবী রায়ের কাজটি বিকেনগদ্রিত হয়ে যায় । ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত তিনি হাংরি আন্দোলনএর পত্রিকা চিহ্ণ পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন । ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ তিনি হাংরি আন্দোলন মামলায় গ্রেপতার হন, কিন্তু ১৯৬৫ সালের মে মাসে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়েছিল । কয়েকজন হাংরি আন্দোলনকারী পুলিশের সাক্ষী হয়ে যাওয়ায় দেবী রায় ান্দোলন ত্যাগ করেন । সরকারি চাকরি চলে যাবার ভয় এবং পুনরায় বাবা ও মাকে দারিদ্রে ঠেলে দেবার অতঙ্কও হাংরি আন্দোলন ত্যাগের আরেকটি কারণ । বস্তুত হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার কারণগুলির মধ্যে দেবী রায়ের আন্দোলন ত্যাগ অন্যতম ।
সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য
ড. অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত জানিয়েছেন যে, ‘দেবী রায় প্রথম থেকেই তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিত্ব গড়ে নিতে পেরেছিলেন, এবং সেকারণে হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে তাঁকে অনায়াসে চিনে নেয়া যায়’ । ড. উত্তম দাশ বলেছেন, ‘দেশে – কালে সর্বভূতে যে আন্ধকার, সেই সর্বস্ব হারানো অবস্হায় আত্মার ইরিটেশান থেকে’ দেবী রায়ের কবিতা উৎসারিত; ‘অস্তিত্বের অসহায়তায় নিমজ্জিত ব্যাক্তির মধ্যে ডুবে নিজের মানবসত্ত্বার অর্থ খঁোজায় আছে তাঁর কবিতার উদ্দেশ্য, কবিতার পরিত্রাণ; তাঁর কবিতায় আছে বন্দী আত্মার ক্রন্দন, হতাশা ,শোক,কৌমবেদনা, ক্ষোভ ও ক্রোধ ।
কবিতার আঙ্গিক
দেবী রায়ের কবিতার পংক্তিগুলি অর্ধসমাপ্ত; একটি পংক্তির সঙ্গে পরেরটি আপাতসংযোগহীন । ছন্দকে তিনি, অন্যান্য হারি আন্দোলনকারীদের মতই ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙেন; চিত্রকল্পকে নিটোল হতে দেন না । হাংরি আন্দোলনকারীরা এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন লজিকাল ক্র্যাক বা যুক্তিফাটল । দেবী রায়ের কবিতার বাক্যগুলি ক্ষোভে আকস্মিক, ক্রোধে এলোমেলো, শোকে আসংলগ্ন, হতাশায় কেন্দ্রাতিগ, গ্লানিতে ব্যাজস্তুতিময়, এবং প্রেমে ক্রমান্বয়হীন । দেবী রায় এই ক্রমহীনতাকে বলেছেন থট জাম্পিং ।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ
উন্মাদ শহর
কলকাতা ও আমি
মানুষ,মানুষ
সাম্প্রতিক তিনজন
দেবী রায়ের কবিতা
ভ্রূকুটির বিরুদ্ধে একা
এই সেই তোমার দেশ
পুতুল নাচের গান
সর্বহারা,তবু অহংকার
ভারতবর্ষ,তোমায় খুঁজছে
আগুনের গান
২১শে ফেব্রুয়ারি
নির্বাচিত কবিতা
———————
সূত্রঃ ৪
Leave a Reply