অন্নদাশঙ্কর রায় (মে ১৫, ১৯০৫ – অক্টোবর ২৮, ২০০২) ওড়িশা প্রবাসী, জন্ম ঢেঙ্কানলে। ঢেঙ্কানল রাজস্টেটের কর্মী নিমাইচরণ; মাতা কটকের প্রসিদ্ধ পালিত বংশের কন্যা হেমনলিনী। বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির শ্রদ্ধেয় প্রতিনিধি, প্রগতি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব, অবিস্মরণীয় ছড়াকার, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন, একই সঙ্গে যুগ সচেতন ও বিশ্ব নাগরিক। তিনি লিখেছিলেন ‘যুগ আমার জনক, দেশ আমার জননী’। বাল্যে ঢেঙ্কানলে তাঁর শিক্ষা শুরু। ১৯২১ খ্রি. পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কিছুদিন খবরের কাগজের সম্পাদনা শিখতে কলকাতা বসুমতী পত্রিকার সম্পাদক হেমেন্দ্ৰপ্ৰসাদ ঘোষের কাছে যান। অনুবাদ ও তার পরামর্শে শর্টহ্যান্ড টাইপরাইটিং শেখেন। প্রুফ রিডিংও শিখেছিলেন। কিন্তু তাতে মন লাগল না। কটকের র্যাভেনস কলেজ থেকে এরপর আই.এ. পরীক্ষা দিয়ে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। বি.এ. পরীক্ষাতেও ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম স্থানাধিকারী হন (১৯২৫)। এম.এ. পড়তে পড়তে আই.সি.এস. প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে দ্বিতীয়বারে পূর্ববর্তী রেকর্ড ভেঙ্গে প্রথম স্থান অধিকার করেন (১৯২৭)। ওই বছর সরকারি খরচে আই.সি.এস. হতে বিলাত যান। সেখানে দু-বছর ছিলেন। এই সময়ে তীর ধারাবাহিক ভ্ৰমণকাহিনী ‘পথে প্রবাসে’ বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্ৰবন্ধ গ্রন্থ ‘তারুণ্য’ (১৯২৮), প্রথম কবিতার বই ‘রাখী’ (১৯২৯) এবং প্রথম উপন্যাস ‘আগুন নিয়ে খেলা’ (১৯৩০)। ১৯৩০ খ্রি. মার্কিন কন্যা অ্যালিস ভার্জিনিয়া অনফোর্ডকে বিবাহ করে নাম দেন লীলা রায় (৭.৮.১৯১০–৬.১০.১৯৯২)। লীলা রায় বহু বই বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। অন্নদাশঙ্করের অনেক লেখা ‘লীলাময়’ ছদ্মনামে প্ৰকাশিত হয়েছে। তার প্রথম এপিক উপন্যাস ‘সত্যাসত্য’ (যার যেথা দেশ, অজ্ঞাতবাস, কলঙ্কবতী, দুঃখমোচন, মর্তের স্বৰ্গ)। ১৯৩৬ খ্রি. তিনি প্রথম নদীয়া জেলার ম্যাজিষ্ট্রেটরূপে কাজে যোগ দেন। তিন বছর এই পদে থেকে বিভিন্ন জেলায় কাজ করে কুমিল্লা জেলায় জজ হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৯ খ্রি. পর্যন্ত রাজকার্যে ব্যাপৃত থেকে ১৯৫০ খ্রি. তিনি পশ্চিমবঙ্গ ১৯৫১ খ্রি. স্বেচ্ছায় তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। ১৯৫২ খ্রি. দ্বিতীয়বার ইউরোপ যান। সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুদিন শান্তিনিকেতনে বসবাস করে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯৪১ খ্রি. প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সাহিত্য শাখার সভাপতি, ১৯৫৪-৫৭ খ্রি. পর্যন্ত সাহিত্য আকাডেমির জেনারেল কাউন্সিল ও একজিকিউটিভ বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৭ খ্রি. আন্তর্জাতিক পিই.এন. অধিবেশনে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে জাপান যান। লেখেন ‘জাপানে’ নামে তার জাপান ভ্ৰমণের অভিজ্ঞতা। এই বইয়ের জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। ১৯৮৬ খ্রি. পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির জন্মকাল থেকে তিনি তার সভাপতি ছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে ও তার যোগাযোগ ছিল। বাংলা ভাগ তিনি মনেপ্ৰাণে কখনও মানতে পারেননি। তাঁর বিখ্যাত ছড়া ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ কর/তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ কর–তার বেলা!’ তিনি বলতেন ‘আমি ভাগ হইনি’ আর তাই তিনি দুই বাংলায় চিরদিনের বরেণ্য। বাংলা ও ওড়িয়া দুই ভাষাতেই তার লেখনী সাবলীল ছিল—তবে শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষাতেই তিনি সাহিত্য রচনা শুরু করেন। শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্ৰন্থ ‘রত্ন ও শ্ৰীমতী’, ‘ক্রান্তদর্শী (৪ খণ্ড)’, ‘কন্যা’, ‘ফেরা’, ‘উড়কী ধানের মুড়কি’, ‘রাঙা ধানের খই’, ‘ডালিম গাছে মৌ’, ‘সাহিত্যে সংকট’, ‘আমরা’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘দেশ কাল পাত্র’, জীবন শিল্পী’, ‘লালন ফকির ও তাঁর গান’ প্রভৃতি। ৮৩ বছর বয়সে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি গ্রহণ করেন। বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ ছাড়াও বহু পুরস্কার ও সম্মান তিনি পেয়েছেন।
পূর্ববর্তী:
« অন্নদাপ্রসাদ বাগচী
« অন্নদাপ্রসাদ বাগচী
পরবর্তী:
অন্নদাসুন্দরী ঘোষ »
অন্নদাসুন্দরী ঘোষ »
Leave a Reply