শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৫-৯-১৮৭৬ –- ১৬-১-১৯৩৮) দেবানন্দপুর–হুগলী। মতিলাল। প্রখ্যাত কথাশিল্পী। তাঁর কৈশোর ও প্রথম যৌবন প্রধানত ভাগলপুরে মাতুলালয়ে কাটে। এখানে ১৮৯৪ খ্ৰী. প্ৰবেশিকা পাশ করেন। নিজের সম্বন্ধে তিনি লেখেন, ‘আমার শৈশব ও যৌবন ঘোর দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। অর্থের অভাবেই আমার শিক্ষালাভের সৌভাগ্য ঘটে নি। পিতারনিকট হতে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাই নি। পিতৃদত্ত প্ৰথম গুণটি আমাকে ঘরছাড়া করেছিল–আমি অল্পবয়সেই সারা ভারত ঘুরে এলাম। আর পিতারদ্বিতীয় গুণের ফলে জীবনভরে আমি কেবল স্বপ্ন দেখেই গেলাম। আমার পিতার পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা–এক কথায় সাহিত্যের সকল বিভাগেই তিনি হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনটাই শেষ করতে পারেন নি’। শরৎচন্দ্ৰ ১৭ বছর বয়সে গল্প লিখতে শুরু করেন। পিতারমৃত্যুর পর ভাগ্যান্বেষণে ১৯০৩ খ্রী. ব্ৰহ্মদেশ যাত্রা করার আগে অর্থে পার্জনের জন্য কিছুদিন চাকরি করলেও বেশির ভাগ সময়ই বেকার থাকেন। সাংসারিক ব্যাপারে নির্লিপ্ত ছিলেন। ভাগলপুরের প্রসিদ্ধ উকিল শিবচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্ৰ সতীশচন্দ্রের সঙ্গে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আদমপুর ক্লাবে’র সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এই ক্লাবে অনুষ্ঠিত নাটকে অভিনয় করে যথেষ্ট সুনাম পান এবং এখানেই প্ৰথম জীবনের অধিকাংশ গ্ৰন্থ রচনা করেন। রেঙ্গুনে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে কাজ করতেন। ১২/১৩ বছর প্রবাসে থাকা কালে আত্মীয়-বন্ধুর আগ্রহাতিশয্যে সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। ১৩১৯–২০ ব. ফণী পালের ‘যমুনা’ পত্রিকায় নূতন রচনা ‘রামের সুমতি’, ‘পথ-নির্দেশ’ ও ‘বিন্দুর ছেলে’ প্রকাশিত হলে চারিদিকে সাড়া পড়ে যায়। এরপর ১৩২০ – ২২ ব. ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ‘বিরাজ বৌ’, ‘পণ্ডিতমশাই’, ‘পল্লী সমাজ’ প্রভৃতি প্ৰকাশিত হলে বাংলা-সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আসন সুনির্দিষ্ট হয়। রেঙ্গুনে স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় ১৯১৬ খ্রী. কলিকাতায় আসেন। প্রথমে বাজে-শিবপুর অঞ্চলে থাকতেন। পরে ১৯১৯ খ্রী. হাওড়া জেলার পানিত্ৰাস গ্রামে বাড়ি করে বহুদিন কাটান। শেষ-জীবনে কলিকাতায় অশ্বিনী দত্ত রোডে বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। সাহিত্য-ক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথকে গুরু বলে স্বীকার করতেন। তাঁর প্রথম মুদ্রিত রচনা ‘মন্দির’ নামে গল্পটি ১৩০৯ ব. ‘কুন্তলীন পুরস্কার’ লাভ করে। তিনি বড়দিদি। অনিলা দেবীর ছদ্মনামে কয়েকটি প্ৰবন্ধ—’নারীর লেখা’, ‘নারীর মূল্য’, ‘কানাকাটা’, ও ‘গুরু-শিষ্য সংবাদ’ ১৩১৯–২০ ব. ‘যমুনা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর জীবিতকালে মুদ্রিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘বড়দিদি’ই (১৯১৩) সর্বপ্রথম। রাজনীতি বিষয়ে তাঁর বহু প্ৰবন্ধ সাময়িক পত্রিকায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছে। তিনি বাঙলার বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। হাওড়া জেলা-কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হিসাবে কিছুদিন কাজ করার পর তথাকথির রাজনৈতিক আন্দোলনের উপর বিরূপ হয়ে পদত্যাগ করেন। ‘স্বদেশ ও সাহিত্যে’র স্বদেশ বিভাগে তাঁর মাত্র কয়েকটি রাজনৈতিক প্ৰবন্ধ স্থান পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘তরুণের বিদ্রোহ’ উল্লেখযোগ্য। ১৯২৩ খ্রী. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী সুবর্ণপদক’ এবং ১৯৩৬ খ্রী. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডিলিট’ বা ‘সাহিত্যাচাৰ্য’ উপাধি পান। ১৯৩৪ খ্রী. বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য হন। রবীন্দ্রনাথ তাকে জয়মাল্য দিয়েছিলেন। রেঙ্গুনে বাসকালে চিত্রাঙ্কন করতেন। তাঁর অঙ্কিত ‘মহাশ্বেতা’ অয়েল পেন্টিং বিখ্যাত। রচিত। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ ‘শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’, ‘দত্তা’, ‘দেবদাস’, ‘শেষ প্রশ্ন’, ‘নববিধান’, ‘পথের দাবী’ প্রভৃতি। বাঙলার বিপ্লববাদীদের সমর্থক বলে তাঁর ‘পথের দাবী’ গ্রন্থটি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
পূর্ববর্তী:
« শরৎচন্দ্র গুহ
« শরৎচন্দ্র গুহ
পরবর্তী:
শরৎচন্দ্র পণ্ডিত »
শরৎচন্দ্র পণ্ডিত »
Leave a Reply