নলিনীকান্ত সরকার (২৮-৯-১৮৮৯ – ১৮-৫-১৯৮৪) কালিয়াচক-মালদহ। নিকুঞ্জবিহারী। মাতুলালয় মুর্শিদাবাদের জগতাই গ্রামে শৈশব ও কৈশোর কাটে। মাতামহ নবদ্বীপচন্দ্র নন্দী রচিত ‘তিলোত্তমা’ নাটক বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থমালা সিরিজের গ্ৰন্থরূপে সংরক্ষিত আছে। নলিনীকান্ত একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি, গায়ক, সাহিত্যবোদ্ধা ও ছন্দকুশলী ছিলেন। তবে হাসির গানের রচয়িতা ও গায়ক হিসাবেই তার বিশেষ খ্যাতি। হাসির গল্প লিখতেন। কিন্তু তার কৈশোরের প্রথম রচনা একটি আধ্যাত্মিক কবিতা ‘শ্ৰীশ্ৰী বিষ্ণুপ্রিয়া’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত (আষাঢ় ১৩২৬ বঙ্গাব্দ) ‘নিবিড়ানন্দ নকলনবীশ’ ছদ্মনামে তার ‘সাহিত্য সংস্কার’ রচনাটি যথেষ্ট সমাদার লাভ করে। তিনি ১৯২০–২৫ খ্রী. বিপ্লবী বারীন্দ্ৰকুমার ঘোষের বিজলী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৩০/৩১–৪৪ খ্রী. ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। বিচিত্ৰা’, ‘ভারতী’ ও ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকা-গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যুগান্তর পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। যুগান্তরের ‘রোজ নামতা’ চালু হলে পণ্ডিচেরি থেকে ছড়া লিখে পাঠান। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এক সাহিত্য বাসরে তাকে প্রথম ‘হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হয়। তার প্রথম বই মুর্শিদাবাদের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত ‘কাঞ্চনতলার কাপ’ ১৯১৬ খ্রী. প্রকাশিত হয়-এটি একটি ফুটবল কাপ প্রতিযোগিতার বিবরণ। তিনি যে একজন সত্যিকারের শক্তিশালী সাহিত্যিক ছিলেন সেই পরিচয় চাপা পড়েছিল তার সাঙ্গীতিক আর সাংবাদিক পরিচয়ের তলায়। সুদীর্ঘকাল তিনি তৎকালীন বাংলাদেশের সকল বয়সের সাহিত্যিকদের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এবং ভারতবর্ষ সম্পাদক জলধর সেনের তিনি ছিলেন বিশেষ স্নেহভাজন। নজরুল ছিলেন তার ছোট ভাই-এর মত। বিপদে আপদে নজরুল ইসলাম তার উপর একান্ত নির্ভর করতেন। তার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি শরৎচন্দ্ৰ পণ্ডিত বা দাদাঠাকুরের ‘জঙ্গীপুর সংবাদ’ পত্রিকায়। শরৎপণ্ডিতের জীবিত থাকা অবস্থাতেই নলিনীকান্তর লেখা ‘দাদাঠাকুর’ বইখানির চিত্ররূপ প্ৰকাশিত হয়ে চলচ্চিত্র জগতেও সাড়া জাগিয়েছিল। তাঁর অন্য দুখানি বই ‘শ্রদ্ধাস্পদেষু’ এবং ‘হাসির অন্তরালে’। সারা জীবন বহু বিখ্যাত সাহিত্যিক ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির যে স্নেহ পেয়েছিলেন, তার অতি অন্তরঙ্গ চিত্র ‘শ্রদ্ধাস্পদেষু’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে। আর ‘হাসির অন্তরালে’ যে অশ্রুর সমাবেশ, তার লেখনীর যাদুস্পর্শে তা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তার অসমাপ্ত রচনা ‘আসা যাওয়ার মাঝখানে’ (প্ৰথম খণ্ড) গ্ৰন্থাকারে প্রকাশিত। দ্বিতীয় খণ্ড ধারাবাহিকভাবে ‘কথা সাহিত্য’ মাসিক পত্রিকায় প্ৰকাশিত হচ্ছিল। এটিকে তার দীর্ঘজীবনের প্রত্যক্ষদশীর বর্ণনা বলা চলে। তাঁর ‘সুরমুকুর’ ও ‘কান্তপদলিপি’ যথাক্রমে নজরুল ও রজনীকান্তের গানের স্বরলিপি। বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। তার গাওয়া ‘মরি হায় রে কলকাতা কেবল ভুলে ভরা’ গানটি এককালে খুব জনপ্রিয় ছিল। হাসির গান গেয়ে ‘রসরাজ’ আখ্যায় ভূষিত হলেও অর্থের অভাবে অনেক সময়ই যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছেন। এক সময়ে ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, কীর্তন, বাউল ছাড়া রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, নীলকণ্ঠ, গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত প্রমুখের গানও গাইতেন। গ্রামোফোন কোম্পানীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে ১৯১৩ খ্রী. যখন তিনি বন্যার্তদের জন্য কাপড় মেলে দলবল নিয়ে স্বরচিত গান গেয়ে চাঁদা তুলে বেড়াচ্ছিলেন। সে সময়ে ৬খানা রেকর্ড হয়েছিল। ১৯২৭ খ্ৰী. কলিকাতা বেতারকেন্দ্ৰ প্ৰতিষ্ঠার শুরু থেকেই তিনি সেখানে প্ৰথমে গায়ক হিসাবে যোগ দেন। ভক্ত ও বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান তিনি শৈশব থেকেই আধ্যাত্মিকতার দিকে আকৃষ্ট ছিলেন। পরবর্তী কালে বহু সাধু মহাপুরুষের সান্নিধ্যে আসেন। গৃহীযোগী বরদাচরণ মজুমদার, যোগীবর কালিপদ গুহ রায় প্রভৃতির অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। ১৯২১ খ্রী. পণ্ডিচেরীতে তিনি প্ৰথম শ্ৰীঅরবিন্দকে দর্শন করে যোগসাধনা গ্রহণের সুযোগ পান। পরে ১৯৪৮ খ্রী. সপরিবারে পণ্ডিচেরী আশ্রমবাসী হন। সেখানেই মৃত্যু।
পূর্ববর্তী:
« নলিনীকান্ত ভট্টশালী
« নলিনীকান্ত ভট্টশালী
পরবর্তী:
নলিনীকান্ত সেন »
নলিনীকান্ত সেন »
Leave a Reply