খান আতাউর রহমান (ডিসেম্বর ১১,১৯২৮ – ডিসেম্বর ১,২০০৪) একজন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রাভিনেতা, সুরকার, গায়ক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, প্রযোজক, সংলাপ রচয়িতা, কাহিনীকার। অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন, তার মধ্যে জীবন থেকে নেয়া উল্ল্যেখযোগ্য। তার জন্মস্থান মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামে। তিনি খান আতা নামে বহুল পরিচিত।
শৈশব
তার মা তাকে আদর করে ডাকতেন “তারা”। তার মায়ের পরিবার ছিলেন মাজারের খাদিম তথা তত্ত্বাবধায়ক। ধর্মীয় উরসে তার মামা নানারকম আধ্ম্যাতিক সংগীত পরিবেশন করতেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা জিলা সংগীত প্রতিযোগীতায় খান আতা প্রথম স্থান দখল করেন।তিনি তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।
শিক্ষাজীবন
খান আতা ১৯৪৪ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশান পরীক্ষা পাশ করেন। ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দেন ঢাকা কলেজ থেকে। এরপর ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ এ। ১৯৪৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এসময় তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে তিনি পরিবারের এক সদস্যের চোখে পড়ে গেলে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই মেডিকেল ছেড়ে চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়এ ভর্তি হন। এবারো তার বোহেমিয়ান স্বভাবের কারণে তিনি সেখানে থাকলেন না।এ বছরেই তিনি লন্ডনে ফটোগ্রাফি বিষয়ক একটি বৃত্তি লাভ করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি সেখানে যাননি।১৯৪৯ সালে আবার তিনি বাড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করেন। এবারো উদ্দেশ্য ছিল একই। এবার তিনি প্রথমে মুম্বাই যান। মুম্বাই গিয়ে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন, চলচ্চিত্র জগতের আনাচে কানাচে গিয়েছেন। এসময় তিনি জ্যোতি স্টুডিওতে ক্যামেরাম্যান জাল ইরানির শিক্ষানবিশ হেসেব কিছুদিন কাজ করেন।
কর্মজীবন
১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে চলে আসেন করাচি। করাচী এসে তিনি যোগ দেন রেডিও পাকিস্তান এ সংবাদপত্র পাঠক হিসেবে। এখানেই আরেকজন প্রতিভাবান বাঙ্গালী ফতেহ্ লোহানী এর সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে।তখনো চলচিত্রের ব্যাপ্রে তার উৎসাহ কমেনি। যার কারনে তিনি প্রায় ই লাহোর যেতেন। এসময় তিনি সারঙ্গী বাদক জওহারি খানের কাছ থেকে তালিম নেয়া শুরু করেন। ফতেহ্ লোহানী কিছুদিন পরে লন্ডন চলে গেলে ১৯৫২ সালে খান আতা একটি পোল্যান্ডীয় জাহাজে করে লন্ডন পাড়ি জমান। সেখানে অনেক বাঙ্গালী অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেন গায়ক এবং অভিনেতা হিসেবে। এখানে এস এম সুলতানের সাথে তার সাক্ষাত হয়। এস এম সুলতানের চিত্রকর্মের উপকরণ যোগানে সাহায্য করেন তিনি। খানা আতা এবংতার সাথীরা এস এম সুলতানের চিত্রকর্মের প্রদর্শনী এবং বিক্রয়ের ব্যাবস্থা করেন। লন্ডনের সিটি লিটারেরি ইন্সটিটিউটে তিনি থিয়েটার ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হন। পরের বছরেই তিনি ইউনেস্কো বৃত্তি নিয়ে নেদারল্যান্ডে চলে যান। ১৯৫৫ সালে আবার লন্ডনে ফিরে এসে থিয়েটার রয়াল, ইউনিটি থিয়েটার, আরভিং থিয়েটার এসকল স্থানীয় গ্রুপের সাথে কাজ করতে থাকেন। এসময় তিনি কিছুদিন বিবিসি এর সাথেও কাজ করেছেন। ১৯৫৭ তে ফিরে আসেন ঢাকায়। এসেই তিনি পাকিস্তান অব্জারভারে চাকরি নেন। এরপর রেডিও তে যোগ দেন গীতিকার, সংগীত পরিচালক, আবৃত্তিকার এবং অভিনেতা হিসেবে।
চলচ্চিত্রে খান আতা
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি পরিচালক এ যে কারদার পরিচালিত ছবি “জাগো হুয়া সাভেরা” তে মূল ভূমিকাতে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র জীবনের সূত্রপাত হয়।এ ছবির সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। চলচ্চিত্র জগতে তিনি আনিস নাম টি ব্যবহার করতেন।তার অভিনীত প্রথম বাংলা ছবি “এদেশ তোমার আমার” মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। এহতেশামের এই চলচ্চিত্র এ দেশ তোমার আমার এ তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬০ সালে জহির রায়হানের সাথে গড়ে তোলেন লিটল সিনে সার্কেল। এর পরের বচরগুলোতে জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় তার। অভিনেতা এবং সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন কখনো আসেনি, যে নদী মরুপথে, সোনার কাজলের মতো সফল চলচ্চিত্রে।
সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক খান আতা
সূর্যস্নান ছবিতে ১৯৬২ তে তিনি উপহার দেন পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে এরমতো গান। কন্ঠ দেন কলিম শরাফি। ১৯৬৩ সালে জহির রায়হানের কাঁচের দেয়াল ছবিতে তিনি নিয়ে আসেন শ্যামল বরণ মেয়েটি শীর্ষক একটি জনপ্রিয় গান। সূর্যস্নান ছবির গীতিকার হিসেবে এবং কাঁচের দেয়াল ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবেপাকিস্তান ফিল্ম ফেস্টিভাল এ ১৯৬৫ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া সংগীত পরিচালক ছিলেন বাহানা, সাগার, আখেরি স্টেশান, মালা প্রভৃতি উর্দু ছবিতে। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হানের পরিচালনায় জীবন থেকে নেয়াতে অভিনয় করেন। এই ছবিতে তিনি ” এ খাচা ভাংবো আমি কেমন করে ” শীর্ষক গানের কথা লিখেন এবংনিজেই কন্ঠ দেন। ১৯৭১ এর মুক্তি যুদ্ধে দেশাত্মবোধক গান লিখেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য এবং চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহে সাহায্য করেন।৭০’ এবং ৮০’র দশকে উপহার দেন সাবিনা ইয়াসমীনের কন্ঠে এ কি সোনার আলোয়, শহনাজ রহমতুল্লাহের কন্ঠে এক নদী রক্ত পেরিয়ে এর মতো গান।
পরিচালক খান আতা
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর তৈরি করেন ” আবার তোরা মানুষ হ” যার বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধ পরবর্তী বাস্তবতা। ৮০’র দশকের শেষে বানান হিসাব নিকাশ এবং পরশপাথর নামের দুইটি ছবি। মুক্তিযুদ্ধের উপর ১৯৯৪ সালে তিনি এখনো অনেক রাত নামের একটি ছবি তৈরি শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে ছবির কাজ শেষ হয়। কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছবির ৭ টি স্থানে দৃশ্য কেটে ফেলার নির্দেশ দেয়ায় ক্ষুব্ধ হন তিনি।
Leave a Reply