আলমগীর কবির (Alamgir Kabir) (২৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৮ – ২০ জানুয়ারি ১৯৮৯)। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃত, বাংলাদেশের আধুনিক চলচ্চিত্রের জনক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, মুক্তিযোদ্ধা।
জন্ম
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে পিতার কর্মক্ষেত্রে। পিতা বাবা আবু সাইয়েদ আহমেদ ততকালীন পিডব্লিউডির কর্মকর্তা ছিলেন।
শিক্ষা
১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে গণিতে লেটার মার্কসহ মেট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পাস করেন আলমগীর কবির। তবে অনার্স পরীক্ষার ফল বেরোনোর আগেই ১৯৫৭ সালের শেষদিকে লন্ডন চলে যান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিকসে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে লন্ডনে থাকাকালেই তিনি Daily Worker নামে একটি বামপন্থী দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৬২-৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্রের ইতিহাস, নন্দনকলা ও নির্মাণকৌশল বিষয়ে বেশ কয়েকটি কোর্স সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন ও রাজনীতি
১৯৬৫ সালে বাম রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন আলমগীর কবির। ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে ফিলিস্তিনে গিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী যোদ্ধাদের সংস্পর্শে আসেন। একই সময়ে ততকালীন ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। এ জন্য ফরাসি সরকার তাঁকে কয়েক মাস জেলে আটকে রাখে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে East Pakistan Liberation Front -এর সঙ্গে।
১৯৬৬ সালে দেশে ফিরে তিনি চিত্রসাংবাদিকতা শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ও আধুনিক চলচ্চিত্র দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। পাশাপাশি তিনি একজন যথার্থ চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ সময় তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত হন। তাঁর শক্তিশালী ও সাহসী লেখনী ও মতামতের জন্য আইয়ুব সরকারের রোষানলে পড়ে কয়েক মাস জেল খাটেন। ১৯৬৭ সালে তিনি সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকার সিনিয়র এডিটর হিসেবে যোগদান করেন এবং ততকালীন পাকিস্তানের একমাত্র চলচ্চিত্র সংগঠন ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’-এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মতানৈক্যের কারণে ১৯৬৯ সালে নিজস্ব উদ্যোগে তিনি গড়ে তোলেন ‘ঢাকা সিনে ক্লাব’। এ বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রথম গ্রন্থ Cinema in Pakistan এবং যাত্রা শরু হয় তাঁর সম্পাদনায় সিনে জার্নাল Sequence-এর। একই বছর তিনি গড়ে তোলেন ‘ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট’ নামে এ দেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান।
একজন সমাজসচেতন ও আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে এ দেশের চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি আলমগীর কবির অসামান্য অবদান রেখেছেন তরুণসমাজকে উদ্বুদ্ধ করে এ দেশে একটি শক্তিশালী চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। এখানেই তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা, সবচেয়ে বেশি সফল। তরুণদের উজ্জীবিত করার এক মোহনীয় ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, মানজারে হাসীন মুরাদ, তারেক মাসুদ, শামীম আখতার, আখতারুজ্জামান প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধ ও চলচ্চিত্র
১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি সংবাদ পাঠক ও প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জহির রায়হান নির্মিত অবি্নরণীয় চলচ্চিত্র স্টপ জেনোসাইড-এর চিত্রনাট্য রচনা ও ধারাভাষ্যকারের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। তিনি নিজেও Liberation Fighters নামে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আলমগীর কবির শুরু করেন তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘ধীরে বহে মেঘনা’র কাজ। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত ছবিটি ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির পুরস্কার লাভ করে। তারপর তিনি একে একে নির্মাণ করেন সূর্যকন্যা (১৯৭৬), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), মোহনা (১৯৮২), মহানায়ক (১৯৮৬) ও পরিণীতা (১৯৮৪)। এ ছাড়া বেশ কিছু ভ্রামাণ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন তিনি। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন আলমগীর কবির।
মৃত্যু
১৯৮৯ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ায় একটি চলচ্চিত্র সংসদের উদ্বোধন ও আবু সাইয়ীদ নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আবর্তন’-এর একটি বিশেষ প্রদর্শনীতে আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে গেলেন আলমগীর কবির। বগুড়ায় থেকে ২০ জানুয়ারি দুপুরের পর ঢাকার পথে রওনা হন। নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। সন্ধ্যায় নগরবাড়ী ঘাটে ফেরিতে ওঠার জন্য পন্টুনের একপাশে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাত্ একটি ট্রাক ব্রেক ফেল করে সজোরে গাড়িটাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিলে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাচার্য আলমগীর কবির।
[উত্সঃ দৈনিক প্রথম আলো]
Leave a Reply