স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagdish Chandra Bose) (নভেম্বর ৩০, ১৮৫৮ – নভেম্বর ১৩, ১৯৩৭)
বাংলাদেশের একজন সফল বিজ্ঞানী। তিনিই আবিষ্কার করেন যে গাছের প্রাণ আছে।তিনি ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার রাঢ়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর।
পিতার কর্মক্ষেত্র ফরিদপুরে বাল্য-শিক্ষা শুরু হয়। পরে কলিকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ও কলেজে শিক্ষা লাভ করে ১৮৮০ খ্রী. গ্রাজুয়েট হন। কেম্ব্রিজ থেকে বিজ্ঞানে অনার্স সহ বি.এ পাস এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি পাশ করেন। দেশে ফিরে ১৮৮৫ খ্রী. প্রেসিডেন্সী কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হন। ভারতীয় ও ইংরেজদের বেতনের মধ্যে বৈষম্য থাকার কারনে তিন বছর পর্যন্ত বেতন গ্রহণে অস্বীকার করেন।
১৮৮৭ খ্রী. সমাজসংস্কারক দুর্গামহোন দাসের কন্যা অবলাকে বিয়ে করেন। জগদীশ চন্দ্রের স্ত্রী লেডী অবলা বসু ছিলেন একজন বিদূষী ডাক্তার ও শিক্ষাবিদ।অর্থকৃচ্ছ্রতার জন্য প্রথমে চন্দননগরে, পরে কলিকাতায় ভগ্নিপতি মোহিনীমোহন বসুর সঙ্গে বাস করতেন। এ সময়ে তার বেজ্ঞানিক নেশা ছিল ফটোগ্রাফী ও শব্দগ্রহণ। কলেজের এডিসনের ফোনোগ্রাফী যন্ত্রে তিনি নানারকম শব্দগ্রহণ ও পরিস্ফুটনের পরীক্ষা করতেন। ফটোগ্রাফ বিষয়ে গভীর গবেষণায় মনোনিবেশ করে বাড়ীর বাগানে একটি স্টুডিও তৈরী করেন।
৩৫ বছর বয়েসে ‘বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গ’ সম্বন্ধে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন ও পরের বছর থেকেই এ বিষয়ে নিবন্ধ প্রকাশ শুরু করেন।তার গবেষণার প্রধান দিক ছিল উদ্ভিদ ও তড়িত্ চৌম্বক। এই গবেষণা তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
- প্রথম পর্যায়ে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের বস্তুনিচয় সম্পর্কে স্ব-উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র যন্ত্রের সাহায্যে অতি ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক তরেঙ্গেও দৃশ্য আলোকের সকল ধর্ম বিদ্যমান–এই তত্ত্ব প্রমাণ করেন। এই সময়ে তিনি বিনা তারে বার্তা প্রেরণের পদ্ধতি আবিস্কার করেন। তার এই গবেষণা ইউরোপের বেতার-গবেষণার দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। সেই হিসাবে একে যুগান্তকারী আবিস্কার বলে অভিনন্দিত করা যেতে পারে।
- দ্বিতীয় পর্যায়ের গবেষণার বিষয়বস্তু তার রচিত ‘Responses in the Living and Non-Living’ গ্রন্থে (১৯০২) পাওয়া যায়। পরে এই গবেষণায় তিনি ধাতু ও উদ্ভিদ ও প্রাণীর পেশীর উপর নানা পরিক্ষা করেন এবং দেখান যে, বৈদ্যুতিক, রাসায়নিক ও যান্ত্রিক উত্তেজনায় ঐ তিন বিভিন্নজাতীয় পদার্থ একই ভাবে সাড়া দেয়। তার রচিত ‘Comparative Electrophysiology’ গ্রন্থে এইসব গবেষণার কথা লিপিবদ্ধ হয়। মানুষের স্মৃতিশক্তির যান্ত্রিক নমুনা তিনিই সম্ভবত প্রথম প্রস্তুত করেন। আধুনিক রেইড্যার যন্ত্র, ইলেকট্রনিক কম্পিউটার প্রভৃতির সৃষ্টি অংশত এই মৌলিক চিন্তার অনুসরণ করেই সম্ভব হয়েছে।
- তৃতীয় পর্যায়ের শরীরবিদ্যা-বিষয়ক গবেষণায় জড় ও প্রানীর মধ্যগত বস্তু হিসাবে উদ্ভিদের উপর প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উত্তেজনার ফলাফল সম্বন্ধে বিশদ পরিক্ষা করেন। প্রাকৃতিক উত্তেজনার মধ্যে তাপ, আলোক ও মাধ্যাকর্ষণের ফলাফল, কৃত্রিম উত্তেজনার মধ্যে বৈদ্যুতিক ও তাপীয় আঘাত–তার পর্যালোচনার বিষয় ছিল। তিনি ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে সূক্ষ্ম সঞ্চালনকে বহুগুণ বর্ধিত করে দেখান যে তথাকথিত অনুত্তেজনীয় উদ্ভিদ ও বিদ্যুতিক আঘাতে সঙ্কুচিত হয়ে সাড়া দেয়।
এইসব পরিক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উদ্ভিদের বৃদ্ধিমাপক যন্ত্র ক্রেস্কোগ্রাফ, উদ্ভিদের দেহের উত্তেজনার বেগ নিরুপক সমতল তরুলিপি যন্ত্র রিজোনাষ্ট রেকর্ডার, স্ফিগমোগ্রাফ, পোটোমিটার ও ফটোসেন্থেটিক-বাবলার প্রভৃতি স্বয়ংলেখ যন্ত্র আবিস্কার করেন। উদ্ভিদের জলশোষণ ও সালোকসংশ্লেষণ সম্বন্ধে তার বিশদ গবেষণাও উল্লেখযোগ্য ১৯১৫ খ্রী. অধ্যাপনার কাজ থেকে অবসর-গ্রহণের পর ‘বসুবিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করে (১৯১৭.১১.৩০) আমৃত্যু সেখানে গবেষণা চালান।
১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় বসুকে ডি.এস.সি উপাধি প্রদান করে। ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘নাইট’ খেতাব দেয়। ১৯১৯ সালে এভারডিন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.এস.সি দেয়। ১৯২০ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯২৬-৩০ খ্রী. লীগ অফ নেশন্সের ইন্টেলেকচুয়্যাল কো-অপেরেশন কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯২৬ সালে বেলজিয়ামের রাজা তাকে কমান্ডার অফ দি অর্ডার অব লিওপোল্ট এ ভূষিত করেন। ১৯২৭ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতি হন। ১৯২৮ খ্রী. ভিয়েনার একাডেমী অফ সায়েন্সের বৈদেশিক সদস্য এবং ১৩২৩-২৫ ব. বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভপতি ছিলেন। ১৯৩৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.এস.সি প্রদান করে।
যৌবনে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মন্দির, গুহা-মন্দির এবং প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ধ্বংসাবশেষ ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করেন ও স্থিরচিত্র গ্রহণ করেন। তার বাংলা রচনা ‘অব্যক্ত’র মধ্যে তার সৌন্দর্য-পূজারী শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বসুবিজ্ঞান মন্দিরের বিভিন্ন অংশ প্রাচীন স্থাপত্যের অনুকরণে সজ্জিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশ চন্দ্রের পরস্পরকে লিখিত পত্রাবলীতে গবেষক ও সাধক জগদীশ চন্দ্রের বিজ্ঞান-জগতে নিঃসঙ্গ পদক্ষেপের অনুরুপ কাহিনী পরিস্ফুট হয়েছে।
১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর বাংলাদেশের এ শ্রেষ্ঠ সন্তান পরলোক গমন করেন।
[উত্সঃ ১, ৪, ৫]
Leave a Reply