বিজ্ঞানের সহজপাঠ
আখতার হুসেন
অপূর্ব এই মহাবিশ্ব—এ এম হারুন-অর-রশীদ/ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী \ প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা \ ২০০ টাকা
আধুনিক বিজ্ঞানের জটিল সব বিষয়কে সহজবোধ্য ও সুখপাঠ্য করে নানা বয়সী পাঠকের পাতে পরিবেশন করার একটা সুপরিকল্পিত প্রয়াসের সূচনা লক্ষ করি আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রায় জীবনসায়াহ্নে। তার পর প্রায় এক দশকের বিরতিতে বিশ শতকের পাঁচের দশক থেকে এক্ষেত্রে আমরা একটা প্রবল জোয়ার লক্ষ করি। ১৯৩৭ সালের দিকেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর ‘বিশ্বপরিচয়’, পরবর্তীকালে যা ‘বিশ্বভারতী’র ‘লোকশিক্ষাগ্রন্থমালা’র অন্যতম প্রারম্ভিক গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। ওই গ্রন্থমালার ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘শিক্ষণীয় বিষয়মাত্রই বাংলাদেশের সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত করে দেওয়া এই অধ্যবসায়ের উদ্দেশ্য। তদনুসারে ভাষা সরল এবং যথাসম্ভব পরিভাষা বর্জিত হবে, এর প্রতি লক্ষ্য করা হয়েছে; অথচ রচনার মধ্যে বিষয়বস্তুর দৈন্য থাকবে না, সেও আমাদের চিন্তার বিষয়।…বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার।’
আমাদের আলোচ্য অপূর্ব এই মহাবিশ্ব গ্রন্থের যুগ্ম লেখক অধ্যাপক, গবেষক এ এম হারুন-অর-রশীদ এবং বিজ্ঞানের তরুণতম শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত উচ্চারণকে আদর্শ বলে মেনেছেন। তার প্রমাণ আমরা এই গ্রন্থের শুরুর দুটি অধ্যায়েই পেয়ে যাই, যেখানে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপরিচয় গ্রন্থ থেকে একাধিক উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রাসঙ্গিক বিষয়-অভিমুখে অগ্রসর হয়েছেন। ভূমিকায় তাঁরা স্পষ্টতই জানাচ্ছেন, তাঁদের এই গ্রন্থ রচনার মুখ্য প্রেরণা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপরিচয় এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ স্টিফেন হকিংয়ের এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম। এই গ্রন্থ রচনার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁরা আরও জানাচ্ছেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে অত্যাধুনিক কিছু তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা, কিছু প্রমিত ধারণা ও কিছুটা ইতিহাস বাংলায় প্রকাশ করা’, তখন তাদের লক্ষ্যের স্পষ্টতা সম্পর্কে আর কোনো সংশয় থাকে না। এবং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, গ্রন্থকারদ্বয় সেই লক্ষ্য সাধনে সফল হয়েছেন।
মোট ১২টি মূল অধ্যায়ে বিভক্ত অপূর্ব এই মহাবিশ্ব। অধ্যায়গুলো হলো আমাদের এই অপূর্ব “বিশ্বপরিচয়”, অনন্য এই মহাবিশ্ব, আমাদের বিবর্তনশীল বিশ্বের প্রতিচ্ছবি, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রকৃতি, নিউটনের বিশ্ব, বক্র মহাদেশ, আমাদের এই মহাবিশ্ব: বিগ-ব্যাং, শুরুর মাহেন্দ্রক্ষণ ও প্রসারণ, মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ, কোয়ান্টাম অভিকর্ষ, পদার্থবিজ্ঞানের একত্রীকরণ, কয়েকটি নতুন ধারণা, মানুষের টেকনো-ভবিষ্যৎ এবং শেষত পরিশিষ্ট, যেখানে পাঁচজন পথিকৃৎ বিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হয়েছে।
‘আমাদের বিবর্তনশীল বিশ্বের প্রতিচ্ছবি’ শিরোনামের অধ্যায়ে খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখকদ্বয় বিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিক বিবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরে জানিয়েছেন কীভাবে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যার সূচনা। এই অধ্যায়ের শেষাশেষি এসে তাঁরা জানাচ্ছেন, ‘আমরা অন্যসব সময়ের তুলনায় বিশ্বের বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতি বোঝার সবচেয়ে কাছে এসে পৌঁছেছি। আমরা জানি, প্রায় চৌদ্দ শ কোটি বছর আগে এই বিশ্ব এক মহাবিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা এ-ও জানি, আমাদের সূর্য একদিন তার সব জ্বালানি পুড়িয়ে বিশালভাবে স্ফীত হয়ে আমাদের পৃথিবীসহ সব গ্রহকে গ্রাস করে ফেলবে। এবং এভাবেই মৃত্যু ঘটবে তার।’ আমরা এই অধ্যায়টির পাঠে যেমন আলোকিত হই, তেমনি একটু বিষণ্নতারও শিকার হই।
এ বইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ হলো, শিরোনামচিহ্নিত অধ্যায়ের পর অধ্যায়ে আছে প্রাসঙ্গিক তত্ত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্য। তবে সেই তথ্য প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁরা জটিলতার আশ্রয় নেননি। পাঠককে ধাঁধায় পড়ার অবকাশ দেননি। সম্ভাব্য সাধ্যানুযায়ী তাঁরা প্রাসঙ্গিক খটোমটো তত্ত্ব ও তথ্য সহজ-সরলভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। যেমন, বৈজ্ঞানিক ‘তত্ত্বের প্রকৃতি’ অধ্যায়ে এ বিষয়ে তাঁরা যে আলোচনার সূচনা করেন, তার সমাধান টানেন তাঁরা এ রকমের কথা বলে যে, ‘…সত্যিই যদি একটা সম্পূর্ণ একীভূত তত্ত্ব (unified theory) থাকে, তা-হলে সেটা নির্ধারণ করাই আমাদের কাজ, অর্থাৎ ওই তত্ত্বই নির্ধারণ করবে আমাদের অন্বেষণের ফল। এই পদ্ধতি নির্ধারণ করবে যে সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে কেন পৌঁছাব? একইভাবে এটাও কি এই পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারবে না যে, আমরা ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছাব? অথবা কোনো সিদ্ধান্তে আদৌ পৌঁছাব না? এই প্রশ্নের সঙ্গত উত্তর, সম্ভাব্য উত্তর পাওয়া যেতে পারে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের নীতি থেকে।’
এই গ্রন্থের কৌতূহল-উদ্রেকী চমৎকার অধ্যায় ‘বক্র মহাকাশ’, ‘মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ’, ‘কোয়ান্টাম মহাকর্ষ’, ‘কয়েকটি নতুন ধারণা’ এবং ‘মানুষের টেকনো-ভবিষ্যৎ’। ‘কয়েকটি নতুন ধারণা’ শীর্ষক অধ্যায়ে লেখকদ্বয় তুলে ধরেছেন কোয়ান্টাম বিশ্বের বহুজাগতিক ব্যাখ্যা, আইনস্টাইন-রোজেন সেতু ও ব্রেন বিশ্ব (Brane World) তত্ত্ব সম্পর্কে আগ্রহসঞ্চারী সব বিবরণ। লেখকদ্বয় এই গ্রন্থের উপসংহার টানেন এই বলে যে, “বর্তমানের বিজ্ঞানের সাপেক্ষে আমরা যা বলতে পারি, তা হলো—দূর-ভবিষ্যতে মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে মানুষ গ্রহান্তরে পাড়ি দেওয়া শুরু করবে। তত দিনে হয়তো আন্তনাক্ষত্রিক মহাকাশযাত্রার প্রযুক্তি মানুষের করায়ত্ত হবে। সৌরজগতের সীমা ছাড়িয়ে হয়তো মানুষ ছড়িয়ে পড়বে নিকটবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জে। আর তত দিনে মানুষের একটা নবতর রূপও হয়তো বিকশিত হবে। খুব সম্ভব পরবর্তী সহস্রাব্দের বা এই সহস্রাব্দের শেষাশেষি উপরিউক্ত নাক্ষত্রিক অগ্রগতি সম্ভব হবে। তত দিনে মানুষের জৈব ও ইলেকট্রনিক জটিলতা এবং মিথস্ক্রিয়া আমূল বদলে যাবে। এ কথা ঠিক, কল্পবিজ্ঞানের ‘কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ’ বা টিভি সিরিয়াল স্টার-ট্রেক যে সমাজ চিত্রিত করে, তার থেকে চতুর্থ সহস্রাব্দের দ্বারপ্রান্তের মানবসমাজে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দিকে মৌলিক পার্থক্য আসবে—সবারই এ রকমটাই প্রত্যাশা।”
‘অপূর্ব এই মহাবিশ্ব’ বিজ্ঞানমনস্ক প্রত্যেকেরই সংগ্রহে রাখার মতো একটা উজ্জ্বল বই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৯, ২০১১
Leave a Reply