একটি বিরল গ্রন্থ
সায়ীদ আবুবকর
তোমার আকাশ তোমার বাতাস—রফিক কায়সার \ প্রকাশক: নান্দনিক \ প্রথম প্রকাশ: একুশে বইমেলা ২০১১ \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ১৬০ টাকা
সমালোচনা-সাহিত্য সাহিত্যের সবচেয়ে জটিল শাখা। দুই পয়সার পুঁজি দিয়ে এ ব্যবসা চলে না। পুঁজিপাট্টা থাকলেও সমালোচক যদি অনুদার হন কিংবা হন পক্ষপাত দোষে দুষ্ট, তাহলেও তাঁর ব্যবসা শিকেয় উঠতে বাধ্য। আমাদের দেশে সমালোচনা-সাহিত্য সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো প্রতিষ্ঠা পায়নি আজও। না পাওয়ার কারণ মূলত দুটি: এক. সাহিত্য সমালোচনায় সচরাচর যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁদের জানাশোনার সীমাবদ্ধতা অর্থাৎ যথার্থ প্রস্তুতি না নিয়ে, ব্যাপক অধ্যয়ন না করে, তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ না করে, স্রেফ আবেগ, কল্পনা ও জনশ্রুতিকে সম্বল করে তাঁদের এ রকম একটি দুরূহ কাজে নেমে পড়া। দুই. প্রায় সমালোচকের আগে থেকেই এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসা—তিনি বিশেষ কোনো লেখকের বিরুদ্ধে বলবেনই, যেহেতু ওই লেখকের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে তাঁর ঘোর বিরোধ রয়েছে, কিংবা তিনি তাঁর স্তুতিতে প্রতিটি পৃষ্ঠা ভরে ফেলবেনই, যেহেতু তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে তাঁর মতাদর্শ মিলে গেছে। ওই লেখকের সাহিত্যের দৌড় কত দূর, সেটা তাঁর কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা জীবনানন্দ দাশের ওপর যেসব গ্রন্থ এ দেশে রচিত হয়েছে, তাঁদের বড় দুর্বলতা হলো, এসবের ভেতরে স্রেফ স্তুতি ছাড়া আর কিছু নেই। আবার দু-একজন এমনও আছেন, যাঁরা তাঁদের লেখায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে কবি হিসেবে খারিজই করে দিয়েছেন।
আনন্দের কথা, রফিক কায়সারের তোমার আকাশ তোমার বাতাস এসব দিক থেকে একটি ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থ, যেখানে পাঠক পাবেন একজন লেখকের সাহিত্যিক সাফল্য ও ব্যর্থতার একটি সমান আলোচনা। রফিক কায়সার ইতিমধ্যে তাঁর কমলপুরাণ ও বাংলার মাটি বাংলার জল গ্রন্থ দুটির মাধ্যমে একজন সৎ ও শক্তিশালী সাহিত্য-সমালোচক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে পাঠকদের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তোমার আকাশ তোমার বাতাস গ্রন্থেও তাঁর মনন ও সৃজনশীলতার ধারাবাহিকতা কিছুটা বজায় রয়েছে বলা যায়, যদিও রফিক কায়সারের ভক্ত-পাঠকেরা টের পেয়ে যান যে এ গ্রন্থটির কোথায় যেন একটু ছন্দপতন ঘটে গেছে। আর তা ঘটার কারণ বোধ হয় এটাই যে এর আগের গ্রন্থ বাংলার মাটি বাংলার জল-এর প্রবন্ধগুলো যেখানে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, সেখানে তোমার আকাশ তোমার বাতাস-এর প্রবন্ধগুলো ফায়ফরমাশের লেখা। কালি ও কলম পত্রিকার প্রয়োজনে এর অধিকাংশ প্রবন্ধ রচিত হওয়ায় কিছুটা কৃত্রিমতার আভাস পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায় না। যে ধরনের সাহিত্যই হোক, স্বতঃস্ফূর্ত না হলে তা কখনো হূদয়গ্রাহী হয় না, সাহিত্য হিসেবে তা সাফল্যের মুখও দেখে না।
রফিক কায়সারের বিশেষ গুণ হলো, যে বিষয়েই তিনি লিখতে বসুন না কেন, তাঁর লেখা পাঠ করলেই বোঝা যায় তাঁর জানাশোনার পরিধি কত ব্যাপক। তিনি সাধারণত ফুট-নোট ব্যবহার করেন না; তা নিয়ে পাঠক কোনো প্রশ্নও তোলেন না, কারণ তাঁর অফুরন্ত তথ্য পাঠককে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে, তিনি বিশ্বস্ত। ছফা হোন, ইলিয়াস কি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, তিনি তাঁদের লেখালেখি, এমনকি ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও যখন কথা বলা শুরু করেন, তখন পাঠক থ হয়ে যান তাঁর বয়ান শুনে; পাঠকের মনে হতে থাকে, ইনি যেন লেখকের পরিবারেরই একজন। তিনি যেমন লেখকের শৈল্পিক সাফল্যে মৃগ্ধ হয়ে তাঁর প্রশংসা করতে কখনো কার্পণ্য করেন না, তেমনি যখন তাঁর আমলনামা মূল্যায়নে নেমে পড়েন, তখন তাঁকে তুলোধুনো করতেও পিছপা হন না একটুও। এখানেই সাহিত্য-সমালোচক হিসেবে রফিক কায়সারের সাফল্য।
মোট নয়টি প্রবন্ধ দিয়ে সাজানো হয়েছে এ গ্রন্থটি। প্রথম প্রবন্ধটি মাহমুদুল হকের ওপর। ওয়াহিদুল হক, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমান, আহমদ ছফা, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সমরেশ বসু, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রবীন্দ্রনাথ বাকি প্রবন্ধগুলোর নায়ক। সূচি দেখেই পাঠক অনুমান করে নেন, এই লেখক বিশেষ এক শ্রেণীর পাঠকের মনোতুষ্টিতে বিশেষ আগ্রহী। তবে রফিক কায়সারের বিশেষত্ব এখানে যে তিনি উল্লিখিত লেখকদের স্তুতিতে শুধু মগ্ন থাকেননি, তাঁদের কারও কারও মতাদর্শকে তিনি খণ্ডনও করেছেন। বুদ্ধদেব বসুর কাব্য-মূল্যায়ন বড্ড চুলচেরা ও যথাযথ; বোদ্ধা পাঠক রফিক কায়সারের সততা, নিষ্ঠা ও সাহসিকতার প্রশংসা না করে পারেন না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা তাঁর তোমার আকাশ তোমার বাতাস প্রবন্ধটি অসাধারণ—কী ভাষাশৈলীতে, কী বিষয়বস্তু উপস্থাপনায়। বাঙালি মুসলমান ও রবীন্দ্রনাথকে পাশাপাশি রেখে রবীন্দ্র মূল্যায়নের যে নতুন ধারা তিনি চালু করলেন এ দেশে, সে জন্য তাঁকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারা যায় না। তাঁর বিশ্লেষণ কী অন্তর্দেশস্পর্শী, তা উপলব্ধি করা যায় তাঁর এ উক্তি থেকে: ‘রবীন্দ্র-প্রতিভা এবং বাংলা ভাষায় তাঁর অবস্থানকে বাঙালি মুসলমান নৈর্ব্যক্তিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। আর পারেনি বলেই রবীন্দ্র-বিতর্কের এক পক্ষে আছে বিস্ময়জনিত মুগ্ধতা, অপরপক্ষে আছে হীনম্মন্যতাজনিত ঘোর ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনজনিত ঈর্ষা আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট কর্তৃক আক্রান্ত রবীন্দ্র-মূল্যায়নের যান্ত্রিকতা।’ (তো. আ. তো. বা. পৃ-১০৩) আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও আহমদ ছফার মধ্যে তিনি খুঁজে ফিরেছেন বাঙালি মুসলমানের পৌরুষ ও তার টানটান মেরুদণ্ড। মূলত বাঙালি মুসলমানের স্পিরিট অনুসন্ধানে রফিক কায়সারের কৃতিত্ব ইতিমধ্যে সর্বজনবিদিত; তার সাক্ষী তাঁর তিন পুরুষের রাজনীতি ও বাংলার মাটি বাংলার জল গ্রন্থ দুটি। কিন্তু তোমার আকাশ তোমার বাতাসে এসে তাঁর এ অনুসন্ধান-প্রক্রিয়াটি কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এ কারণে যে, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যাঁরা বাঙালি মুসলমানের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী, তাঁদের তিনি এড়িয়ে গেছেন কী এক অজ্ঞাত কারণে। তাঁর হয়তো ভয় ছিল অন্যখানে। একজন সাহিত্য-সমালোচককে তো সব ধরনের সংকীর্ণতা ও হীনম্মন্যতা পাড়ি দিতেই হয় সাহিত্যের যথাযথ মূল্যায়নের স্বার্থে; কে কী মনে করল, তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। রফিক কায়সারের এ গ্রন্থটি পূর্ণাঙ্গ হতে পারত যদি শাহেদ আলী, সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ এতে সূচিবদ্ধ হতেন। বইটির ছাপা ভালো, কাগজ সুন্দর, বাঁধাই মজবুত, প্রচ্ছদ চমৎকার। নান্দনিক বইটি প্রকাশ করে সময়ের দাবি পূরণ করেছে। আমি এর বহুল প্রচার কামনা করি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৯, ২০১১
Leave a Reply