ধানকাটা জমির অগভীর পানিতেও সেদিন ছিল শরতের নীল আকাশ আর সাদা মেঘের উচ্ছল ছায়া। সেই খেতের আলে দাঁড়িয়ে গিয়াস প্যান্টের মুখটা একটু টেনে ধরে। প্রথম দিন থেকেই প্যান্টটার কোনো চেইন ছিল না। ছ্যাচ্ছার শব্দে আর একটা ভাপসা গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। জলের ওপর জলের ধাক্কায় ভেঙে যায় শরতের সাদা মেঘ-আকাশের ছবি। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে থাকে জলজ দৃশ্যপট। তখন গিয়াসের মুখের সীমায় দুটো মানবিক চোখ নেচে ওঠে। কাজ শেষ করে প্যান্ট লুঙ্গির মতো দুহাতে উঁচু করে ধরে পথ হাঁটে সে। সারা মুখে অগোছালো দাড়ির ঝোপঝাড়, চড়চড়ে ঠোঁট, খালি গা। গ্রীষ্মের দুপুরের প্রচণ্ড রোদেও ঘামে না, হয়তো ঘামতে ঘামতে তার শরীরের সব নুন-জল শেষ হয়ে গেছে। পাকা রাস্তার পাশে মাত্র একটি তালগাছ, তার পাতার শাখে একটিই ছন্নছাড়া বাবুই পাখির বাসা। পাখিরা অনেক আগেই উড়ে গেছে বোঝা যায়। হয়তো মহাসড়কের কোলাহল ওদের নির্জন খড়ের গৃহে খুব বেশি জোরে বেজে উঠত। তালগাছের নিচেই মজিদের দোকান, হারিকেনের চিমনি পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত সে। খুব শখ করে দোকানে টেনে আনা ইলেকট্রিসিটির তারটিও জানে—মজিদের দোকানে ২৪ ঘণ্টায় খুব হিসাব করে কয়েকবার বিদ্যুৎ আসে। সুতরাং দেশের সব মানুষকে একঘরে করে মজিদ আবার তার বাপ-দাদার রীতিতে ফিরে যায়। হারিকেনে লোডশেডিং বলে কোনো ইংরেজি শব্দের আনাগোনা নেই, তেল পড়লেই জ্বলে, জ্বলতেই থাকে, ফুঁ দিয়ে নেভালে তবেই নেভে। হারিকেনের চিমনি পরিষ্কারের সময় গরমে কপালে ঘাম জমে কিন্তু তালপাখা ধরার মতো হাত অবশিষ্ট নেই তার। এমন সময় একটি হাত এগিয়ে আসে, হাতটি গিয়াসের। হাতের তালুতে কালি। বিরক্ত হয় মজিদ, ‘এখন যা তো, কামের সময় জ্বাল্যাইস না।’
কথা শুনে গিয়াসের চোখে যেন কৌতুক ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সেদিকে তাকিয়ে মজিদের রাগ হয়, হারিকেনের দিকে তাকিয়ে হাসছে কেন ব্যাটা? ‘ওই মজা নিত্যাছু! যাহ, যা ভাগ কইল্যাম।’
গিয়াস মাথা নিচু করে, তারপর যখন মুখ তোলে, সেখানে এক অতিপ্রাকৃত চোখের ছবি ভাসে। মণিহীন সেই সাদাটে চোখ মহাসড়কের পাশের উজ্জ্বল বিকেলের ছবিটিকেও যেন ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। বাক্স খুলে দুই টাকার একটা কয়েন ঝনাৎ করে ফেলে দিয়ে যেন পরিত্রাণ পায় মজিদ। গিয়াস সেটাকে পকেটে চালান করে দিয়ে হেলে-দুলে হাঁটতে থাকে।
গিয়াস পাগলার জন্ম এ গ্রামে নয়, গ্রামের মানুষেরা কী করে যেন শুধু তার নামটাই জেনেছে। এ গাঁঁয়ের মানুষ না হলেও এখানকার মাটি যেন তাকে জন্মভূমির মতোই নাড়ি ধরে টানে। কিছুদিন পরপর আবির্ভূত হয় গিয়াস পাগলা। কখনো আগের চেয়ে বেশি রুগ্ণ, কখনো উজ্জ্বল মুখে, কখনো চুল-দাড়ির জঙ্গলে নিজেকে ঢেকে। আবার কখনো চকচকে বেলমাথা নিয়ে। পোশাকেও তার বৈচিত্র্য থাকে। কোনো কোনো মাঘের শীতে সে দুই ঊরুর মাঝে শুধু নেংটি পরে ঘুরে বেড়ায়, আবার কোনো কোনো গ্রীষ্মের ভরদুপুরেও লেপ গায়ে রাস্তায় হাঁটে গিয়াস। গতবার প্রচণ্ড গরমে আর্মি পোশাকের মতো নকশা করা একটা হাইনেক জ্যাকেট সংগ্রহ করেছিল। ওটা গায়ে দিয়ে গলা পর্যন্ত বোতাম লাগিয়ে দিত। আর সারা দিন ধরে বন্দুকটার সে কী পরিচর্যা! আম অথবা কাঁঠালগাছের ডাল ছিল সেটা। হাত দুয়েক লম্বা, মাথার কাছে খানিকটা বন্দুকের নলের শেপ। গিয়াস এক শিশি তেল আর একটা ময়লা ন্যাকড়া নিয়ে সারা দিন ধরে রাইফেলের গা পরিষ্কার করে, এইম প্র্যাকটিস করে কিন্তু গুলি খরচ করে না। ডালের সঙ্গে পাটের দড়ি বেঁধে রাইফেল কায়দা করে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখে, প্যারেড করে হাঁটে সকাল-সন্ধ্যা।
এবার আবার পায়ের গিঁট ছুঁইছুঁই একটা প্যান্ট সংগ্রহ করেছে, কোমরে মলিন গামছা বাঁধা। সারা দিন ব্যস্ত গিয়াস হাঁটে আর হাঁটে, বদ্ধ উন্মাদ! তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অস্বস্তি কেবল গিয়াসের চোখ দুটো। অমন অগোছালো পাগলা মুখে এত চকচকে মানবিক চোখ বেমানান লাগে। ওর দিকে তাকালে অস্বস্তি হয়, মনে হয় ও চোখে আনন্দ-বেদনার সব ছায়া পড়ে।
মজিদ দোকানদারের কাছে পাওয়া টাকা দুটো ট্যাঁকে গোঁজার পর গিয়াস পাগলা সেই যে হেলে-দুলে হাঁটতে থাকে আর থামে না। নদীর মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলা মহাসড়কের কী মায়া যেন তাকে গ্রাস করে। কয়েক দিন ধরে নাওয়া-খাওয়া হয় কি হয় না, বেভুল পাগলা মহাসড়কের পিচে পা ফেলে চলতেই থাকে। অবশেষে এই মহাসড়কই তাকে নিয়ে আসে এক মহানগরে—আলোর শহর, কালোর শহর। অসংখ্য মানুষ, গাড়ি, ভিখিরি আর গিয়াসের মতো পোশাক ও আচরণের লোক। তারা ডাস্টবিনের নোংরা ঘেঁটে খাবার খায়। ঠোঁটের চারপাশে উড়তে থাকা ভনভনে নীল মাছি প্রাপ্য খাবার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভে বুঝি ওদের পাকস্থলীর ভেতরেই ঢুকে যেতে চায়। গিয়াসের চোখ নতুন শহরের নতুন স্বাদ চেটে নেয়। মাথার কোঁকড়ানো নোংরা, লালচে জটাধরা চুলে প্রায় ঢেকে যাওয়া চোখের ভেতর নতুন ছায়া গজায়।
আকাশছোঁয়া দালান-কোঠার শত-কোটি ভাগ। এত ওপরে তাকাতে তাকাতে কুঠুরিগুলো খেলনা বাড়ির মতো পরিসরে কমে আসে। হাত পাতার মতো কোন ফাঁক খুঁজে না পেয়ে রাস্তায় বসে পড়ে গিয়াস। পিঁপড়ের মতো অসংখ্য লোক পার হয়ে যায়, খুব কম লোকই তাকায় তার দিকে। গ্রামে গ্রামে তাকে দেখার যেমন উত্তেজনা, দেখার লোকের ভিড় পড়ে যায়, এই কোলাহলমুখর শহর তেমনটি নয়। হাজারো গিয়াসকে প্রতিদিন এরা চোখের সামনে গড়াতে দেখে। টাকা অবশ্য গিয়াস পায়, গ্রামের চেয়ে বেশিই পায়। কেউ দেয় না, কেউ দিচ্ছে না করেও তিনটি লোক দেয়—১০, ১০ এবং পাঁচ টাকা। গ্রামের দুই দিনের রোজগারের সমান। ওখানে পরিশ্রমও বেশি, সারা দিন হেঁটে হেঁটে হাত পেতে বেড়াতে হয়। কম পরিশ্রমে অধিক আয়ের ব্যস্ত শহরের মায়া-জাদু গিয়াসকে যেন টানে। আরও বহুদিন রাজপথে আস্তানা গড়ার উদ্দেশ্যে শিকড় গাঁথে ফুটপাতে। অনেক রাতে একটা গাড়ি আসে। একজন লোক গাড়ির দরজা খুলে দ্রুত নেমে আসে। কয়েক কোটি টাকার একটা বিল পাইয়ে দেওয়ার জন্য মানত করেছিল। পাঁচ শ টাকার একটা নোট পাগলা ভিখিরির হাতে ধরিয়ে দিয়ে কোটি টাকার লভ্যাংশ হিসাব করতে করতে লোকটি চলে যায়। টাকার মাপ দেখে গিয়াসের চোখ নাচে। নেড়েচেড়ে, গন্ধ শুঁকে, টাকার ওজন মেপে দেখে। আবার কখনো হাতের তালুতে রেখে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়, হেলেদুলে কুড়িয়ে আনে। টাকার খেলায় মেতে থাকা গিয়াসের সামনে আরও একটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়, হেডলাইট সরাসরি তার চোখের দিকে। টাকাটা প্যান্টের পকেটে রেখে সে হাতের ছাউনির নিচে প্রত্যাশার চোখ খুলে রাখে। এবার একটি কর্কশ কণ্ঠ এবং ইউনিফর্ম পরা একটি লোক এগিয়ে আসে, ‘ওই শালা পাগল, এত রাইতে এইখানে কী করছ?’
নেপথ্যে কোথাও গম্ভীর কণ্ঠ বেজে ওঠে, ‘প্যাঁচাল কম, গাড়িতে ওঠাও ব্যাটাকে।’
সুতরাং গিয়াসের নাগরিক জীবনের প্রথম রাতের গভীরতা নেমে আসে আইনের ঘরে। কনস্টেবলের অকারণ ধাক্কায় মেঝেতে আধশোয়া হয়ে পড়ে যায় সে। কনস্টেবল চটুল গলায় বলে, ‘অ্যাই, তুই পাগল!’ তারপর ঊর্ধ্বতনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ছার, পাগলের তো মানুষের মতো চোখ থাকার কথা নয়। ওই ব্যাটা জোচ্চোর, মতলব কী, কয়্যা ফালা!’
‘পাগলের ভান করছে বলে মনে হচ্ছে। এমন পিটাব না হাড়-মাংস এক করে দেব শুয়োরের বাচ্চার। পাগলামি দৌড়ে গিয়ে পোদের ভেতর ঢুকে যাবে। বল তোর নাম কী? হঠাৎ কোথা থেকে আসলি?’
ঊর্ধ্বতনের ভরাট কণ্ঠে কেঁপে ওঠে আইনের ঘর। গিয়াস পাগলা কুঁকড়ে ছোট হয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে মেঝেতে। আবারও গমগমে কণ্ঠ কাঁপায় সবকিছু, কিছুটা কাঁপায় গিয়াসের হূৎপিণ্ডকে, ‘অ্যাই চোখ খোল। চোখ লুকাবি না।’
খানিকটা পশুসুলভ ভয়ার্ত, খানিকটা মানবিক—এ রকম মাঝামাঝি এক মিশ্র দৃষ্টি ফুটে ওঠে গিয়াসের চোখে। বুঝতে পারে না কোন চোখে স্পষ্ট করে তাকাবে সে!
‘শালা, এ তো পাগল নয়, এ তো দেখছি মানুষ! কথা বল, কথা বল বলছি। দাঁড়া, তোর বাপের নামসহ বলাচ্ছি।’
শক্ত লাঠির সর্বশেষ বাড়িটি আঘাত করে গিয়ে গিয়াসের ঠোঁটের কোনায়। ঝরঝর করে রক্ত পড়ে।
‘ছার, পাগলের শরীল থাইকা রক্ত বাইরায়!’ ফিক ফিক করে হাসে কনস্টেবল।
‘বেরাতে দাও। আজ ওর পাগলামি চিরতরে মিটিয়ে দেব, ভণ্ড কোথাকার।’ আইনের লাঠির ডগাটা চেপে ধরে গিয়াসের আহত ঠোঁটের কোণটা ডলে দেয় ঊর্ধ্বতন। চিৎকার করতে পারে না বলে তীব্র যন্ত্রণারা হাওয়ায় মেলাতে না পেরে ভেতরে ঢুকে পড়ে। উত্তপ্ত প্রবাহ নাক, কান আর লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় আছড়ে পড়ে। বিড়বিড় করে গিয়াস, ‘কোনো দিন আমি মানুষ ছিলাম না।’
ক্রুর বিজয়ীর হাসি ফোটে ঊর্ধ্বতনের মুখে। কনস্টেবল ঝুঁকে কান পেতে শোনে গিয়াসের কথা, সবজান্তার একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, অপেক্ষা করে অপর পক্ষের। অপর পক্ষ প্রশ্ন করে, ‘কী হলো? বোকার মতো হাসছ কেন?’
‘ছার, মামলা খুব পরিষ্কার। এদের বলে এসকেপিস্ট। জীবনের যন্ত্রণা আর সংকট থাইকা পালানোর লাইগা ছার পাগলের জীবনের মইধ্যে ঢুইকা পইড়ছে।’
‘তুমি কী করে জানলে এসব?’
গুরু মারা বিদ্যা শিখে ফেলেছে এ রকম একটা কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে কনস্টেবল বলে, ‘আইনের লোক ছার, কত কিছু জানন লাগে। মানুষের সব রকম ভেলকিবাজির খবর রাখন লাগে।’
‘অত জানা ভালো নয়। নিজের স্তরেই থাকো। আর ওর পকেট সার্চ করো। আমার ডান পকেট।’
‘জি ছার।’ সুবোধ অধস্তনের মতো গিয়াসের পকেটে অভ্যস্ত হাত পুরে দেয়। পাঁচ শ টাকার নোটটা পাওয়া যায় ডান পকেটেই। বাম পকেটে বাকি ২৫ টাকা। কনস্টেবল তার কালচে হয়ে আসতে থাকা লোভী মুখের ওপর ঊর্ধ্বতনের প্রতি বিগলিত বিনয়ী হাসির পর্দা ঝুলিয়ে দেয়।
পরদিন মহানগরের একটি ব্যস্ত মহাসড়কের পাশে বসে থাকতে দেখা যায় গিয়াসকে। শরীরে বা পোশাকে কোনো পরিবর্তন নেই, শুধু ঠোঁটের কোণে এক ফোঁটা রক্ত কালো চচ্চরে হয়ে জেগে আছে। আজ দিনের শুরুতেই দানশীল একজন এগিয়ে আসে, একটা পাঁচ টাকার নোট কোলের ওপর ফেলে যায়, টাকাটা উড়ে যায় শুকনো পাতার মতো। সেদিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। গিয়াসের মুখের ওপর বটের ঝুল নামার মতো চুলগুলো থুবড়ে পড়ে থাকে। চুলের জঙ্গলে ঢাকা পড়েছে ভ্রু, তার নিচে আবছা অন্ধকারে দেখা যায় কেবল চোখের সাদা অংশ, কালচে গোলাকার দেখার অংশ চামড়ায় ঢেকে গেছে। ভ্রুর নিচে নেই আর কোনো আলো, নেই দেখার চঞ্চলতা। আর কোনো দিন গিয়াস পাগলা চোখ তুলে দেখেনি মানুষের সভ্যতা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২২, ২০১১
এম এ শাহিন
প্রতিটা লেখকের পেজ ওপেন করলে প্রথমে লেখক পরিচিতি থাকলে খুব ভালো হত।সকল শ্রেণী কক্ষের মূলবই গুলো প্রকাশ করবেন কি ?
Bangla Library
আচ্ছা দেখি এটা কিভাবে দেয়া যায়। টেকনিক্যাল টিমকে বলতে হবে। আইডিয়াটার জন্য ধন্যবাদ।
“সকল শ্রেণী কক্ষের মূলবই” ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।