কন্যার চোখে বাবা
সোহরাব হাসান
কবি-লেখকের সন্তান বলেই লেখক হবেন এমন কথা নেই। কিন্তু জিনান সৈয়দের আমার আব্বু: আবদুল মান্নান সৈয়দ-এ সেই লেখক সন্তানকে খুঁজে পাওয়া যায়। আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন সব্যসাচী লেখক। গবেষণা করেছেন জীবনানন্দ দাশ, কাজী নজরুল ইসলামসহ পূর্বসূরি অনেক লেখককে নিয়ে।
একজন লেখকের জীবন, তাঁর নিত্যদিনের খুঁটিনাটি বিষয় তাঁর কন্যা কীভাবে দেখেছেন, মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারে কীভাবে বেড়ে উঠেছেন, পরিবারের একজন সদস্য হয়েও কীভাবে পৃথক একটি ভুবন গড়ে তুলেছেন—সেসবই জিনান সৈয়দের লেখায় বিবৃত হয়েছে। কাদের সঙ্গে মান্নান সৈয়দের সখ্য ছিল, কারা তাঁকে সমীহ করতেন, কারা ঈর্ষা করতেন—তাঁর লেখায় সেসবও জানতে পারি।
জিনান বইটি সাজিয়েছেন যথাক্রমে আমার আব্বু আবদুল মান্নান সৈয়দ, মা আর বাবা, আজিমপুরের দিনগুলো, শেষের কয়েক বছর আব্বুকে খোলাচিঠি ইত্যাদি পর্বে।
প্রবেশক শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘গোধূলি। পৃথিবীর আশ্চর্যতম সুন্দর সময়ের একটি। যখন সূর্য অস্ত যায়, বাটের আঁধার নামে, কী গোলাপি আলোয় উদ্ভাসিত হয় চারদিক। আমার বাবার মতো রোমান্টিক পুরুষের এই ধুলোময় পৃথিবী থেকে অন্য আরেক অচেনা, অজানা পৃথিবীতে যাওয়ার এর চেয়ে সুন্দর সময় আর কী হতে পারে।’
বাবার মৃত্যু তাঁর সন্তানকে, মেয়েকে কীভাবে আপ্লুত করে, কীভাবে তার ভেতরে বেদনার আলো ছড়ায়, আবার স্বপ্ন দেখায়—এরই সাক্ষ্য এ বই।
জিনান সৈয়দ বাবাকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন, কিছুটা মেয়ের চোখে, কিছুটা স্বজনের চোখে এবং স্বপ্নের চোখেও। তাঁর বাবা অন্যদের থেকে আলাদা। তাঁর স্নেহ আলাদা, তাঁর অনুভূতি আলাদা। বইয়ে আছে বাবার দৈনন্দিন জীবনের কিছু টুকরো ছবি, জন্মদিনে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো, বইমেলায় ঘুরে ঘুরে বই দেখা, সুহূদ লেখকের সঙ্গে বাসায়-রেস্তোরাঁয় আড্ডা দেওয়ার কথা। মান্নান সৈয়দ কলকাতায় গিয়েছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে গবেষণার কাজে। কাজও করেছিলেন। কিন্তু অভিসন্দর্ভ জমা না দিয়ে চলে এলেও তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধারণ করেছিলেন তাঁর মননে, সত্তায়।
মান্নান সৈয়দ শেষ দিকে শিল্পকলা নামে একটি পত্রিকা বের করতেন শিল্পকলা কেন্দ্র নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। সেটি হয়তো তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ছিল। জিনানের লেখায় এ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাই না।
মান্নান সৈয়দের সৃষ্টিশীলতা বা লেখক প্রতিভার বিচার করবেন বর্তমান ও ভাবীকালের লেখক-গবেষকেরা। কিন্তু ব্যক্তি মান্নান সৈয়দকে জানতে, বুঝতে জিনানের বই অনেক সহায়ক হবে। লেখক হিসেবে মান্নান সৈয়দ যে কেবলই গজদন্ত মিনারের বাসিন্দা ছিলেন না, তা তাঁর শেষের দিকের লেখায় যেমন পাই, তেমনই পাই জিনান সৈয়দের স্মৃতিচারণায়ও।
তিনি লিখেছেন, ‘জন্মের পরে সত্যি বলতে কী এত কষ্ট জীবনে আমি প্রথম পেলাম। কষ্টের রাত্রি পার হয়ে ভোর হলো। আব্বুর ঘর থেকে উঠে আব্বুর ব্যালকনি থেকে আকাশ দেখলাম।’
জিনানের কৃতিত্ব হলো, তিনি তাঁর আবেগকে পরিমিত ভাষায় পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পেরেছেন। পাঠকের বাড়তি পাওয়া কবি বেলাল চৌধুরীর ভূমিকা। ৫৬ পৃষ্ঠার এই হ্রস্ব বইটি মান্নান সৈয়দকে চিনতে সহায়ক হবে। এ জন্য অবশ্যই জিনান সৈয়দের ধন্যবাদ প্রাপ্য।
নদীপুত্রের অস্তিত্ব-অন্বেষা
মাহবুব কবির
নদীমাতৃক এষণা নিয়ে, অন্তর্গত ভাঙন ও নির্মিতি নিয়ে হাজির হলেন আপন মাহমুদ। প্রথমেই এই কবির কণ্ঠে গলা মিলিয়ে নিই, ‘পাতা ঝরার শব্দ হতে ফুল ফোটার শব্দ পর্যন্ত হেঁটে/ যেতে হবে—এরকম ইঙ্গিত ছিলো হাতের—হাত ছিলো/ নিজের কাঁধে—কাঁধে ঝুলে ছিলো ব্যাগ—ব্যাগে ছিলো/ মায়ের ছবি—মায়ের ছিলো তাকিয়ে থাকা—তাকিয়ে/ থাকা মানে বয়ে যাওয়া নদী/ মা আমার যাচ্ছেন বয়ে, নিরবধি…।’ এটি আপন মাহমুদের প্রথম কবিতার বই সকালের দাঁড়ি কমার ‘মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া’ সিরিজের ১০ নম্বর কবিতা। কোনো ধরনের আড়াল নেই। ছোট ছোট বাক্যে দৃশ্যকল্পগুলো একটির ওপর আরেকটি অবধারিতভাবে আছড়ে পড়েছে। যেন হাড়, মাংস ও রক্তের সমষ্টিতে এক নদী বয়ে চলেছে। মাত্র ছয় লাইনের মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে লেখাটি মনস্তাত্ত্বিক উপলব্ধির গভীর উচ্চারণে চিরন্তন আবহ সৃষ্টি করেছে। এখানেই কবিতার শক্তি।
আপন মাহমুদ মা, নদী ও প্রকৃতি-আসক্ত। তাঁর কবিতা সকালের কাঁচাবাজারে সবজির মতো তরতাজা। উচ্চকণ্ঠ নয়—খুব সহজ, শান্ত ও আর্দ্র ভাষাভঙ্গি তাঁর। ছন্দসচেতন না হলেও তাঁর কবিতায় প্রতীক, উপমা ও চিত্রকল্পগুচ্ছ চেতন-অবচেতনে ঢেউ তোলে। সময়বোধের তীব্র প্রতিভাসে ঠিকরে আলো ছড়ায় তাঁর সুনির্বাচিত সংঘবদ্ধ শব্দাবলি। তাঁর বই থেকে বিভিন্ন কবিতার কয়েকটি পঙিক্ত:
কতগুলো মৃত পাহাড় কচ্ছপের মতো বসে আছে বুকে
কারা যেন ঘুমের ভেতর ছেড়ে দিয়েছে রেলগাড়ি—সেই থেকে খুঁজে পাচ্ছি না ব্যক্তিগত নৌকা, ভাটিয়ালি…
৩. আমি নিঃসঙ্গ দুপুরে হেঁটে যাওয়া মালির পদধ্বনির
সঙ্গে ফুল ফোটার শব্দ মিলিয়ে যেতে দেখি, আর
এখানে ওখানে লিখি ‘অপেক্ষা’।
৪. কত গান একা একা বাজে
এই হলো আপন মাহমুদের বিষয়ভাবনা ও প্রকাশরীতি। এই তাঁর মেজাজ। এই মুহুর্মুহু হাহাকারের মধ্যে স্বপ্ন ও অপেক্ষার আদিগন্ত শূন্যতা শেষ পর্যন্ত জাগৃতির ব্যাপারই ঘটায়। এখানেই জয়ী কবি।
আমাদের নদী, খাল, বিল অব্যাহতভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল, প্যারাবন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। পাহাড় কেটে সমান করে ফেলা হচ্ছে। এই দস্যুতা ও প্রযুক্তি-বাস্তবতায় পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে আপন মাহমুদ বুনোফুল দেখে থমকে দাঁড়ান, দাঁড়িয়ে থাকেন। শুকিয়ে যাওয়া নদীর জন্য, সবুজের জন্য তাঁর মধ্যে তীব্র হাহাকার ও বেদনা একা একা বাজে। এই যাপিত জীবনের ভাঙন ও বিষাদ তাঁর কাছে অভিজ্ঞান। এ অভিজ্ঞানই স্বপ্ন উসকে দেয়। তাঁর ‘বটগাছ’ কবিতাটি দেখি এবার, ‘আমার মাথায় শেকড় রেখে একটা বটগাছের বেড়ে উঠবার কথা/ ছিলো—কথা ছিলো নিদাঘ দুপুরে পাতা নেড়ে নেড়ে সে সবুজের নেতৃত্ব/ দেবে, ছায়াদের অভিভাবক হবে, হবে পাখিদের আশ্রম—তার কিছুই/ হলো না—আমার ফলাকাঙ্ক্ষী মা-বাবা বটগাছের পরিবর্তে আমার/ মাথায় মধ্যবিত্তীয় একটা ফলের বীজ বপন করে দিয়েছেন—আর/ কতটা পরিচর্যা করলে গাছটি সামাজিক হবে, ধার্মিক হবে, সুস্বাদু/ ফল দেবে—তারই দেখভাল করছিলেন আমার শিক্ষক-শিক্ষিকারা/ তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমি এখন একটা সুশীল ফলগাছ—নিয়মিত/ অফিসে যাই—বাড়িতেও টাকা পাঠাই/ আমার আর বটগাছ হওয়া হলো না।’ এই হচ্ছে আপন মাহমুদের কবিতার বৈশিষ্ট্য।
ভাষা, প্রতীক, চিত্রকল্প ও উপমায় আপন মাহমুদ আশ্চর্য সুন্দর সারল্যে মানবিক সংবেদ ও প্রকৃতির নিগূঢ় সমীকরণ ফুটিয়ে তোলেন। ভোগের এ দুনিয়াদারির দায় কীভাবে তিনি স্বীকার করেন, দেখুন, ‘প্রয়োজন স্নানের জল তুলে/ রাখা—ততটা বয়স পেরিয়ে এসে পুরনো সেই নদীর চোখে দেখি—/ কিছু জল শুকিয়ে গেছে—কিছুটা মায়ের চোখে, আর কিছুটা আমিও/ খেয়েছি সাকুরায় বসে।’ নদী শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে ভোগের এমন অন্বয়সাধন সত্যি বিরল।
আপন মাহমুদ অনেকটা মিতবাক। তবু তাঁর কবিতায় মাঝেমধ্যে গল্পের ইশারা, ভাব ও পরম্পরা উঁকি দেয়। তাঁর কবিতায় শৈশবতাড়িত নস্টালজিয়া, বাস্তবতা ও নাগরিকবোধের সম্মিলনে অস্তিত্ব-অন্বেষার প্রবণতা প্রবল। আপনের কবিতা একেবারে নতুন কিছু নয়—তাঁর মধ্যেও উত্তরাধিকারের সূত্র আছে। আধুনিকতার বিবর্তন আছে। এই কবির মানসলোকও সমসাময়িক কবিতাচিন্তা, রীতি, শৈলী ও প্রকরণে তাতানো।
সকালের দাঁড়ি কমা আপন মাহমুদের প্রথম কবিতার বই, প্রথম উন্মোচন, প্রথম উদ্বোধন। পাঠকের কাছেও তাঁর এ মলাটবন্দী প্রকাশ প্রথম ব্যাপার, প্রথম অবলোকন। আপন মাহমুদের দায়িত্ব তো সম্পন্ন। পাঠক, এবার পালা আপনার।
এ মরজগৎ এক ইশারালিখন
মজনু শাহ
ক্ষুদ্রায়তনে গ্রন্থালোচনার বিপদ এই যে তাতে কোনো কিছু পরস্ফুিট করে তোলা দুরূহ। পাঠক ভাবতে পারেন, আলোচনা কোথায়, এ তো নেহাতই প্রতিবেদন! সোহেল হাসান গালিবের রক্তমেমোরেন্ডাম কাব্যগ্রন্থ পাঠান্তে সেই শঙ্কার কথা ভাবছি।
বইটি পড়তে পড়তে মনে হতে পারে কোনো কোনো পাঠকের—এ বুঝি আত্মপ্রবন্ধের বেশ ধরে থাকা রসোত্তীর্ণ দিনপঞ্জি! বলছেন, ‘ভুট্টাক্ষেতের ধারে বসে লিখছি এ প্রবন্ধ। প্রবন্ধই বটে। ফরমায়েশি মুহূর্তের এক ঘোর কালো পরিখার মাঝখানে, একা।’ (এখন বসন্ত)
এমন উচ্চারণের মধ্যে তাঁর কাব্যলিপ্সা জাগরূক থাকতে চেয়েছে। দৃশ্যত, রক্তমেমোরেন্ডাম গদ্যাঙ্গিকে হলেও গদ্যের যা মূল বৈশিষ্ট্য, ভাবনার যুক্তিশৃঙ্খলা, তাকে অমান্য করে বা পাশ কাটিয়ে, বিবিধ লজিক্যাল ক্র্যাক তৈরি করে করে রচিত। ‘হয়তো বেদনা আছে। লা-ওয়ারিশ। আছে আর্তনাদ। না-মঞ্জুর। চলে গেছে হাওয়া, নীলকুঠি যতদূর।’ (অনাস্থাসেতুর ধারে)
দেখে মনে হবে, পরম্পরাহীন বুঝি বা, আসলে তা নয়, পঙিক্তগুলোর মাঝে একটুখানি শূন্যতা বা মিসিং লিংক রেখে দেওয়া, যাতে অর্থ ও ভাবনাপরিসর বেড়ে যায় পাঠকের। আখ্যান ও কাঠামোনির্ভর গীতিকবিতায় এটি সম্ভবপর নয় মনে করছেন এখনকার অধিকাংশ কবি।
রক্তমেমোরেন্ডাম-এ আখ্যান কি নেই? আছে। তবে তা যেন লক্ষ্য নয়। একটি কাহিনি বুনে তোলার দিকে না গিয়ে তার ভেতর অসংখ্য অণুকাহিনি জুড়ে এমন এক ক্যানভাস গড়েন কবি, যা আজকের জটিলতম জীবনচ্ছায়ার সমানুপাতিক হয়ে ওঠে। কিছু ভঙ্গি তিনি হামেশা ব্যবহার করেন, যেমন অনুপ্রাস। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাংগীতিক একটা আবহ সৃষ্টি হয় এতে। আর রয়েছে প্রশ্ন। অজস্র প্রশ্ন। প্রশ্নগুলোর ভেতর প্রফেসি আছে, ঘূর্ণির মতো এসে পড়ে তারা কবিতায়।
অনেক সময় এগুলো কথার যে বুনন, তাকে গতি দিয়েছে। কবিতার মূল বিষয় থেকে দূরে কোথাও কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাও যেন তা আবার থমকে দেয় কখনো, তখন কবিতাটির সেই প্রশ্নবিন্দুতে দাঁড়িয়ে ভাবনা আসে। জীবনে যেভাবে আকস্মিকতাকে আমরা আলিঙ্গন করি, তেমনি। ‘পাপ কি তবে কোনো চাবি, পাসওয়ার্ড—গুম্ফার গায়ে লেখা?’ (পাপ)
কিংবা, ‘এই আমঝুপী থেকে আম্রকানন কতদূর?’ (সিদ্ধান্ত)
গহন প্রশ্নকণ্টক বটে!
গালিবের কবিতায় যা তিনি বিষয় হিসেবে ভাবেন, তা প্রকট করে না তুলে বিমূর্ততার ভেতর দিয়ে নানা অর্থ ও ব্যঞ্জনার দিকে নিয়ে যান। এক ইশারাভাষাকেই আরাধ্য ভাবেন, সেটি স্পষ্ট। ভিখারি ও ভীমসেন গান করে তাঁর ভেতর, বলেছেন। ভাষায় অপূর্ব দখল আছে বলে লিখতে পারেন এমন পঙিক্ত—‘নাগরদোলা—নাগরকে দোলানো। দ্বিতীয়া তৎপুরুষ। হতে পারে নাগরের দোলা—ষষ্ঠী। নাকি নাগরকে দোলায় যে নারী—বহুব্রীহি!’ (নাগরদোলা)
কিংবা, ‘আজ ডাকিনীর চশমা, প্রেত-বর্ণমালা, পিশাচের হাসি রেখেছি সঞ্চয়ে।’ (পুঁথি)
আত্মপ্রকাশের জন্য যে ভাষা গালিব বেছে নিচ্ছেন, তা একাকারের। বহু পুরোনো কোনো অনুষঙ্গ এসে মিলে যাচ্ছে নব নব বাস্তবতার সঙ্গে। ‘…লওহে মাহফুজের পাশেই আছে রিসাইকেল বিন। অভ্রচূর্ণ তার গায়ে মাখা। …পড়ে ছিল কার ভাঙা ল্যাপটপ। আশশ্যাওড়াবনে।’ (ভ্রমণপথ)
পাঠককে যে বিষয়গুলো মুগ্ধ করবে তার অন্যতম হলো, জগতে আমরা যাকে ভেবে থাকি তুচ্ছ, অদৃশ্য, অশ্রুত, সব তাঁর অনুভবের আওতায়। কোথাও অনুবাদের মেশিন নুইয়ে পড়ছে কোনো ঝুমকো লতায়, পোকাধরা কুমড়ো ফুলের কাছে কখনো জিজ্ঞাসা করছেন আত্মগ্লানির সংজ্ঞা, যে ঘাটের সোপানে মুদ্রিত আছে সংকেত-ভাষা, তার জন্য ঢোশকাগাছের পাতায় বসে একটা টুনটুনি পাখি কতটুকু আতঙ্ক পোহায়, এমন অনেক কিছু তার নজর এড়াচ্ছে না। সবই তাঁর ইশারালিখনের শিল্প-উপাদান।
মেয়ের কলমে বাবার কথা
আহমাদ মাযহার
হুমায়ুন আজাদ ছিলেন একই সঙ্গে সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক, ভাষাতত্ত্বের গবেষক, সাহিত্যের সমালোচক, শিক্ষক ও সমাজ পর্যবেক্ষক। নিজেকে তিনি উপস্থাপন করতে চাইতেন প্রথাবিরোধী একজন মানুষ হিসেবে।
প্রথাবিরোধী স্বভাবকে অন্তরে ধারণ করতেন বলেই তিনি নির্ভীক হতে পেরেছিলেন; পেরেছিলেন নির্মোহ হতে। বিশেষ করে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে হুমায়ুন আজাদের অবস্থান ছিল স্পষ্ট। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে ধর্মান্ধ ঘাতকের দ্বারা আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হন তিনি। এমন নৃশংস আক্রমণের শিকার হয়েও প্রথাবিরোধী অবস্থান থেকে ও ধর্মীয় মৌলবাদবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসেননি। চিকিৎসা শেষে ফিরে আসার পরও ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের উপর্যুপরি হুমকি চলতেই থাকে। এসব কথাই লিখেছেন হুমায়ুন আজাদের বড় মেয়ে মৌলি আজাদ তাঁর হুমায়ুন আজাদ: আমার বাবা বইয়ে। পুত্র অনন্য আজাদকে অপহরণের পর হুমায়ুন আজাদ মুষড়ে পড়েছিলেন। মৌলি ওই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘অনন্যের অপহরণের ঘটনায় বিচলিত হলেন এ কারণে যে, তিনি বুঝলেন, আজ তিনিই শুধু নিরাপত্তাহীন নন তার পরিবারও আজ ভীষণ রকম অসহায়। তাই বাবা লিখলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর কাছে খোলা চিঠি। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী এ চিঠি দেশ-বিদেশের সত্যিকারের হূদয়সম্পন্ন মানুষের মনে দোলা দিলেও আমাদের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কোনো নেতা-নেত্রীর মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করল না। তাঁরা সেসব মানুষরূপী হায়েনাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলেন না। উল্টো আমাদের পরিবারের ওপর নেমে এল ক্রমাগত হুমকি।’ ওই বছরই লেখকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘পেন’ জার্মানিতে তাঁর জন্য একটি বৃত্তির ব্যবস্থা করলে তিনি ৭ আগস্ট সেখানে যান। ১২ আগস্ট আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে এই খবর প্রায় সকলেরই জানা।
মৌলি আজাদের লেখা হুমায়ুন আজাদ: আমার বাবা বইটি ৩৯টি শিরোনামে বিভক্ত। বইটি আগাগোড়া পড়লে মনে হবে, লেখক যেন তাঁর বাবার এমন একটি সংক্ষিপ্ত জীবনীই লিখতে চেয়েছেন যেখানে হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে তাঁর ছাত্রছাত্রী, লেখক-সাংবাদিক ও সুধীজন যে ধারণা পোষণ করেন তার সঙ্গে সঙ্গে একজন পারিবারিক পরিমণ্ডলের মানুষকেও যেন খুঁজে পাওয়া যায়। পিতা-পুত্রীর মধ্যে গভীর আবেগের সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। এই বইয়ে সেই আবেগের ছাপ স্পষ্ট। তা ছাড়া হুমায়ুন আজাদ কেবল বিখ্যাত ব্যক্তিই নন, নানা বিতর্কিত মত প্রকাশ করে সমাজে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী মানুষ। সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পরও জার্মানিতে গিয়ে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর কারণে গোটা পরিবারে যে রুদ্ধশ্বাস অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে মৌলির মনের ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তাঁর পক্ষে সেটাও হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে একটা সহজ-সরল রচনা লেখার অন্তরায়। মাঝেমধ্যে বইটি আবেগের বাড়তি চাপে আক্রান্ত হয়েছে সে কারণেই। হুমায়ুন আজাদকে মৌলি কেবল পিতা হিসেবেই দেখেননি, দেখেছেন তাঁর ব্যক্তিত্বের নানামাত্রিক সৃষ্টিশীলতার মধ্যে।
মৌলি বলেছেন, ‘বাবার ভক্তদের বিশেষ অনুরোধ যে তারা বাইরের হুমায়ুন আজাদের চেয়ে ভিতরের হুমায়ুন সম্পর্কে জানতে বেশি আগ্রহী। আর তাই মেয়ে হিসেবে (রক্তের বাঁধনে জড়িত বলে) তাঁর সম্পর্কে লেখার জন্য হাতে তুলে নিলাম কলম।’ এই পরিপ্রেক্ষিতে বিখ্যাত বাবা সম্পর্কে তাঁর সন্তানের লেখার কাছে এমন একটা প্রত্যাশা জন্মানো স্বাভাবিক, যেখানে পরিবারের বাইরের লোকের কাছে চেনাজানা মানুষটির চেয়ে ভিন্ন ও পরিবারের ভেতরের অন্তরঙ্গ একজন মানুষের পরিচয় উঠে আসবে। মৌলি আজাদের বইয়ে তেমন পরিচয় যে একেবারে নেই তা নয়। যেমন, ‘বাবার প্রিয়/অপ্রিয়’, ‘অপছন্দনীয়’, ‘ভক্ত লেখিকাদের সঙ্গে সম্পর্ক’, ‘বাবা ও পাঠকের চিঠি’ ইত্যাদি অধ্যায়ে তাঁর জীবনের আড়ালে পড়ে থাকা কিছু অনুষঙ্গ পাঠকের সামনে এসেছে। ‘বাবা ও পাঠকের চিঠি’ রচনায় হুমায়ুন আজাদের কাছে লেখা তাঁর শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের একটি চিঠি এবং অনুরাগী পাঠিকা কণিকার একটি চিঠি অন্তর্ভুক্ত করায় হুমায়ুন আজাদের ব্যক্তিত্বের মাত্রা অনুভবে সুবিধা হয়েছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন জাতীয় সংকটকালে তাঁর মনোভাব সম্পর্কে পরিবারের মানুষ হিসেবে মৌলি বিশেষ কোনো ধারণা দিতে পারেননি। তবে মাঝেমধ্যে মৌলির পর্যবেক্ষণও হয়ে উঠেছে তীক্ষ ও অকপট! যেমন, তিনি বলেছেন, ‘বাবাকে আমি দেখেছি তাঁর মাত্র ১৫ বছর থাকা রাড়িখালকে ৫০ বছরেও তিনি ভুলতে পারতেন না। বাকি যে ৪০ বছর ঢাকায় ছিলেন, তার প্রতি তাঁর ব্যাকুলতা তাই দেখিনি।’ আরেক জায়গায় বলেছেন, ‘বাবা একদিকে যেমন কাউকে তোয়াক্কা করতেন না তেমনি অপরদিকে ছিলেন ভীষণ অভিমানী।’ মাঝেমধ্যে তাঁকে বলতাম, ‘তুমি এমন কেন, সবার মুখের উপর ঠাস ঠাস কথা বল?’ তিনি বলতেন, ‘এসব বলতে সাহস লাগে, আমার কারো কাছে কোন চাওয়ার নেই, আমি যা হব/করব তা নিজেই করব তাই কাউকে তোয়াক্কা করি না।’ এ ছাড়া কয়েকটি অধ্যায়ে হুমায়ুন আজাদের জীবনের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে যা তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনীকারদের পথ দেখাবে তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনায়।
আমার বাবা যে ধরনের বই তা রচনার জন্য মেয়ে হিসেবে মৌলি আজাদকে যতটা গবেষণার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি আশ্রয় নিতে হয়েছে পারিবারিক স্মৃতির কাছে। হুমায়ুন আজাদ তাঁর লেখকজীবনের শুরু থেকেই ছিলেন আকর্ষণীয় ও মোহমুগ্ধকর ভাষাক্ষমতার অধিকারী। এ কথা হয়তো মেনে নিতে হবে যে হুমায়ুন আজাদের সেই কাব্যিক মাধুর্য মিশ্রিত স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ভাষাক্ষমতা মৌলি আজাদের নেই, কিন্তু তিনিও যে পরিশীলনে ও পরিচর্যায় একদিন সৌন্দর্যমণ্ডিত ভাষারীতির অধিকারী হয়ে উঠতে পারেন তার চিহ্ন এই বইয়ের অন্তত একটি রচনায় স্পষ্টভাবে দেখা যায়। রচনাটি হলো ‘আব্বার কাছে খোলা চিঠি’। আশা করা যায় যে একদিন তিনিও নিজের ভাষ্য রচনা করবেন নিজস্ব ভাষাবৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে।
যতিচিহ্নের পরের দীর্ঘশ্বাস
জাফর আহমদ
মুয়িন পার্ভেজের মধ্যে এমন এক মগ্নতা তৈরি হচ্ছে, যা একজন কবিকে সহজে বাক্য উচ্চারণের ক্ষমতা দেয়। তাঁর প্রথম কবিতার বই মর্গে ও নিসর্গে থেকে পরপর কয়েকটি কবিতা পড়ে গেলে এমন কিছু পঙিক্ত, চিত্র ও চিত্রকল্পের মুখোমুখি হই যা চমকে দেয়। ‘একটি পিঁপড়ে’ কবিতায় হাতের তালুতে একটা পিঁপড়ের কথা লিখেছেন মুয়িন। কী লিখতে চেয়েছেন তিনি খুব নিশ্চিতভাবেই যেন জানেন, ফলে বলে দিতে পেরেছেন সহজে, খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে: ‘একটি পিঁপড়ে/হাতের তালুয় ম’রে প’ড়ে আছে/হয়তো সে/আমার আবছা আয়ুরেখাকেই/মেঠোপথ ভেবে/অনেকদূর হাঁটতে গিয়েছিল’। এই নাতিদীর্ঘ কবিতায় কী পেলাম? যা বলেছেন তাই। কিন্তু দৃশ্যটি আরেকবার না দেখলে যেন চলে না। আরেকবার দেখতে হলে পড়তে হয় আরেকবার। তারপর দৃশ্যটি মনের মধ্যে গেঁথে যায় এবং নানা অর্থ উঁকি দিতে থাকে। তার সবগুলো কবি নিজে ভেবেছেন তা হয়তো নয়, কিন্তু কোনোটাকেই বাতিল করে দেওয়া যায় না।
আবার সব কথা সহজে বলা যায় না। ফলে গহনতা শুধু নয়, অনেক বঙ্কিম পথেও বিবৃত হয় তাঁর অনুভূতিমালা। যেমন, কবি যখন সেন্ট মার্টিনের জলে ডিঙিনৌকার মতো ভেসে থাকেন, তখন, ‘একটা পিঁপড়ে ধীরপায়ে নেমে আসে চোখের গলুইয়ে। আমার পা থেকে হঠাৎ সুন্দর এক আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে নাভীমূলে;’—এই অনুভূতির মধ্যেই টের পাচ্ছেন ‘সাপের ত্বকের স্পর্শ।’ (পিঁপড়ে ও ফড়িঙের সঙ্গে)
কিংবা ‘ঘুমিয়ে পড়ার আগে’ কবিতার কথা বলা যায়। এই গল্পে আছে একটি ঘরের বিবরণ। তিনি ক্রমশ নিথর হতে হতে দেখছেন, একেবারে ঘুমিয়ে পড়বেন। তার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত যা যা দেখেছেন, যা যা ঘটেছে, সব বললেন কবি। মৃত্যুর কথা বলেননি কোথাও, কিন্তু পড়তে পড়তে আমরা নিজ দায়িত্বে একবার মৃত্যু থেকেও ঘুরে আসি। সেই ঘরের মধ্যে ওপরে ওঠার সিঁড়ি আছে, মেঝেতে নামার জন্য আছে সুড়ঙ্গ। ঘরের ভেতর গাছ, গোসাপের চলাফেরা, সবুজ পোঁর তৎপরতাসহ কত কী! যখন বলেন, ‘গা ছমছম করল আর তখনই খ’সে যেতে লাগল আমার পোশাক।’ পড়তে পড়তে আমাদেরও গা ছমছম করে ওঠে। কেউ যদি রাত করে কবিতাটি পড়তে পারেন, তাহলে এই মুহূর্তে আমি যা বোঝাতে পারছি না, তাও বুঝতে পারবেন।
উচ্চকণ্ঠ না হয়েই মুয়িন আমাদের চারপাশের নানা ঘটনা, অসংগতি ও হঠকারিতাকে উপস্থাপন করতে পারেন। সেখানে গার্মেন্টস শ্রমিক, রাতমেয়ে, জুতোসেলাইকারী বুড়ো, ফেরিওয়ালা, মেয়েপুলিশ সহজে বিবৃত হয়ে যায়। ‘কাপ্তাই’ কবিতায় কাপ্তাইকে কত সহজে তিনি ডাইনি বলে গাল পাড়েন। এক আদিবাসী নারীকে তিনি বলেন, ‘খড়ের চাঁদ তুলতে পারে মরাগাঙের বান/ফটিক জলে ডুবেছে আদিপিতার সাংগ্রাই/ফেলে দে, মেয়ে, শাড়িটা, খাক ডাইনি কাপ্তাই।’ ‘আদালত ভবনে বৃষ্টি’ কবিতায় লিখছেন, ‘অতিকথনের ভারে/নুয়ে আছে দরখাস্তগুলো, যেন শব্দশব।’ কিংবা কবি কবিতায়, ‘শহর কবির শত্রু, ছদ্মনামে থাকে মফস্বলে।’
বইটির পাঠশেষে ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় আবার ফিরতে হলো। তিন স্তবকে বিন্যস্ত কবিতাটার নাম ‘বন্ধুকে যখন কবিতা দেখাই’। দ্বিতীয় স্তবকটি আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দেয়। কবিতাটি আবার পড়ি,
“বন্ধুকে যখন পাঁচটি কবিতা একসঙ্গে দেখাই,/চা খেতে খেতে সে ছুঁয়ে যায়/আমার সাম্প্রতিক ক্ষত/নীরক্ত আঙুল।
‘যে-শৈঃশব্দ্য আমি লুকিয়ে রেখেছি ছন্দের জ্যোৎস্নায়,/যে-যতিচিহ্নের পরে আরও একটি দীর্ঘশ্বাস থেমে আছে,/বন্ধুর তা চোখেই পড়ে না;/তবু বলে, ‘শেষ কবিতাটি দারুণ লিখেছিস!’/ব’লেই সিগারেট ধরায়।
‘যদি একটি কবিতাই শুধু দেখাতাম,/কী হতো?/শেষ কবিতাটি না পেয়ে আমার বন্ধু/হয়তো বলত, ‘যাশ্শালা, চা-টা ঠাণ্ডা হয়ে গেল!”
দ্বিতীয় স্তবকে দেখি, কবিতা পড়তে পড়তে বন্ধু কবির সাম্প্রতিক ক্ষতের বাইরে যেতে পারে না। নীরক্ত আঙুলে ক্ষত স্পর্শ করে প্রাণের সঙ্গে তো প্রাণের যোগ ঘটানো যায় না। কবির জন্য এ এক গোপন কিন্তু বিরাট দুঃখ। ভাবি, কবিতা নিয়ে যখন আলোচনা করা হয় সমাবেশে বা আলোচনা ছাপা হয় সাহিত্যপত্রে, সাময়িকীতে, সেখানে কী কী সব লেখা থাকে কবিতা নিয়ে। কবি পড়ে কী ভাবেন তখন? কী আর, হাসেন মিটিমিটি। ছন্দের জ্যোৎস্নার মধ্যে যা গুপ্ত থাকে, যতিচিহ্নের পরের দীর্ঘশ্বাসে যা থাকে লুকিয়ে, তাকে কি ছুঁতে পারেন আলোচক? কবির মূল অভিপ্রায়ের কাছাকাছি যাওয়া কতই না কঠিন! জীবনানন্দ দাশ ‘সমারূঢ়’ কবিতায় এই ব্যর্থ আলোচকদের একহাত নিয়েছিলেন। মুয়িন শুধু ধরিয়ে দিলেন একবার—কী ঘটে। দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম তিনটি লাইনের কারণে, মুয়িনের বইয়ের এই আলোচনাও দ্বিধান্বিত থেকে যাবে। আমরা শুধু যতিচিহ্নের পরে যে আরও একটি দীর্ঘশ্বাস থেমে আছে, তার স্পর্শ পাওয়ার চেষ্টা করতে পারি।
আশ্চর্য অনুভূতিময় ঝিনুকদের কাহিনি
তানজিনা হোসেন
ভরযুবতী, বেড়াল ও বাকিরা গ্রন্থের গল্পগুলো পড়ে অন্তত তিনটি বিষয়ে একপ্রকার নিশ্চিত হওয়া যায়। এক. এই গ্রন্থের লেখক মানবচরিত্রকে কাটাকুটি করতে ভালোবাসেন দক্ষ এক ডোমের মতো, পরতে পরতে তুলে আনতে চান হূদয়ের অতল থেকে কালো কালো ক্লেদ, রক্তক্ষরণের কানাগলিপথ খুঁজতে খুঁজতে নেমে যান ভীষণ এক অন্ধকার গহ্বরে—মানুষের দীর্ঘশ্বাস ও গোপন অনুভূতিগুলো যেখানে লুকিয়ে থাকে। দুই. তাঁর গদ্য কাব্যময়। গদ্য আর কবিতার ভাষা তাঁর গল্পে একাকার যে শুধু তা-ই নয়, গল্পের বৃহদাংশজুড়ে আস্ত আস্ত কবিতা জুড়ে দেওয়া বা কথোপকথন ও গল্পকথনের মাঝেমধ্যে কবিতার ফোড়ন কাটা তাঁর বিশেষ স্বভাব। এ কথা ্পষ্ট যে লেখেন তিনি গদ্য বটে, কিন্তু ভালোবাসেন বেশি কবিতা। তাই মাঝেমধ্যে কাব্য তাঁর গদ্যকে ছাপিয়ে উঠতে চায়। আর তিন এবং শেষ, মানবীয় সম্পর্কের গভীর জটিলতা আর উত্থান-পতনগুলো তিনি পর্যবেক্ষণ করেন গভীর আগ্রহে, কেবল প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী নয়, মাতা-কন্যা, সৎ পিতা-সৎ কন্যা, দুই সহোদরা, আশ্রিত ও আশ্রয়দাত্রী—পৃথিবীর তাবৎ সম্পর্কের যে বিচিত্রমুখী জটিলতা আমাদের চারপাশে নিত্য জড়িয়ে যায়, পেঁচিয়ে যায়, উলের মতো—লেখক তা-ই নিপুণ হাতে ছাড়িয়ে আনতে চান।
সৎ বাবার যে ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে পাবলো নেরুদা আর ব্রন্টি সিস্টার্স পড়ে বড় হয়েছে রোশন আরা, সেই অমিয়র সঙ্গে প্রেম বা যৌনতা ইনস্টের পর্যায়ে পড়ে কি না সে সমস্যার জটিলতা শেষ না হতেই ‘দেয়ালা’ গল্পে ঢুকে পড়ে আরেক চরিত্র আশিক ইলাহী, যে কিনা ভালোবাসে বিড়াল, পাখি, গাইগরু ও প্রজাপতি আর রোশন আরার প্রতি যে নিজের কেলে গাই-বাছুরটার মতোই মায়া বোধ করত বিয়ের পরে। কিন্তু ‘রোশন আরার গা জ্বলে যেত ওকে দেখলে—কিন্তু আর কেই বা আছে! আশিক এলাহীরও স্ত্রী কাছে এলেই তার গর্ভস্থ অপরের সন্তানকে নিয়ে ক্লেদ বোধ হত—কিন্তু আর কেই বা আছে!’
এই নিরুপায় সহবাস আর বোঝপড়ার কাহিনি গোটা বইতে ফিরে এসেছে বহুবার, বহুভাবে। যে জীবন আমরা যাপন করি বা করছি, তা আমাদের প্রাপ্য ছিল নাকি ছিল না, এমনটা আমরা চাইনি বা চেয়েছিলাম কি না ভেবে দেখিনি, কিন্তু কী-ই বা করার আছে! জীবনের সহজ সত্যটা হলো ঠিক এই রকম। আর এটাই সাগুফতার কাহিনিগুলোর মোদ্দা কথা। যেমন ‘সং অব সিক্স পেন্স’ গল্পের নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের রূপবতী ও মেধাবতী দুই বোন যথাক্রমে বহ্নি সুলতানা আর রেবেকা সুলতানার নিরুপায় প্রচেষ্টাগুলো। যথারীতি রূপবতী বহ্নি সুলতানা রূপের জোরে তাদের লাল পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের বাথরুম থেকে, নালার পাশের অন্ধগলি থেকে বের হতে চেয়েছে বারবার, তাই বিলেতপ্রবাসী ইউসুফ জহিরকে স্বামী হিসেবে আশ্রয় করে মুক্তি খুঁজেছে সে। এখানে ফ্রিজারে ঠাসা হাজার রকমের খাদ্য, বাথরুমে বোঝাই অজস্র টয়লেট সামগ্রী, শোবার ঘরে সেন্টেড জেল-ক্যান্ডেল কত…ওয়ালপেপারে অ্যান্টিক বোটানিক্যাল প্রিন্টস…যার স্বপ্ন সে দেখত। কিন্তু এখানে তার ভালো লাগে না। মুহূর্তেই তার সত্তা এও জানান দেয়, ‘কোথায় ভালো লাগত আমার? পলাশের সঙ্গে খাসমহল নামের সেই বাড়িতে? নাহ! কখখনো না! ভালবাসার জন্য আমি খাপড়া ছাওয়া ঘরে কোনোদিন যেতে পারতাম না।’ এই হচ্ছে জীবন। এক জীবনের মধ্যে বিকল্প জীবন কাটিয়ে জানার তো সুযোগ নেই যে কোনটা ভালো হতো এর চেয়ে! ‘স্বর্গ, ধর্ম এবং পরম তপস্যা’ গল্পের সুশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলেমেয়ের সফল মা কমর জাহান ওরফে এলমা আমাদের খুবই চেনাজানা এক চরিত্র। এই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এমন মা আছেন বিস্তর, যাঁদের আজকাল আবার ‘রত্নগর্ভা’ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরও পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে যিনি এই সংসারে এসেছিলেন বহু বছর আগে, যার কাছে জীবনের সবচেয়ে সুখের স্মৃতি হলো যমজ বাচ্চা আফতাব আর সুরাইয়ার জন্ম। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি পরিবেষ্টিত পারিবারিক হাসি-ঠাট্টায় অক্লেশে যিনি বলতে পারেন, ‘তোমরা যা হয়েছ, যতটা মানুষ, তাতেই আমি খুশি।’ সেই চিরপরিচিত কমর জাহান কিনা এই বয়সে মেজো ছেলের উপহার দেওয়া একটা ডায়েরি পেয়ে কী না কী আবিষ্কার করে ফেললেন! ‘এই ডায়েরি লিখতে গিয়ে আমি অদ্ভুত একটা জিনিস টের পেয়েছি। আমার জীবন আমার বিশ্বাসের বিপরীতে—আমার স্পৃহার বিপরীতে বয়ে গেছে। এর মানে আমার অর্জন শূন্য। যা প্রাণ চেয়েছে তার উল্টোটা চর্চা করেছি। যা ঘৃণা করি—তা ভালবাসার ভান করেছি।’ গভীর পর্যবেক্ষণ আর গভীরতর মমতা না থাকলে এই চরিত্রগুলোকে উন্মোচন করা সম্ভব নয়।
গল্পকথনের ভাষায় এই বঙ্গদেশে অভাবনীয় সব পরিবর্তন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে যে বাঙালির গল্প পড়া শুরু, স্বাধীনতা-উত্তর এই বাংলায় তারা হুমায়ূন আহমেদীয় অনায়াস ঘরোয়া কথনভঙ্গি কি সৈয়দ হকীয় কবিতা-গদ্য নাকি গদ্য-কবিতা, ইলিয়াসের ইলিউসিভ ও হ্যালুসিনেটরি সিচুয়েশন তৈরির আশ্চর্য এক ক্ষমতা, এমনকি হাল আমলের প্রায় জোর করে হলেও শহুরে তারুণ্যের অকুলীন ভাষা ব্যবহার করে আধুনিক হওয়ার আরোপিত প্রচেষ্টা—সবটাই আমাদের পাঠক সানন্দে ও সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন। তবে শেষ অবধি কথা থাকে একটাই, কাহিনি পড়ে পাঠক তাতে দীর্ঘক্ষণ বুঁদ হয়ে রইলেন কি না, কিংবা একটি সুখপাঠ্য রচনার সমাপ্তিতে মনটা তাঁর সেই এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে উঠল কি না যা তিনি আশা করেছিলেন। সাগুফতা শারমীন তানিয়া মাঝেমধ্যে তাতে সফল হন বৈকি, আবার মাঝেমধ্যে তাঁর গদ্য হোঁচটও খায়। লেখকের পক্ষে এমনটা ঘটা খুবই স্বাভাবিক, এমনকি একটা গ্রন্থের একটি কি দুটি গল্প পূর্বোক্ত বিচারে সুখপাঠ্য হলেও সেই লেখককে সফল বলতে বাধা নেই, কেননা দুনিয়াতে এমন কেউ নেই যার সব রচনাই সুখপাঠ্য। তবে গল্পকার হিসেবে আবেগগুলোকে আরও একটু শাসন করাটা জরুরি তাঁর জন্য, কেননা গদ্যের ভাষা আরও খানিকটা নির্বিকার কথনভঙ্গি দাবি করে। দ্বিতীয়ত, ‘আমাদের শ্লীলতা বোধ তো কম অদ্ভুত নয়! আমরা ব্যাটাছেলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করা অনায়াসে সইতে পারি কিন্তু একটা মেয়ে পার্কের ঘাসে শুয়ে উপুড় হয়ে বই পড়ছে—তা রীতিমত অভাবনীয়’ অথবা ‘বুঝলে, ডাক্তার স্বামী পাওয়া বড় দুর্ভাগ্যের, তোমরা যাকে ভাবো স্তন, তা তার কাছে চর্বির গোলা’—এমনতরো অসম্ভব সম্ভাবনাময় উক্তির পরও একই বিষয়ে পুনরাবৃত্তির আবর্তে পাক খাওয়ার একটা অশুভ আশঙ্কাও মাঝেমধ্যে উঁকি দেয় সাগুফতার গল্প পড়তে গিয়ে। এ বিষয়েও তাঁর সাবধান হওয়া জরুরি। তবে পাঠককুলের জন্য সুখের কথা এই, পনেরোটা গল্পের মধ্যে অন্তত গোটা চার-পাঁচেক প্রকৃতই সুখপাঠ্য, এ-ই বা কি কম পাওয়া
স্বপ্নে পাওয়া কাব্যভাষা
আহমেদ মুনির
‘সামুদ্রিক প্রাণীদের ডাঙায় উঠে আসা এবং আকাশে ওড়ার বিবরণই হলো কবিতা। কবিতা এমন সব ধ্বনি খুঁজে বেড়ায় যা জানা ও অজানার মাঝখানের বিভেদ-প্রাচীরকে ভেঙে দিতে সক্ষম। অথবা কবিতা একধরনের গুপ্তবিদ্যা, যাতে বলা আছে কী করে রংধনু তৈরি হয় এবং কেনই বা তারা মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।’
পোয়েট্রি কনসিডার্ড নামের একটি লেখায় মার্কিন কবি কার্ল স্যান্ডবার্গ (১৮৭৮-১৯৬৭) এমন কথা লিখেছিলেন। যুক্তির বিচারে অচল এমন এক বাস্তবতা নিয়েই কি কবিতার কাজ? স্যান্ডবার্গের বক্তব্য থেকে অন্তত তা-ই মনে হয়। পিয়াস মজিদের মারবেল ফলের মওসুম পড়তে গিয়ে স্যান্ডবার্গ উল্লিখিত কবিতার এই ভিন্ন বাস্তবতার কথা পাঠকের মনে পড়তে পারে। যে বাস্তবতায় সামুদ্রিক প্রাণীদের ডাঙায় বসবাস এবং ওড়ার বিবরণ যুক্তিগ্রাহ্য ও সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
কবিতার এই অপার বাস্তবতাকে বাইরে থেকে বা ওপর থেকে দেখলে বিচ্ছিন্ন ও প্রক্ষিপ্ত মনে হতে পারে। কিন্তু চারপাশের প্রকট ও বাস্তব পরিপার্শ্বের ধূসর অঞ্চলকেই কবিতা শেষ পর্যন্ত দৃশ্যমান করে তোলে। এই ধূসর অঞ্চল আমাদের স্বপ্নে, তন্দ্রায়, অভ্যাস কিংবা স্বভাবের গোপন ভাঁজে অদৃশ্য থাকে। আপাত অদৃশ্য এই বাস্তবতার ভেতরেই তো কবিতার বসবাস। মারবেল ফলের মওসুম কাব্যগ্রন্থের ‘বিভাব’ কবিতায় চোখ বোলানো যাক।
‘মারবেল ফল ঋতুহীন।/স্বপ্নে ফলে।/ স্বপ্নেই এর জন্ম, বিকাশ, পরিণাম।/ তবে স্বপ্নপ্রসূ বলে তা অলীক নয়। / কারণ স্বপ্নও তো এক ভীষণ বাস্তবতা।’
স্বপ্নের মধ্যে বেড়ে ওঠা এই মার্বেল ফল যেন পিয়াসের কাব্যভূমিতেই বেড়ে ওঠে। এই ফল স্বতঃস্ফূর্ত নয়, সচেতন প্রয়াসে বানিয়ে তোলা। সচেতন নির্মাণের এ চিহ্ন পিয়াসের প্রায় সব কবিতায় দেখা যাবে।
সংগীতের সুরের মতোই তিনি নতুন এক কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন। তাঁর এই ‘শিমুল ও পলাশভাষাকে’ সংগীতের সুরের মতোই পড়তে হবে। স্ফটিকস্বচ্ছ দৃশ্যচিত্র সেখানেই হয়তো চোখে পড়বে না। তাই দেখার চেষ্টা নয়, পিয়াসের কবিতাকে অনুভূতির স্রোতের মধ্যে ফেলে দিতে পারলে তাঁর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবেন পাঠক।
পিয়াস লেখেন, ‘তমসা মিনার ফেটে/ বেরিয়ে গেছ। / আরও উঁচু আঁধারের / উড়ন্ত চুম্বনের/ পিছু পিছু গেঁথে
এখন শুনছ/ ফুলের স্বর।/ নিরক্ষর তুমি;/ এই গন্ধভাষায়/ জরিপ করো স্বপ্ন’ (কবি)
পিয়াসের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়, হুট করে শেষ হয়ে গেল। কখনো তিনটি বা দুটি এমনকি একটি শব্দও পাওয়া যাবে তাঁর কবিতার একেকটি লাইনে। ‘সুরভি’ কবিতাটি এমন: ‘আমার/ মৃত্যু মুহূর্তের/ উপর/ কে / যেন / জাফরান / ছিটিয়ে/ যায়।’
ক্ষীণকায় বলেই তাঁর কবিতার রেশ দীর্ঘস্থায়ী। মৃত্যু মুহূর্তের ওপর জাফরান ছিটিয়ে যাওয়ার অনুভূতির ঘাড়ে তিনি অহেতুক শব্দভার চাপিয়ে দেন না। বরং শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নৈঃশব্দ্যকেও তিনি প্রকাশিত হতে দেন। নৈঃশব্দ্যও যে কবিতারই অংশ। উচ্চকিত, শোরগোলপূর্ণ পঙিক্ত, যাকে এলিয়ট একদা বলেছিলেন, কেওয়াস বা হট্টগোল; সেই হট্টগোল খুব স্বাস্থ্যকরভাবে অনুপস্থিত পিয়াসের কবিতায়।
পিয়াস কি ছন্দের মুক্তি চেয়েছেন? মুক্ত-ছন্দের বা ছন্দহীন কবিতাই কি লিখতে চেয়েছেন তিনি? সে জন্যই কি যেকোনো মাত্রায় থামার স্বাধীনতা নিয়েছেন তিনি? কবিতার চেহারায়ও এনেছেন নতুনত্ব। কেবল তাই নয়, কবিতা কখন কোথায় শেষ করবেন সে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও মৌলিকত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ‘দৃশ্য’ নামের কবিতাটি পড়া যাক, ‘একটা নদী আমাকে দ্বিধাবিভক্ত করে/ তিনটা শেয়াল সেটা দেখে/ এবং / ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা।’
৫৬ পৃষ্ঠার এই কবিতার বইতে ৪৫টি কবিতা (‘বিভাব’ কবিতাসহ) গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। অন্ধকার বা তমসা বা কালো তাঁর প্রিয় বিষয়। তিনি লেখেন:
‘আমি যতই যেতে চাই অন্ধকারের দিকে/ চারিদিকে ততই তারাদের আজন্ম প্রহরা। / আর কে যেন সন্ধ্যার শান্ত গান ছেনে/ শিল্পহারা পিয়াসের জন্য তুলে রাখে / রক্তিম রাগমালা।’ (পারমিতা)
পিয়াসের মতে, ‘ঘন যামিনী সব ফুলের মাতৃভাষা।’ আর হয়তো সে কারণেই অন্ধকার, পাপ, গ্লানি তার কবিতার হাত ধরে আছে। তিনি কসাইখানাতেই ফুলের বাগান আবিষ্কার করেন। রক্ত আর ফুলের পাপড়ি যেখানে একসঙ্গে মিশে গেছে। ‘মাংস ও গোলাপের’ এই অদ্ভুত কনট্রাস্ট তো চারিদিকেই ছড়িয়ে আছে। এই বৈপরীত্যের কথা তাই পিয়াসের কবিতায় আসবে এটাই স্বাভাবিক।
একটি আহা ধ্বনি
সোহেল হাসান গালিব
শুভাশিস সিনহার তিনটি কবিতার বই পড়ে মনে হয়, একটি কবিতাই লিখে চলেছেন কবি। এর সদর্থক ও নঞর্থক দুটি দিকই আছে। প্রথমত, শুভাশিসের কবিতায় এমন জিনিস খুঁজে পাই আমরা, যার ভেতর দিয়ে চেনা যায় তাঁকে বিশেষ করে। অর্থাৎ কবিতায় একটি ভূগোল নির্মাণ করতে পেরেছেন তিনি। দ্বিতীয়ত, কবিতায় ‘জিনিস’ খুঁজে পাওয়াটা এই সময়ে খানিকটা দ্বিধায় ফেলে আমাদের। বক্তব্য, বস্তু ও ভূগোলনির্ভরতা এ কালের অগ্রসর পাঠকের কাছে অর্ঘ্য পাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ভাষা কীভাবে অর্থভার, ভাব কীভাবে বস্তুভার ছেড়ে যায়, ছাপিয়ে যায়, তা নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা আমরা এত দিন শুনে এসেছি। সেসব নিয়ে ফের তর্ক করা বৃথা।
হওয়া না-হওয়ার গান কাব্যে শুভাশিস ভাষা ও ছন্দের কভেনশনের সঙ্গে একধরনের দ্বৈরথে অবতীর্ণ। দেখতে পাই, বেশ কিছু ত্রিপদীর সমাহার এতে ঘটেছে। সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে তাঁর পারদর্শিতা প্রশংসনীয়। অন্ত্যমিলও নিখুঁত (অবশ্য ‘ঘুরব ক্যান’-এর সঙ্গে ‘কি লেনদেন’-এ মিলটা জুতসই হলো না)। ক্রিয়াপদে মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ, বাগ্ভঙ্গিতে জীবনানন্দ প্রায়শ উপস্থিত। কিন্তু অন্তর্গত কী এমন তাৎপর্য আছে, কী বিনির্মাণ ঘটল তাতে যে ঐতিহ্যের পুনরুপস্থাপন একটা নতুন দিশা দেবে—এই প্রশ্ন গ্রন্থপাঠশেষে কিছুটা সময় নিরুত্তর করে রাখে। কবিতায় শুভাশিস নিজেই বলেছেন, ‘যে-সকল চিত্রকল্প পুরনো বেশ্যার মতো অসুখে পড়েছে/ যে-সকল অলঙ্কার সারা দিন পথহাঁটা পায়ের মোজার মতো/ কটুগন্ধবহ/ যে-সব উপমা দুই সতীনের প্রথাগত বিবাদ, কলহ/ তাদের বিদায়/ আত্মখুন, রক্ত, বমি, ঘর্ম, ক্লেদ এসে/ কলমেরে সেলাম জানায়।’
কোথায় সেই সেলাম? একবার শুধু শোনা গেল, ‘অনেক হারিয়ে পাওয়া ব্যথাটুকু আজকে ঘুমোক/ যন্ত্রণা বলো না—কেন আপন ভূমিতে পরবাস…’। জানা গেল, সর্পিল বাতাসের পিঠ থেকে স্থির আগুনের মুখে, দারুণ জিহ্বায় বারবার পিছলে পড়ার কথা। এ ছাড়া সমস্ত বইটিতে এক রূপমুগ্ধ কিশোরের ইতিউতি আসা-যাওয়া। বলছি ‘রূপমুগ্ধ’, কেননা ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীর মতোই ডিটেইলিংয়ে তাঁর আগ্রহ। এবং তা কিশোরের, কেননা দৃশ্যের আড়ালে যে প্রশ্ন ও চিন্তার আঘাত কবিতাকে প্রাপ্তবয়স্কতার মর্যাদা এনে দেয়, তার অভাব শেষ পর্যন্ত লুকানো যায়নি। তবে সে অভাব কিছুটা পূরণ করতে পেরেছে কবির লিরিকধর্মিতা। এমনই একটি কবিতা ‘অন্তরাগ’। এই কবিতার শেষে কবি বলছেন, ‘নদী-সমুদ্রের পাহাড়গর্ভের/ অন্তরীক্ষের পার-অপার/ তখন অনর্থ জাগাবে কী অর্থ/ বাক্যধ্বনিনাশা দুর্নিবার!’
কথাটি সমালোচক হিসেবে আমাদেরও। আমরাও বলতে চাই, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের মধ্যে যে বিচিত্র ভাঙন, সেসবের দিকে চোখ ঠেরে, কেবল কবিত্বপূর্ণ বিবরণীতে আর সাড়া জাগে না মনে। দেশ-জাতি-মানব-ভূগোলের যে অবভাসিক আবাহন স্বাদেশিকতা, তার থেকে আমাদের মন সরে এসেছে অনেক আগেই। অন্তর্বাস্তবতার উন্মোচনে এসব উপাদান অনিবার্যভাবেই উঠে আসে কবিতায়, কিন্তু বিচূর্ণিত হয়ে। পট-প্রেক্ষিত সেখানে মুখ্য বিষয় নয় আর।
এই মাত্র উচ্চারিত হয়ে যা হারিয়ে গেল, হারিয়ে যায় সায়াহ্নের অন্ধকারে, যেন বা তাকেই ধরতে চেয়েছিলেন কবি তাঁর হওয়া না-হওয়ার গান-এ। ব্যক্তির অনুভূতিগুলো কবিতায় প্রকৃতির অনুষঙ্গে রূপান্তরিত না হয়ে বরং প্রকৃতির স্বতঃশ্চল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর ব্যক্তি জেগে উঠতে চায় এখানে। ফলে বিমূর্ত সত্তাটি, তার অভিব্যক্তিসমেত হয়ে পড়ে আরও দূরবর্তী। তাই এ কাব্যে যা গান হয়ে ওঠার কথা, তা কেবল মৃদু সিম্ফনিতেই শেষ হয়ে যায়। দৃশ্যপুঞ্জের আড়ালে রেখে যায় একটি অস্ফুট আহা ধ্বনি।
কবিতাতীর্থের খোঁজে
সফেদ ফরাজী
যে পথে বিস্মৃতি-বিলাপ পড়ে আছে, সেই পথে জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা বলার দিন বুঝি শেষ হয়ে এল। দূরের আকাশে জেগে থাকা মিটিমিটি তারার সঙ্গে মন খারাপের গল্প বলার লাস্যময়ী রাতও যেন ম্লান হয়ে গেল দেখতে দেখতে। মুহূর্তেই চেনা পরিবেশ, মানুষ, সম্পর্ক, এমনকি ব্যক্তিগত সবকিছুই কেমন যেন অচেনা হয়ে যায়, গুপ্ত আলোর সন্ত্রাসে। নিঃশব্দে সে আলো রক্তের পাশে বয়ে চলে। তখন মনোসরণির ওই পারে গোপন খোঁপার ফুলে, অদ্ভুত কোনো বাস্তবতার প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়ে, জন্মদাতাকে সূর্যাস্ত হতে দেখে, অন্য কোথাও পালাতে চায় সংবেদনশীল মন; যেন পালাতে চেয়েছেন কবি নির্লিপ্ত নয়নও, রাত্রির অদ্ভুত নিমগাছ তলায়, সাধুর অন্ধকারে, তীর্থ ভেবে।
কিন্তু তীর্থের দেখা পাওয়া কি এতই সহজ, নিজের গর্দান না হারিয়ে, পাগলের কাঁটাতারে, ঘন নির্জনতায়? তাই তো কবন্ধ-মানব হয়ে, স্তব্ধ পথে, দিনার ছাড়াই, স্পষ্ট আগুনের সঙ্গে স্বপ্ন নিয়ে, চোরা সাইকেলের পিছু পিছু, উমাচরণ কর্মকারের বাড়ির দিকে পাঠককে নিয়ে যেতে চান কবি। তবে সন্দেহাতীত রক্ত ঝরানো উমাচরণের বাড়ি কোথায়, কত দূর, তা ঘোর রহস্যঘেরা। এইভাবে তাঁর কবিতায় অস্থির শব্দের ডুবোমাছিরা নীল নীল আলোর স্টোভ জ্বালিয়ে রাখে। যেন অমীমাংসিত পথের বাঁক, প্রতীক-সংকেতের বুদ্বুদ, প্রতিভাষা-পরিভাষার রাজত্ব ও কারুবাসনার নিঃশ্বাস ছড়িয়ে আছে এ গ্রন্থের পরতে পরতে।
রাত্রির অদ্ভুত নিমগাছ নির্লিপ্ত নয়নের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এর ৩৬টি কবিতায়, গভীরতর জীবনাভিজ্ঞতার গোপন কোনো ডায়েরির বুক খুঁড়ে, কবি বুঝি উন্মোচন করতে চাইলেন খনিশ্রমিকের আয়না। যে আয়নায় ব্যক্তি-মানুষের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন, আনন্দ-বেদনা-হাহাকার, শ্লেষ, রূঢ়তা, দ্বিধাহীন নঞর্থক সত্যের সন্ধান—সবই মিশে মিশে একাকার। যেখানে মনোবাস্তবতা এবং বহির্বাস্তবতার মিথস্ক্রিয়ায় চলে চিরন্তন Self-এর তথ্য-তালাশ, অর্থাৎ নিজের ভেতরের ‘আমি’র দ্বান্দ্বিক অবস্থানকে কখনো হূদয় দিয়ে, কখনো বুদ্ধি দিয়ে, আবার কখনো বা নির্বুদ্ধি দিয়ে দেখার চেষ্টা লক্ষ করা যায়। যেমন, ‘কুয়োর মাঝে জাল পেতে আছি, রূপকথায়/ ভস্মপ্রায়, আমি কোন লোক!’, ‘কে যেন আমায় চিনতে পারে না, আমি ও আমার ছায়া কেউ কাউকে চিনছি না।’ কিংবা ‘আমার লাশের ভেতর মম ডাকনাম কুড়াতে কুড়াতে আজও জানা হলো না—বিহ্বল প্রশ্নের চোখে অনর্থ কেন জেগে থাকে বিস্মিত মোমদানি!’
নয়ন হয়তো বা প্রচল সৌন্দর্যবোধের বুকে তীব্র কোনো কুঠার চালিয়েই শিল্পের জগৎ নির্মাণ করতে চান। তাই চেনাজানা অনুষঙ্গ ও পরিস্থিতিকে নবতর শব্দবন্ধ, বাক্যবন্ধ ও বাকচাতুর্যে অন্যতর অর্থের দিকে নিয়ে যাওয়াটা যেন তাঁর স্বভাবগত। ‘অশেষ বিকেলফুল’, ‘চাঁদবাতাস’, ‘তারাভরা নরকরাত্রি’, ‘উন্মাদের অশ্রুফল’, ‘শোচনা লুপ্তির দিন’, ‘কব্জি কাটা দিন’, ‘চন্দ্র-ফুড়ুৎ রাত্রি’—এ ধরনের বহু শব্দবন্ধের সাবলীল প্রয়োগ আছে তাঁর কবিতায়।
বাক্যের মধ্যে চোরাফাঁদ পেতে রাখাতেই পছন্দ বোধ করি নয়নের। যেখানে একবার প্রবেশের পর সহজে বের হওয়া যায় না, যেখানে নৈঃশব্দ্যও গভীর মনোযোগ দাবি করে। ‘রক্তজবার মর্মক্ষরণ বুঝে ওই চাঁদ/ তার আগুন বাড়িয়ে দিল/স্তব্ধতার নরকে সময়’, ‘রাত্রি নেমেছে প্রগাঢ় স্বর্ণচ্যুতির এলিয়ে পড়া/ শরীরের সে ভাষায়!’, ‘খুচরো পথের শেষে দূর বললেই উঁকি দেয়/ কালো ঘোমটা—গোপন জাদুর ক্ষত’, ‘জন্মের পেছন পারে/ রাস্তায়, প্রত্যেক রাস্তায় একটি আজব মাটির গাছ/ গাছের নাম মা’, ‘এ দেহ লহরিসম, সুরের পরাগ’, ‘শাদা পৃষ্ঠাকে মনে হলো শীতকালীন নার্স!’, ‘বাবা’ শব্দটি লিখতে গিয়ে মনে হলো, কখনো যাদের কাছে চিঠি লেখা হয় না এমন মুখ, ‘দুর্দান্ত লণ্ঠন হাঁকিয়ে বহু দিন ছুটে গেছে বাড়ির পাশের বয়ে যাওয়া রাস্তা’, ‘বিষণ্ন আপেলগাছ থেকে ঝরে পড়ছে অন্ধের গতিসূত্র’—এভাবে শব্দের জুতসই ব্যবহার, ভাষাভঙ্গিমা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, চিত্রকল্প ও ধ্বনি চাতুর্যে সুরের মুনশিয়ানাই মূলত নয়নকে সমসাময়িক অনেকের মধ্যে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।
আবার যুক্তির শৃঙ্খল ভেঙে প্রতিযুক্তির দিকে পাঠকের চিন্তাকে নিয়ে যাওয়ার একটা ঝোঁকও দেখা যায় তাঁর কবিতায়। তবে এ কবির পরিমিতিবোধ (দু-একটি কবিতায় ব্যতিক্রম) যেমন আছে, তেমনি বহুরৈখিক তার স্নায়ুর নদী, চিন্তার জগৎ। সেই জগৎ অবশ্য কিছুটা অস্থির প্রকৃতির, পরাবাস্তবময়, কিন্তু নির্জলা। কবিতার টোটালিটিকে বর্ণগন্ধসহ আঁকতে চাওয়ার নিরলস চেষ্টাও আছে সেখানে।
বেশির ভাগ কবিতায়ই তাঁর কল্পছবি সদূরপ্রসারী, একই সঙ্গে সহজ ও তীব্র উজ্জ্বলতা ছড়ায়, কখনো বিমূর্তায়নের আবেশ আচ্ছন্ন হয়, আখ্যানরূপে ফুটে ওঠে। ‘পাতাটি ঝরে পড়ার আগে নিঃসঙ্গ লোকের/নিঃশ্বাসগুলো ছুঁয়ে দেখে অতলে’, ‘নিঃশব্দ হওয়ার পর কেন আমার হাতঘড়িতে একই সঙ্গে জেগে উঠবে ২৪টি উন্মাদ পানশালা’, ‘চুপচাপ একটি লাল অ্যাম্বুলেন্স অন্ধকে চিঠি লিখছে’, ‘শাদা খাতায় উবু হয়ে জিরিয়ে নেয় নির্জনতার সাম্প্রতিকতম বঞ্চনা’—এ রকম পঙিক্তর পর পঙিক্তই কেবল নয়, আস্ত কবিতারও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। যেখানে জীবনের ক্লেদ, আশা-নিরাশার দোলাচল, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ও অস্থিরতাগুলো মুখ তুলে চেয়ে থাকে নীরবে, অনিঃশেষ যাত্রায়। তবু কবি যখন বলেন, ‘আমাদের বুকের ভেতর স্টেশনের লাল পতাকা উড়িয়ে বৃদ্ধ এক গার্ড হুইসেল দেয়’, তখন দূরের কোনো গন্তব্যে যে এই কবি যাত্রা শুরু করছেন, তা বুঝতে আমাদের কি আর বাকি থাকে?
সফেদ চপেটাঘাত
কাজল রশীদ
গল্পটা ভাতের। তাই ঊহ্য থাকে না কিছু। বিশেষ করে বাংলায় ও বাঙালি সমাজে? ‘ভাত বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য।’ ছোটবেলায় যার ইংরেজীকরণ করতে হতো পরীক্ষার খাতায়, মাস্টার মশায়ের সম্মুখে। ভাতের গুরুত্ব বর্তমানে আছে, অতীতেও ছিল। ঈশ্বরী পাটনীর গল্প যার বিরল ও ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। বদরুন নাহারের ভাতগল্প এসবেরই প্রতিনিধিত্ব করেছে। যা ভাতের গল্প—একই সঙ্গে জীবন, দ্রোহ এবং প্রেমেরও। লেখক একই সঙ্গে বিবিধ বিষয়কে উপজীব্য করেছেন। গল্পগুলোর নামকরণ থেকেও বিষয়টা অনেকখানি স্পষ্ট। মোট আটটি গল্প: ‘রূপকথা’, ‘ভাতগল্প’, ‘গোল্ডফিশ’, ‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া’, ‘এপ্রিল ফুল’, ‘লাল টুকটুক দিদিমণি’, ‘অতঃপর জুলিয়েট তাজমহলের সন্ধান পাইল’ ও ‘পতাকাটি লাল ছিল’।
বইয়ের নামগল্প ‘ভাতগল্প’। অভিজ্ঞতায় যাদের ঈশ্বরী পাটনী আছেন, এই গল্প পাঠ তাঁর অদৃশ্য উপস্থিতি ঘটায়। যিনি চেয়েছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।’ বদরুনের গল্পের মানুষদেরও অমন চাওয়া। সঙ্গে রয়েছে দ্বন্দ্ব ও দ্রোহ, যা গল্পগুলোকে নাটকীয় করেছে। ইতিহাসের ভেতর দিয়ে, সমাজ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ঘটনা এগিয়েছে। বিষয়কে বৈচিত্র্যময় করেছে। মূল বিষয়কে কেন্দ্রীভূত করে লেখক গল্পের শরীর নির্মাণ করেছেন। যা স্থূল নয়। মেদহীন, ঝরঝরে, নিপাট মানুষের অবয়বে ঋদ্ধ। যা ভালো লাগে না শুধু, অন্তর্গত অনুভবেও দোলা দেয়। সৃষ্টি করে আলোড়ন। জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাত প্রশ্নেরা বানের জলের মতো ছুটে আসে। লেখক ‘রূপকথা’য় শোনান, মায়েরা যে গল্প শোনান শিশুদের সেই গল্প। যার দেহকাঠামোজুড়ে ঈশ্বরের পুত্রের অনিবার্য উপস্থিতি। ভাতগল্প সন্ধান দেয় একজন ভাতের দাসীকে। যার শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে। কিন্তু যার শেষ নেই, ডিজিটাল বাংলাদেশেও।
‘গোল্ডফিশ’ পড়তে পড়তে আমাদের আরিয়ানা ফাল্লাচিকে মনে পড়ে। কাছের-দূরের কিংবা বিপরীত-ভাবনায় তাড়িত হয়েই হাত বাড়িয়ে দাও মস্তিষ্কে উঁকি দেয়। বদরুনের গল্পে রয়েছে, ‘—তুমি এত মোটা কেন? তোমার পেটে কী হয়েছে? আমি তুবাকে বললাম—তোমার আন্টির পেটে একটা বাবু আছে। কথাটা শোনামাত্র তুবা চিৎকার করে উঠল, ওকে মারো…ওকে মারো…আন্টিকে মারো…আমি তুবাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে চিৎকার করে বলতে থাকল—আন্টি বাবুকে খেয়ে ফেলেছে…ও বাবু খেয়ে ফেলেছে।—ডাক্তার, তুবার ধারণা হয় পেটের মধ্যে বাবু মানে, নিশ্চয়ই বাবুটা গিলে খেয়ে ফেলেছে।’
‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া’ লাইলির গল্প, যা বাংলাদেশের গল্প। কেননা, ওর বিক্রীত শ্রম থেকে তো সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসে। কিন্তু তাতে লাইলির কী হয়, কী হয়েছে এ দেশের অগণন লাইলির? বেনসন সিগারেট শোভাবর্ধন করে শ্রমিক নেতার ভালোবাসাহীন ঠোঁটে। ‘লাল টুকটুক দিদিমণি’ও এ রকম শ্রমে-ঘামে ভেজা নোনাজলের মানুষদের গল্প। গল্পকার শুধু চেনা চরিত্র নয়, তুলনামূলক কম চেনা চরিত্রকেও নিপুণ শিল্পীর মতো এঁকেছেন। যার সহজিয়া অথচ সূক্ষ্ম উপস্থাপন ঘটেছে ‘এপ্রিল ফুল’, ‘অতঃপর জুলিয়েট তাজমহলের সন্ধান পাইল’, ‘পতাকাটি লাল ছিল’ গল্পেও।
বদরুন নাহারের তৃতীয় বই ভাতগল্প। এর আগে লিখেছেন গল্পগুলো বদ্বীপের ও ঢেন্ডনপা’র দেশে। সম্পাদনা করেছেন গল্পের ছোট কাগজ শূন্যপুরাণ। গল্পকারের অস্থিমজ্জায় গল্পের নিবিড় বসবাস কিরূপে, তা অনুমিত হতে কষ্ট হয় না। আলোচ্য বইয়েও নিষ্ঠাবান, প্রতিশ্রুতিশীল একজন গল্পকারকে খুঁজে পাওয়া যায়। যিনি প্রবল স্রোত থেকে অনেকখানি আলাদা পথে হাঁটেন। ইতিবাচক দিক হলো, তাঁর গল্প আমাদের ভাবায়, বোধকে উসকে দেয়। চেনা পরিধির ভেতরের বিষয়াবলিকেও দেখিয়ে দেয়।
মানুষের জীবন যেমন শুধু সাদা-কালোর নয়, তাতে ধূসর রংও আছে। অন্যান্য রংও কমবেশি থাকে নিশ্চয়। বদরুনের গল্পে এই সত্যের উপস্থিতি উঁকি দেয়, যা তাকে ভিন্নতা দেয়। ক্রমচর্চায় এর প্রকাশ ও উপস্থাপন কৌশল রপ্ত হলে তিনিই হয়ে উঠতে পারেন একজন সার্থক গল্পকারের প্রতিভূ। অবশ্য গল্পগুলোর বর্ণনায় কাব্যে সুষমার আধিক্য রয়েছে। ইচ্ছাপ্রণোদিত হোক বা না হোক, লাগাম টানার পাশাপাশি প্রয়োজন বাড়তি সচেতনতা। না হলে পড়ার আনন্দে, কাব্যের সৌন্দর্যসুধার তোড়ে, বিষয়ের মনোযোগ ক্ষুণ্ন হয়। অনেকটা পেইন্টিংয়ের বক্তব্য না বুঝে শুধু ভালো লাগার আনন্দ পাওয়ার মতো।
বদরুন যে এমনটা চান না, গল্পগুলো সে কথাই বলেছে। কেননা তিনি গল্পের মধ্য দিয়ে দ্রোহের খেলা খেলেছেন। এ বড় কঠিন খেলা; যাতে তিনি সিদ্ধহস্ত বলেই প্রতীয়মান হয়। কেননা ভাতের রঙের মতোই তাঁর দ্রোহ সফেদ রঙা। আবার এভাবেও বলা যায়, ভাতগল্প-এর গল্পগুলো পড়তে পড়তে কোথায় যেন চপেটাঘাতের শব্দ শোনা যায়। যাকে বলা যায় সফেদ চপেটাঘাত। কেননা, সেখানে ভাঙনের শব্দ নয়। বিনির্মাণের পুণ্যস্রোত খেলা করে। চেতনায় রং-বেরঙের প্রশ্নেরা ভিড় করে। যা বিনম্রতার দীক্ষা দেয়, আবার শিরদাঁড়া টানটান করার মন্ত্র শোনায়। দ্বিবিধ মিথস্ক্রিয়ার রেশ না ফুরোতেই, ভাতগল্প-এর দুটি লাইন আবাসিত হয় করোটিতে, ‘বধূকন্যা শ্যামলিমা উর্বশি/ শঙ্খের চুড়ি দিলাম তোর দুই হাতে/ শুধু আমার সন্তানেরে/ এক থালি ভাত দিয়ো উপবাসে।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২২, ২০১১
Leave a Reply