স্বপ্নভঙ্গের আখ্যান
আখতার হুসেন
জুবোফিস্ক বুলভার—মশিউল আলম \ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন \ প্রকাশকাল: ২০১১ \ প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল \ মূল্য: একশ দশ টাকা
চার্লস ডারউইনের মতবাদে গভীরভাবে বিশ্বাসী অথচ সৃষ্টির আদিরহস্য সম্পর্কেও যে মানুষটির ‘ঔৎসুক্য এখনো প্রায় বালকের মতো’, ১৭ বছর ধরে মস্কোয় প্রবাসী সৌমেন রায়, তাঁর সহকর্মী, শুভার্থী এবং তাঁর কর্মস্থল নিয়েই এই ক্ষুদ্র কলেবরের উপন্যাসের আবর্তন।
যে পরিবারটি সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় ভারতে প্রবাসী হয়নি, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যারা ভিটেমাটি ছেড়ে এক পাও নড়েনি, সেই পরিবারের ছেলে সৌমেন প্রবাসী। প্রবাসী ‘রাজধানীর নামী কলেজে শিক্ষকতায় মতো সম্মানজনক ও সচ্ছল চাকরি ছেড়ে, শত শত ছাত্র-সহকর্মী, শিক্ষিত-সংস্কৃতিমান সমাজের সমাদর, অজস্র বন্ধুবান্ধবের সখ্য—সবকিছু ফেলে…। ‘কারণ’, লেখকের ভাষায়, ‘এই প্রবাস তাঁর স্বপ্নের মধ্যে ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তাঁর আরাধ্য’; ছিল তাঁর কাছে ‘সত্যিকারের এক রূপকথার দেশ।’ যেখানে আসার পর ভুলে পলকের জন্যেও ‘মনে হয়নি এটি বিদেশ-বিভূঁই’। মনে হয়েছে, এ যেন তাঁর ‘আরেক মাতৃভূমি’।
স্মর্তব্য, এই উপন্যাসের কাহিনির উন্মোচনকাল ১৯৯১ সাল। এ হচ্ছে সেই সময়, তার আরাধ্য রূপকথার সোভিয়েত দেশে তখন চলছে গ্লাসনস্ত-পিরিস্ত্রোইকার জবরদস্ত দাপাদাপি। সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য অনেক কিছুর মতো তার ডামাডোলে বন্ধ হয়ে গেল বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনুবাদ প্রতিষ্ঠান ‘প্রগতি প্রকাশন’। এই প্রতিষ্ঠানেই এতদিন কর্মরত ছিলেন সৌমেন রায় এবং তাঁর অন্যান্য অনুবাদক সম্পাদক সহকর্মী, সতীর্থ ও শুভাকাঙ্ক্ষী। বেকারত্বের অভিশাপ বরণ করার মুখোমুখি হন বাঙালি এবং রুশী মিলিয়ে প্রগতিতে কর্মরত সবাই। প্রায় সবারই প্রশ্ন, ‘…প্রাভদা থাকচে, ইজভেস্তিয়া থাকচে…প্রগতি থাকতে পারত না? লাভজনক হতে পারত না?’
… … … সহকর্মী নিবেদিতপ্রাণ সমাজতন্ত্রীর মুখে শোনেন ঈশ্বরের নাম, দেখেন সত্তর বছর ধরে বন্ধ থাকা গির্জাগুলোর মরচেপড়া দরজাগুলো খুলে যেতে, কমিউনিস্ট-অকমিউনিস্টদের সার বেঁধে তাতে যেতে দেখেন মোমবাতি আর টাকা-পয়সা নিয়ে, দেখেন মুহুর্মুহু খুনখারাবি। দেখেন রুটি বা খাবারের দোকানগুলোর সামনে দীর্ঘ লাইন, দেখেন তাদের মালিকদের বেকার হওয়ার ফলে পোষা কুকুরদের গৃহহীন আর বেওয়ারিশ হওয়ার করুণ দশা।
স্বদেশে থাকা বন্ধু মীজানকে সোভিয়েতের এই পতনের মুখে সৌমেন চিঠি লিখছেন এই বলে, ‘মীজান, এসব কি আমার পলায়নপরতা? আমি কি কখনো রাজনীতি-সমাজনীতি বুঝতাম?…এখন যদি তুমি আমাকে জিজ্ঞেস কর, সব মিলিয়ে কী বুঝলাম? আমি কোনো উত্তর দিতে পারব না। শুধু বলতে পারব, আমি এক গরিব দেশের অমানবিক সমাজের বাসিন্দা ছিলাম বলেই হয়তো সমাজতন্ত্রে আস্থা স্থাপন ছাড়া আর কোনো বিকল্প আমার জন্য ছিল না। ধনবাদী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা তো আমাদের সসম্মানে বেঁচে থাকার কোনো বিকল্প পথ দেখাতে পারেনি।…
“মীজান, আজ মনে প্রশ্ন জাগছে, আমি কি ধোঁকা খেয়েছি? শুধু এক চোখ দিয়ে দেখেছি? আর্থার কোয়েসলারের ডার্কনেস অ্যাট নুন-এর সব ভয়ংকর কাহিনিকে বুর্জোয়া প্রচারণা বলে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি?’ এই মতো প্রশ্নের পর প্রশ্নের তিরে নিজেকেও যেমন, তেমনি অন্যদেরও ুবিদ্ধ করেন। তাঁর মতো এ বইয়ের অন্য চরিত্রগুলোও সোভিয়েত রাজের পতনের মুখে দিশেহারা জাহাজের যাত্রীদের মতোই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, উদ্বেগাকুল এবং কূল-সন্ধানী।
প্রায় প্রামাণ্য এই উপন্যাস শেষ হয় এইভাবে: “সৌমেন রায়ের চোখে এখন ক্লান্তির ঘোর। “তিনি নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন ১৭ জুবোফিস্ক বুলভারে প্রগতি প্রকাশনের ভবনের প্রায়ান্ধকার দীর্ঘ করিডরে। … … …
“সৌমেন ফিসফিস করে ডেকে উঠলেন, ‘নাতাশা! ভালোদিয়া!’
“‘তাভারিশ রায়!’ উঠে দাঁড়াল নাতাশা।
“‘কী করছেন আপনারা?’
“‘লাশগুলোকে মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’
“‘মর্গে?’
“‘হ্যাঁ, মর্গে! একটি মহাবিপ্লবের সত্তর বছরের পুঞ্জীভূত ইতিহাসের সব সত্যমিথ্যা নিয়ে তারা মর্গে শুয়ে থাকবে…’
“নাতাশার এই ঘোষণার প্রতিবাদে কিছুই না বলে বেরিয়ে আসতে উদ্যত হলেন সৌমেন রায়।
“তখন পেছন থেকে ডেকে উঠল ভালোদিয়া, ‘তাভারিশ রায়, দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। আমরা এক বিরাট পরীক্ষায় নেমেছিলাম। পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে, তাতে কী?’
“সৌমেন কিছু না বলে আবার হাঁটতে শুরু করেন দীর্ঘ করিডর ধরে। করিডর তাঁকে নিয়ে যায় সিলেটের পাথারিয়া পাহাড়ে। সেখানে এখন নীরবে সন্ধ্যা নেমেছে।”
এই আমাদের, পাঠকদের মনেও নামে সন্ধ্যা। এবং জাগে জ্বলন্ত একটা জিজ্ঞাসা। মিথ আর কঠিন বাস্তবতার জগৎ যে দুই ভিন্ন মেরু, সেই বোধে আমরা জারিত হতে থাকি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৫, ২০১১
Leave a Reply