নাইবউদ্দিন বিক্রি হয়ে গেছেন। দশ হাজার টাকা রফায় তাঁকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বিক্রি যে করেছে, উটকো কেউ নয়, তাকে কানাশ্যাল ডাকে তার লোকেরা। প্রকৃত নাম আবু সুলেমান। তার লোকেদের ধারণা, সে কানা শেয়ালের মতো চতুর। সে নিজেও মনে করে এটা। এবং কানা শেয়াল ভাবে নিজেকে। কানা শেয়াল থেকে কানাশ্যাল। আর মাত্র এক…না, দুই…দুইটা মিনিট পেলে সে তার নামের মাহাত্ম্য দেখাতে পারত। কিন্তু আজ শনিবার বলে রাস্তাঘাট ফাঁকা। প্রেসক্লাব থেকে একটানে বাস শাহবাগে চলে এসেছে। এই এলাকা তার এখতিয়ারে না। বাধ্য হয়ে ধরা মুরগি বিক্রি করে দিতে হয়েছে। আফসোস! তবে দশ হাজার টাকা সে পাবে। শাহবাগ এলাকার থানেদার গাইট্টা। সে আরও বড় রুস্তম। গাইট্টা, কারণ তার গিঁটে গিঁটে প্যাঁচ। আট প্যাঁচ দিয়ে ধরে মুরগিকে। এমনিও বিটল কম না। বলেছে, ‘পাললি না! কানাশ্যাল হয়েও পাললি না! এহ্-হে-হে-হে! এহ্-হে-হে-হে!’
কানাশ্যাল গাইট্টার অপমান ধরেনি। দশ হাজার টাকার মুরগি। বলেছে, ‘পাললাম না। ভিজা মুরগি।’
‘ভিজা মুরগি? এহ্-হে-হে-হে!’
গাইট্টার মতো তার হাসিও বিটল। কিন্তু সহ্য করা ছাড়া উপায় কী আর? এ রকম বিটল পরিস্থিতিতে?
কানাশ্যাল সেরে এনেছিল প্রায়। কিন্তু ভিজা মুরগি ধাউড় কম না। ঠায় তাকিয়ে থাকল তার দিকে। একবার যেমন চোখ ইশারাও করল। কী ইশারা? বাণিজ্য হবে না? কানাশ্যাল যত দূর ইয়াদ করতে পারে, গত বিশ বছরের মধ্যে এ রকম মুরগি সে তার এলাকায় দেখেনি। ছাব্বিশ বছর ধরে আছে বিজনেসে। মায়াকাটরার জুলমত ওস্তাদের সাগরিদ। ওস্তাদ থাকলে খারাবি ছিল আজ কপালে। ‘তোরে কানাশ্যাল কয় ক্যা মাইনষে? তুই কি শ্যাল? তুই অইলি বিলাই! কানা বিলাই! কানা বিলাই বুজ্চস?’ আহারে! ওস্তাদ! আরও কত কথা যে বলতেন। বিরাট আফসোস! আতকা এন্তেকাল হয়ে গেল তাঁর!। কথা নাই বার্তা নাই, মাথায় রক্ত উঠে হাওলা! এমন এলেমদার ওস্তাদ পড়লেন আর মরলেন। কম এলেম দেখেছে কানাশ্যালরা। বাসে না উঠেও বাসে মুরগি আছে কি না, চক্ষু বন্ধ করে বলে দিতে পারতেন ওস্তাদ। মুরগি দেখলে ডিমের হিসাবও করে দিতে পারতেন লহমায়। কয়টা ডিম আছে মুরগির পেটে? ‘পকেট বইলে কিছু নাই’, অনেকবার কানাশ্যাল এবং তাঁর অন্য সাগরিদদের বলেছেন, ‘পকেট মনে কললেই পকেট।’
কানাশ্যাল এই কথাটা বোঝে নাই। পকেট বলে কিছু নাই মানে? মনে করলেই পকেট মানে? মরার আগে ওস্তাদ অন্তত এই কথার মানে তাকে বলে যেতে পারতেন। বলে যান নাই। কানাশ্যালও আর ‘ইন্টারেস্টিং’ হয় নাই। জটিল কথাবার্তা। তবে সে জুলমত ওস্তাদের সাগরিদ, কিছু এলেম আছে তারও। সে-ও মুরগির ডিমের হিসাব পারে কিছু। ভিজা মুরগির পেটে, তার আন্দাজ, পঞ্চাশ হাজারের কম ডিম নাই।
আন্দাজ একেবারে ভুল, তা নয়; তবে পঞ্চাশকে চার দিয়ে গুণ করে নিয়ে তার সঙ্গে আরও দশ যোগ দিতে হবে, এই যা। এক হাজার টাকার নোটের দুটো বান্ডিল, পাঁচ শ টাকার নোটের একটা বান্ডিল। দুই লাখ দশ হাজার আর খুচরো কিছু টাকা নিয়ে বাসে উঠেছেন নাইবউদ্দিন। টাকাটা আছে তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে। খদ্দরের পাঞ্জাবি। ময়লা না, ধোয়া, পরিষ্কার। এত টাকা আছে পকেটে, হুদা পাবলিক কেউ বুঝতেই পারবে না।
নাইবউদ্দিনের বয়স ঊনষাট। সাতাশ বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে বিভিন্ন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। শেষ আট বছর এক্রামপুর স্কুলে। সূত্রাপুর এলাকায় স্কুলটা। তিনি থাকেনও ওদিকেই। অকৃতদার। মিতব্যায়ী। ব্যাংকে যে পরিমাণ টাকা-পয়সা আছে, চলে যাবে। বাঁচবেন আর কদিন? বাংলাবাজারের সোনালি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট। দুই দিন আগে ব্যাংকের লোকদের অবহিত করে রেখেছিলেন। সকালেই টাকাটা উঠিয়েছেন এবং ঘোড়ার গাড়িতে গুলিস্তান পৌঁছেছেন। গুলিস্তান থেকে হেঁটে মতিঝিল। মতিঝিল বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে। যাবেন মিরপুর। সাড়ে দশ নম্বর। সাড়ে দশ নম্বরে থাকে মিরানা। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছাড়া জীবিত তাঁর একমাত্র বোন। মিরানার জামাই লিয়াকত কাপড়ের ব্যবসায়ী। বিস্তর টাকা। তাদের দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে একটা বসে বাপের দোকানে, একটা হয়েছে ড্রাগ এডিক্ট। মাদক নিরাময় ক্লিনিকে ছিল কয়েকবার। কিছু হয়নি। মেয়েটাও হয়েছে হান্ডুল-বান্ডুল। মডেল হবে বলে খেপেছে। কী রকম করে হাঁটে, কথা বলে। এই দুইটাকে নিয়ে কি কোনো সমস্যা? রোববারে ফোন করেছিল মিরানা। সে মহাবিপদে পড়েছে, দুই লাখ দশ হাজার টাকা দরকার। নাইবউদ্দিন বলেছেন, দেবেন। কী বিপদ, জিজ্ঞেস করেননি। এর আগেও অনেকবার এ রকম মহাবিপদে পড়েছে মিরানা। টাকা নিয়েছে। ফেরতও দিয়েছে। লিয়াকতকে সম্ভবত এসব মহাবিপদের কথা জানানো হয় না। মিরানা যদিও কিছু বলে না; কিন্তু নাইবউদ্দিন এটা বোঝেন। তিনিও লিয়াকতকে কিছু বলেন না। কী দরকার? এ ছাড়া তার এসবে আগ্রহও নেই অত।
বাসে হরেক কিসিমের মানুষ। হরেক কিসিমের কথাবার্তা। লোকাল বাসে যেমন যেমন হয় আর কি। কেউ চেঁচিয়ে কথা বলছে মোবাইলে, কেউ দেশ উদ্ধার করে ফেলছে, কেউ কন্ডাক্টরের সঙ্গে লেগেছে। নাইবউদ্দিন বসেছেন জানালার ধারে। কথাবার্তা শুনছেন, মানুষজন দেখছেন। তার পাশে যে ভদ্রলোক বসেছেন, গাট্টাগোট্টা গড়নের, মিশমিশে কালো। বাস ছাড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফার্মগেটে তিনি নামবেন। ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতে কন্ডাক্টরকে বলে রেখেছেন।
এসব বাসে সিট থাকে কয়টা? বায়ান্ন থেকে ষাটটা! সব সিট ভর্তি। দাঁড়ানো কতজন? কমপক্ষে তিরিশ-বিশ জন। তাদের মধ্যে দুজন মহিলাও আছেন। শাহবাগ পর্যন্ত একটা বিশেষ লোককে দেখেছেন নাইবউদ্দিন, বিশেষ করে দেখেছেন; কারণ, প্রথম দেখে চমকে উঠেছিলেন। এ তো রনুর মতো দেখতে, লোকটা! মীর্জা রওনক ইসলাম রনু। পোগোজ স্কুলে তারা একসঙ্গে পড়েছেন। সাইকেলের কারখানা ছিল রনুদের। ছয় বছর আগে মারা গেছে রনু। থাকলেও এই লোকাল বাসে কখনো উঠত না; কিন্তু এ তো রনুর মতো লোকটা! এখন মনে হলো লোকটাকে তিনি কি খুব বোকা-হাবার মতো দেখছিলেন? চোখে চোখ পড়েছিল একবার, বড় থতমত খেয়ে গিয়েছিল লোকটা! শাহবাগ স্টপেজে নেমে গেছে সে। শাহবাগ থেকে আরও কয়েকজন উঠেছে।
বাস টানা বাংলামোটর, কারওয়ানবাজার পার হয়ে গেছে। জ্যামে পড়েনি, সিগন্যালে পড়েনি। আশ্চর্য ঘটনা। এখন নাইবউদ্দিন দেখছেন আরেকজনকে। চেক শার্ট পরা, মধ্যবয়স্ক, তাদের সিটের পাশে দাঁড়িয়েছে, নিচু গলায় কথা বলছে মোবাইলে। এত কাছে বলে না চাইলেও তার কথা শুনতে পাচ্ছেন নাইবউদ্দিন।
‘না, মুরগি ডিম পাড়ে নাই।…পাড়ব। পাড়ব!… ভিজা মুরগি, হ।…বাঘডাশ আওড় দিয়া রাখছে।…এক লাখ ডিম! কত?…না, ডবল।…কইছি ডবল।…হ, কসম!…কসম কইলাম।…ক্যান? বইনে কি চোখে দেখে না? এহ্-হে-হে-হে! এহ্-হে-হে-হে!’
লোকটা হাসল।
‘অ্যাই, ফারোমগেই! ফারোমগেই! ফারোমগেই!’
চেঁচাচ্ছে বাসের হেলপার ছেলেটা। নাইবউদ্দিন সহযাত্রীকে দেখলেন। ফার্মগেটে নামবেন ভদ্রলোক। কন্ডাক্টরকে বলে রেখেছিলেন ডাকতে। কন্ডাক্টর টিকিট আর টাকা ওঠাচ্ছে। ভদ্রলোকের কথা মনে নেই বোধ হয়। বাস ফার্মগেটের স্টপেজে থামল। ভদ্রলোক নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন। নাইবউদ্দিন ইতস্তত একটা মনোভাব নিয়ে তাকে ডাকলেন, ‘ভাইসাহেব।’
এক ডাকেই তাকালেন ভদ্রলোক। টকটকে লাল দুই চোখ। বললেন, ‘জি।’
নাইবউদ্দিন সংক্ষেপে বললেন, ‘ফার্মগেট।’
‘ফারোম গেইট! আইয়া পড়সে! এত তড়াতড়ি!’
উঠে হুড়মুড় করে নেমে গেলেন ভদ্রলোক। চেক শার্ট পরা মধ্যবয়স্ক লোকটা বসল নাইবউদ্দিনের পাশে। ফার্মগেট থেকে আরও কিছু লোক উঠল। বোরকা পরা এক মহিলা উঠলেন। মহিলা সিটে জায়গা নাই আর। বোরকা পরিহিতা পেছনের দিকে যাচ্ছিলেন, তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল চেকশার্ট পরা লোকটা, ‘খালাম্মা, আপনে বসেন।’
নিরুপায় মহিলা বসলেন। মুগ্ধ হয়ে গেলেন নাইবউদ্দিন। মহিলা না, চেকশার্ট পরা লোকটার ভদ্রতায়। এমন দুয়েকজন আছে তাহলে এখনো? কিন্তু তার পাশে একজন মহিলা বসেছেন! অস্বস্তি হতে লাগল নাইবউদ্দিনের। উদ্ভট একটা কথা এল মাথায়। এই দৃশ্য যদি মিরানা দেখত! দেখলে কী হতো? ফিটের ব্যারাম আছে মিরানার। একটা কিছু ঘটলেই ফিট হয়ে যায়। এটা তার ফিট হওয়ার মতো একটা দৃশ্যই।
বাস থেমে আছে, কী করবেন, রাস্তাঘাট মানুষজন দেখতে মনোযোগী হলেন নাইবউদ্দিন। মানুষের মেলা। এত মানুষ! দশ বছর আগেও এত ছিল না। জনসংখ্যা কত এখন ঢাকা শহরের? দেড়-দুই কোটির কম না।
হাওয়া নেই, অত গরমও নেই। দিনটা মেঘলা। বৃষ্টি হবে কি না, বলা মুশকিল। সকালে আট-দশ ফোঁটা হয়েছে। একটা প্লেন উড়ে উত্তর দিকে যাচ্ছে। নাইবউদ্দিন দেখলেন। ভাবলেন, এই প্লেন কোন দেশে যায়? বেশ নিচু দিয়ে যাচ্ছে। প্লেনের যাত্রীরা কি ফার্মগেট দেখছে? এই বাসটা? জীবনে বলতে গেলে এই একটা মাত্র শখই পূরণ হয়নি নাইবউদ্দিনের। কখনো প্লেনে চড়েননি।
বাসে পত্রিকার হকার উঠেছে।
‘আইতিতন ট্যাকার পত্রিকা দুই ট্যাকা! আইতিতন ট্যাকার পত্রিকা দুই ট্যাকা!’
অনেকে কিনল। নাইবউদ্দিনও একটা কিনলেন। পড়বেন এমন না, অন্যমনস্ক থাকার জন্য কিনলেন। বাসের ভেতর আবার হাউকাউ বেঁধেছে। সম্ভবত না দেখে কেউ কারোর পা মাড়িয়ে দিয়েছে। এটা নিয়ে পড়েছে কয়েকজন। কে কী বলছে, বোঝা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বাস ছাড়ল।
বাস ছাড়ার পর নাইবউদ্দিন আর চেক শার্ট পরা লোকটাকে দেখলেন না। নেমে গেছে? নাকি পেছনের দিকে চলে গেছে? তাকিয়ে দেখতে পেলেন না। সিট পেয়ে গেছে হয়তো পেছনে। বসে পড়েছে।
দুই টাকায় কেনা তিন টাকার পত্রিকায় একটা লাল কাঁকড়ার ছবি দিয়েছে। ছাপা ভালো। জলজিয়ন্ত মনে হচ্ছে কাঁকড়াটা। কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে…।
‘আঙ্কেল।’
তাকে ডাকছে? বোরকা পরিহিতা? না তাকালে বোঝা যাবে না। তিনি পত্রিকা রেখে তাকালেন এবং এমন বিস্মিত হলেন! বোরকার নেকাব সরিয়ে মহিলা, মহিলা না মেয়ে, কিশোরী মেয়েটা, তাকিয়ে আছে তার দিকেই। চোখ দুটো বড় মায়াবী মেয়েটার। মিরানার হান্ডুল-বান্ডুল মেয়েটার বয়সী হবে। নাইবউদ্দিন বললেন, ‘জি।’
‘আপনে কই নামবেন, আঙ্কেল?’
‘আমি? মিরপুর।’
‘মিরপুর, মিরপুর কত নাম্বারে, আঙ্কেল?’
‘সাড়ে দশ।’
‘ও। আমি শ্যাওড়াপাড়ায় নামব। এই গাড়ি শ্যাওড়াপাড়া দিয়া যায় না?’
‘জি, যায়।’
‘শ্যাওড়াপাড়া আইলে কিন্তু আপনে আমারে কইবেন, আঙ্কেল। এই প্রথম আইছি তো ঢাকায়। রাস্তাঘাট কিছু ছিনি না। শ্যাওড়াপাড়ায় কি বাসিসেটন আছে? বাসিসেটনে আমার বইনজামাই থাকব।’
‘ও।’
‘আঙ্কেল, আমার নাম লাকী। মোসাম্মাৎ লাকী আক্তার। আমি ক্লাস এইট পইর্যন্ত পড়ছি। আমার আব্বার দোকান আছে বরমীতে।’
‘ও।’
‘ফলের দোকান। আপেল, আঙুর, বেদানা, কমলা, নাশপাতি, ডালিম, আম, খেজুর—সব ফল পাইবেন। আপনে বরমীতে গেছেন, আঙ্কেল?’
‘না।’
‘গেলে আমার আব্বার দোকানে যাইবেন। আপনের কি মোবাইল ফোন আছে?’
নাইবউদ্দিন কি ভেবে বললেন, ‘না।’
‘মোবাইল ফোন নাই? হায় আল্লা! মোবাইল ফোন থাকলে আঙ্কেল, আমার নাম্বার আপনেরে দিতাম। থাউক, কুনু অসুবিধা নাই। কাগজ-কলম আছে লগে, আমি লেইখ্যাই দিতেছি আপনেরে। আমি ক্লাস সেভেন পইর্যন্ত পড়ছি।’
একটু আগে বলল, ক্লাস এইট। পাগলি কিসিমের মেয়ে! টর টর টর টর কথা বলছেই। নাইবউদ্দিনের অবশ্য শুনতে খারাপ লাগছে না এবং আর অস্বস্তি লাগছে না। গ্রাম্য সরলতার কারণে সহজ মেয়েটা। কিন্তু এই মেয়ের বাপ-মা তাকে একা ঢাকায় পাঠিয়েছে কেন? কোনো না কোনো বিপদে পড়বে। যে দিনকাল!
‘…উই ব্যাডায় কি কললো, দেখছেন, আঙ্কেল? বাপের বয়সী বুইড়া ব্যাডা, আমারে হেয় ডাকল খালাম্মা!’ বলে হি হি করে হাসল মেয়েটা। সিটে বসা এবং দাঁড়ানো কয়েকজন যাত্রী তাকে দেখল। নাইবউদ্দিন ভাবলেন, হায়রে মেয়ে! এই শহর যে কত কঠিন! খালাম্মা ডাকুক সে তোমাকে সিট ছেড়ে দিয়ে উঠে গেছে। এমন ভদ্রলোক এই শহরে আর কজন তুমি দেখবে? আমার তো ধারণা, আর একজনও না। বিশিষ্ট ভদ্রলোক।
ওই বিশিষ্ট ভদ্রলোক গাইট্টা। এই মুহূর্তে সে আছে ফার্মগেটের ফুটওভার ব্রিজে। পিঁপড়া দেখছে। মানুষ-পিঁপড়া। তার চেহারায় দুঃখ, অপমান ফোটে না। কিন্তু সে এখন মনে মনে খুবই দুঃখিত এবং অপমানিত। কানাশ্যাল মশকরা করতে ছাড়বে না। নিজের কাছেও নিজের ‘পেস্টিচ পাংচার।’ এমন ধরা ‘খাইছে’, চিন্তাও করেনি। অথচ ভিজা মুরগির একেবারে পাশে গিয়ে বসে পড়েছিল সে। সুপার মওকা। তাও ডিম হাসিল করতে পারেনি। ভিজা মুরগিকে হাওলা করে দিতে হয়েছে বাউডান্ডি সগীরের কাছে। কিন্তু কেন যে সে কাজটা পারেনি? নিজেই বুঝতে পারছে না এখনো। ভিজা মুরগির দিকে তাকিয়ে পারেনি? হ্যাঁ। ‘হ্যাত্ তোর…!’ নিজেকে একটা বাজে গাল দিল গাইট্টা। দেবে না কেন? কত মুরগির দিকে রোজ তাকায়। কোনো দিন কিছু হলো না। আর আজ! ওহ্! রাগে ফার্মগেটের পিঁপড়া-মানুষদের উদ্দেশে রাজনৈতিক ভাষণ শুরু করে দিল সে।
‘এই ব্যর্থতা আমার একবার নহে, ভাইসব। এই ব্যর্থতা জনগণের। আমার, আপনার, আমাদের, সকলের। আমি বলতে চাই সরকারকে অবশ্যই দায়ভার নিতে হইবে এই ব্যর্থতার…।’
মেজাজ খারাপ হলে এ রকম জ্বালাময়ী ভাষণ দেয় গাইট্টা। মনে মনে। দুই লাইন ভাইসব, বোনসবের পরই অশ্রাব্য গালাগালি শুরু হয়ে যায়। পিঁপড়া-মানুষ জনগণের উদ্দেশে। জনগণ শোনে না। শুনলে সে আর থাকে দুনিয়ায়? ওহ্! ভিজা মুরগির হকদার এখন বাউডান্ডি সগীর। বাউডান্ডি সগীর বড় রুস্তম। থানেদারির এলাকা বড়। ফার্মগেট থেকে মিরপুর।
বাউডান্ডি সগীর নামের ইতিহাস ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত। বাউন্ডারিকে সগীর বলত বাউডান্ডি। কত ঘটনা!
বিশ হাজার টাকায় সগীরের সঙ্গে আপস-রফা হয়েছে গাইট্টার। সগীর ভিজা মুরগিকে ছাড়বে না। সে রুস্তম কা ওস্তাদ রুস্তম। এমনি ঢাকা শহরে তিনটা ফ্ল্যাট আর দুটো মাইক্রোবাসের মালিক হয় নাই। ফ্ল্যাট তিনটা ভাড়া দিয়ে রেখেছে। ভাড়া খাটে গাড়ি দুইটাও।
সগীর নিজে থাকে বস্তিতে। খিলগাঁও, কুত্তাপাড়ায়। তার বউ শরমিন তার বিজনেসের ওয়ার্কিং পার্টনার। আগে গাইট্টা কয়েকবার দেখেছে শরমিনকে। পাতলা-পুতলা, ফিলিমের নায়িকা। ‘বাবা কেন চাকর’, ‘স্বামী কেন আসামি’ এ রকম একটা ফিলিম যদি বানায়, ‘বউ কেন পকেটমার’, আর হিরোইনের রোলে যদি শরমিনকে নেয়, ফিলিম হিট। বাটে পড়ে আজ খালাম্মা বলে ডাকতে হয়েছে হারামজাদীকে। সিট ছেড়ে দিতে হয়েছে। স্টক থেকে আরও কয়েকটা স্পেশাল বাজে গালি দিল গাইট্টা। শরমিনকে। বাউডান্ডি সগীর শালাও ধাউড়। ভিজা মুরগি শুনে বউকে সিনে সেট করে দিয়েছে। রোয়াব দেখাবে। গাইট্টা যা পারে নাই, তার বউ তা পারে। দেখাবে! দেখাক। শরমিন সরেস। ভিজা মুরগি হোক আর শুকনা, যেকোনো উছিলায় সে ডিম হাসিল করতে পারবে। পারলেই ভালো। বিশ হাজার টাকা আপসে পেয়ে যায় গাইট্টা। কিন্তু এ রকম আর কখনো হয় নাই। গাইট্টা এ রকম ‘ফেইল’ হয় নাই কোনো দিন। তাকাল কী রকম! ভিজা মুরগি না শালা বুইড়া, ভিজা কুম্ভীর।
বাস খেজুরবাগান পার হয়ে যাচ্ছে। গাইট্টার মতো কথা শরমিনও ভাবল। তবে কুমির না, বরফের চাক্কা। চাক্কা বরফের মতো বস্তু বুইড়া। ভিজা মুরগি! এর মধ্যে দুনিয়ার গল্প সে শুনিয়ে ফেলেছে ভিজা মুরগিকে। তার দুলাভাই ভালো মানুষ না, অত্যাচার করে তার বোনকে, তার দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকায়, বুবু শুনলে কষ্ট পাবে বলে সে বুবুকে কিছু বলে না। আরও কত কী! বরফের চাক্কা দুই চোখে এক ফোঁটাও বিস্ময় না নিয়ে শুনেছে। অসতর্কও হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু লাকী উরফে শরমিন তাতেও ডিম হাসিল করতে পারে নাই।
বাস কাজীপাড়া স্টপেজে থামল। যাত্রী উঠল, যাত্রী নামল। খেজুরবাগান থেকে দিল্লা উঠল মোবাইলে কথা বলতে বলতে। বাসের ভেতর উঠে দাঁড়িয়ে থেকেও মোবাইল কানে নিয়েই থাকল। শরমিন দিল্লাকে দেখল। দিল্লা পরিস্থিতি জানাচ্ছে সগীরকে। কাজীপাড়া স্টপেজ ছাড়ার পর নাইবউদ্দিন লাকীকে বললেন, ‘শ্যাওড়াপাড়া এর পরই।’ বলতে না বলতে ফোন বাজল লাকীর। লাকী ধরল, ‘দুলাভাই! আমি বাসে…না, কোনো সমস্যা হয় নাই।…আরে না, এক আঙ্কেলরে পাইছি। আঙ্কেলে খুব সাহায্য করছেন।…না। আঙ্কেলে সাড়ে দশ নম্বরে যাইবেন। আইচ্চা, রাখি। আছেন না আপনে?… থাকেন? হিঃ হিঃ হিঃ!’
ফোন শেষ করে লাকী বলল, ‘আমার দুলাভাই, বাসিসেটনে থাকব। আপনেরে ফোন নম্বর দিছি তো আঙ্কেল! বরমীতে গেলে কিন্তু আপনে আমারে ফোন করবেন। করবেন না, কন?’
নাইবউদ্দিন হাসলেন।
‘হাসতেছেন ক্যান? ফোন করবেন, কন পোমিজ।’
নাইবউদ্দিন বললেন, ‘প্রমিজ।’
‘অ্যাই শ্যাড়াপ্পা! শ্যাড়াপ্পা! শ্যাড়াপ্পা! শ্যাড়াপ্পা, নামেন।’
লাকী উঠল, ‘যাই, আঙ্কেল।’
নাইবউদ্দিন বললেন, ‘যাও গো, মা।’
ভিড়ে ভিড়াক্কার বাসের মধ্যে একটা অতি বিচিত্র কাণ্ড করল লাকী। সালাম করল নাইবউদ্দিনকে। পা ছুঁয়ে। কাণ্ড দেখে নাইবউদ্দিন অভিভূত হয়ে গেলেন। মিরানার হান্ডুল-বান্ডুল মেয়েটা তাকে কোনো দিনই সালাম করেনি। উল্টো যে তাচ্ছিল্য দেখায়। নাইবউদ্দিন অনেক দোয়া করলেন লাকীকে।
লাকী বাস থেকে নেমে খানিকক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকল। বোরকার নেকাব আবার টেনে দিয়েছে। বোঝা গেল না দাঁড়িয়ে সে নাইবউদ্দিনকেই দেখল কিনা। তার দুলাভাই মানুষটা কোথায়? নাইবউদ্দিন তেমন কাউকে দেখলেন না। শ্যাওড়াপাড়া থেকে কয়েকজন উঠল। লাকী ওঠার পর নাইবউদ্দিনের পাশে বসেছেন এক হুজুর। বেতের টুপি, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি। পান চিবোচ্ছেন এবং তসবি টিপছেন। কড়া জর্দার গন্ধে নাইবউদ্দিনের মাথা ঝিম ঝিম করে উঠল। তিনি চা-পান-বিড়ি খান না। অভ্যাস করেননি। সিগারেটে টান দিয়ে একবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
বাস আবার ছেড়ে দিয়েছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আবার একবার লাকীকে দেখার চেষ্টা করলেন নাইবউদ্দিন। কিন্তু এতক্ষণ কি সে আর আছে? দুলাভাইয়ের সঙ্গে চলে গেছে বাসায়। দুশ্চিন্তা হলো। মেয়েটা বলছিল তার দুলাভাই ভালো না। কোনো অনিষ্ট যদি করে? ভালো থাকুক সিধা সরল মেয়েটা।
ভালো নেই সিধা সরল মেয়েটা। বাউডান্ডি সগীর তাকে বকেছে। যা নয় তা-ই বলেছে ফোনে। এই কাজ সে হাসিল করতে পারল না! একটা বুইড়া! কই যে মেয়ে মানুষের ডিল না এইসব।—কোনটা মেয়ে মানুষের ডিল না? এর আগে দেখে নাই সগীর, মেয়েমানুষ কি পারে না পারে! ভিজা মুরগি! কী করবে শরমিন? সব চেষ্টা বিফল হওয়ার পর বুইড়াটাকে সালাম পর্যন্ত করেছে। এমন সুযোগ আর হয় না। কিন্তু তাতেও ডিম হাসিল হয়নি। বারবার মনে হচ্ছিল বুইড়া ঠিক দেখে ফেলবে এবং হাতেনাতে ধরে ফেলবে তাকে। কঠিন বুইড়া। এ রকম আর দেখে নাই শরমিন।
তবে সগীর উঠেছে বাসে। তার সঙ্গে আছে খুলকি। এ ছাড়া আরও কয়েকজন। কলে পড়তেই হবে ভিজা মুরগিকে। শরমিনের আন্দাজ, কমপক্ষে দেড় লাখ।—এর মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে সগীর। বাস চলছে। ভিজা মুরগির সঙ্গে একবার চোখাচোখিও হয়েছে সগীরের। ভিজা মুরগি আগে থেকেই তাকে দেখছিল। এ রকম মনে হয়েছে। কিন্তু এ রকম মনে হবে কেন? কেন ভিজা মুরগি তাকে দেখবে?…দেখছিল, নাকি দেখছিল না? সগীরের একবার মনে হচ্ছে দেখছিল, একবার মনে হচ্ছে দেখছিল না। এ বেজায় একটা ফ্যাকড়া তো! আবার ফ্যাকড়া মনে হচ্ছে কেন, এটাও তো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
‘মিপ্পু সাড়ে দশ! মিপ্পু সাড়ে দশ!’
নাইবউদ্দিন উঠলেন। হুজুর চলে গেলেন জানালার ধারে। টেকো একটা লোক পাশের সিটে বসল। নাইবউদ্দিনের সামনে খুলকি। পেছনে সগীর। খুলকির সামনে আরও তিনজন। জটলা বাধাবে তারা গেটে।
জটলা বাধাল। নাইবউদ্দিন আটকা পড়ে গেলেন গেটে। খুলকি একরকম ল্যাপ্টে গেছে তার সঙ্গে। সগীরের পেছনে আরও দুজন। অন্য যাত্রী কেউ কিছু দেখবে না। অপারেশন ভিজা মুরগি। চোখ বন্ধ করে ভিজা মুরগির ডিমের বান্ডিল এখন নিয়ে নেবে সগীর। কানাশ্যাল ফেইল, গাইট্টা ফেইল, শরমিন ফেইল, সগীর পাস! ফাসিডভিশন! রেডি ওয়ান, টু, থ্রি…।
নাইবউদ্দিনের পাঞ্জাবির নির্দিষ্ট পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল সগীর। পরমুহূর্তে বিকট একটা আর্তনাদ। সগীরের আর্তনাদ! এমন বিকট, বাসের হইহল্লা থেমে গেল এবং বোবা হয়ে গেল অন্য যাত্রীরা। খুলকিরাসহ। তারা দেখল ব্যথা ও আতঙ্কে চোখ সাদা হয়ে গেছে সগীরের। কী হয়েছে?
নাইবউদ্দিনের পাঞ্জাবির পকেট থেকে সগীর হাত বের করে আনল। এটা কী? হাতে কী ঝুলে আছে সগীরের? লাল একটা কাঁকড়া। সগীরের হাতে দাঁড়া বসিয়ে দিয়েছে। তিনটা আঙুলে। রক্ত টপটপ করে পড়ছে। হাড় কেটে কঠিন দাঁড়া বসে যাচ্ছে। আর্তনাদ করে যাচ্ছে সগীর। বাসসুদ্ধ যাত্রীরা দেখল। নিরুৎসুক নাইবউদ্দিনও দেখলেন। বুঝে পেলেন না, তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে কী করে এল কাঁকড়াটা!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৫, ২০১১
মাকসুদ
েলখাটির মান খুব ভাল। সমােজর চিহ্নিত সমস্যাগুেলা নিেয় েলখক জনসমেক্ষ অােরকটু অকপট হেল সাধারণ পাঠেকর সুবিেধ হেতা বেল মেন করি।