দশটা ছবির মধ্যে একটা ভালো ছবি হয়ে যেতেই পারে
আমিনুল ইসলাম [জন্ম: ৭ নভেম্বর ১৯৩১—মৃত্যু: ৮ জুলাই ২০১১]
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাওন আকন্দ
প্রশ্ন: জীবনের এই পর্যায়ে (২০০৫) এসে আপনার কাছে হোয়াট ইজ আর্ট? আর্টটা কী।
আমিনুল ইসলাম: হোয়াট ইজ লাইফ? এটার যেমন কোনো উত্তর নেই। হোয়াট ইজ আর্ট? এটারও কোনো উত্তর নেই। সবারই ক্রিয়েটিভিটি থাকে। শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, গান, নাটক—যেকোনো বিষয় হতে পারে। ছোটবেলা থেকেই আমি সব ধরনের ছবি ভালোবাসি। থ্রি ডাইমেনশনাল জগতকে আমি টু ডাইমেনশনালে ট্রান্সফার করি। অচেতনে…একটা ম্যাজিক। ডাইমেনশন চেঞ্জ করার ক্ষমতা অর্জন করা। ম্যাজিকের সঙ্গে আর্টের সম্পর্ক আদিকাল থেকে। তার মধ্যে প্রথম ম্যাজিক হলো থ্রি ডাইমেনশনকে টু ডাইমেনশনে নিয়ে আসা। অন্যান্য আনুষঙ্গিক…ধর্মীয়বোধ কিংবা শিকারের প্রবৃত্তি এগুলো সেকেন্ডারি।
প্রশ্ন: ‘মডার্ন আর্ট’ কনসেপ্টটা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
আমিনুল: আমার কথাটা আগে বলি। ন্যাচারে জিওমেট্রি আছে। আমাদের বডিটা কিন্তু জিওমেট্রিক। মেরুদণ্ড…দুদিকে সমান…সিমেট্রি। অধিকাংশ প্রাণী কিংবা গাছের পাতা, গাছপালা…এবং তুমি দেখবে তুষার যে পড়ে, একেকটা তুষারের কণা ডিফারেন্ট হেক্সাগন (Hexagon)। এগুলো তো মানুষের সৌন্দর্যবোধকে কন্ট্রোল করছে। এবং এগুলো থেকেই কিন্তু মডার্ন আর্ট…জিওমেট্রিসাইজ হয়…এটা মডার্ন আর্টের একটা প্রধান দিক। আরেকটা জিনিস হচ্ছে, ধরো…ফিলিংসটা আছে কিন্তু ঠিক ভাষায় বোঝাতে পারি না। সেজাঁন যখন জিওমেট্রিসাইজ করে ল্যান্ডস্কেপ আরম্ভ করলেন—সে সময় কিন্তু সায়েন্সে অনেকগুলো নতুন উদ্ভাবনা হয়েছে। শিল্পীমন অজান্তে সেগুলোকে নিয়ে এসেছে তাঁর ছবিতে। আনকন্সাসলি। এমিল জোলা—সেজাঁনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুু হলেও তাঁকে সেকেন্ড গ্রেড পেইন্টার মনে করতেন।
প্রশ্ন: তাঁকে তো গেঁয়ো শিল্পীও বলা হয়েছে।
আমিনুল: হ্যাঁ। গ্রেট ওয়ার্ক তো ইনটিউশনস থেকে হয়েছে। কার্যকারিতা পরে বোঝা যায়। ক্যান্ডিনিস্কি, ম্যালেভিচ এরা থিউরিটিশিয়ান অনেক বেশি। কিংবা কিউবিজমের জুয়ান গ্রিস (Juan Gris) ওদের ভেতর সবচেয়ে বড় থিওরিটিশিয়ান। জিওম্যাট্রি ইজ আ মোস্ট পাওয়ারফুল ফর্ম। স্ট্রেইট লাইন ইজ মোস্ট স্টংগার দেন কার্ভ লাইন—এগুলো এদের বক্তব্য ছিল। তারপর তখন…ন্যাচার সম্পর্কে সায়েন্টিস্টরা দেখলেন, ন্যাচারে…জিউমেট্রিক ফর্মই বেশি। ক্রিস্টালে এক ধরনের জিউমেট্রি, পাথরে এক ধরনের জিউমেট্রি…এক ধরনের বিন্যাস, এগুলো তো মডার্ন আর্টের উদ্বোধনে প্রাথমিক ভূমিকা পালন করছে।
প্রশ্ন: ইতালি থেকে ফিরেও কয়েক বছর আপনি কিন্তু পুরোপুরি বিমূর্ততার দিকে ঝোঁকেননি।
আমিনুল: বিমূর্ত কিছু ছবি করেছি…
প্রশ্ন: পুরোপুরি বিমূর্ত হয়ে ওঠেন সম্ভবত সিক্সটির মাঝামাঝি?
আমিনুল: না, আরও আগে। ফিফটি নাইন…সিক্সটিতে। সিক্সটি ওয়ানে একটা এক্সিবিশন হয়েছিল আমাদের বাংলা একাডেমীতে।
প্রশ্ন: বিমূর্ততার দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণ কী বলে মনে হয় আপনার? আপনি এবং আপনার সতীর্থরা কেন বিমূর্ততার দিকে ঝুঁকে পড়লেন?
আমিনুল: আমার সতীর্থরা কেউ যায়নি তো। আমি শুধু একা গিয়েছি।
কিবরিয়া সাহেব এসেছেন সিক্সটি টুতে, জাপান থেকে আসার পর। ইন্টারেস্টিং হলো, আমাদের ছবি তো আবেদিন সাহেব পছন্দ করতেন না। কিবরিয়া সাহেব এলেন, কিন্তু উঠবেন কোথায়? আগে একটা মেসে থাকতেন। আমি তখন আজিমপুরে থাকি। বললাম, ‘ঠিক আছে আমার এখানে উঠবে।’ আবেদিন সাহেব বললেন, ‘না, না তোমার ওখানে থাকবে না।’ ওঁর এক বর্ধমানের বন্ধু, গেন্ডারিয়ায় থাকে, তার বাড়িতে উঠল। আমাদের সঙ্গে মিশলে পরে কিবরিয়া সাহেব যদি আবার আবেদিন সাহেবের কথা না শোনে? হা হা হা
প্রশ্ন: বিমূর্ততার প্রতি ঝোঁকের কারণটা কিন্তু এখনো পরিষ্কার হয়নি? মানে, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানদের যে ধারা, সেই ধারার বাইরে বের হয়ে আসার প্রবণতা কি কাজ করেছে?
আমিনুল : হ্যাঁ, তা তো বটেই।
প্রশ্ন: সিক্সটি ফাইভে একটা ইন্টারভিউয়ে আপনি বলেছেন ‘পাকিস্তানে বিমূর্ত শিল্প করা বেশ সাহসের কাজ।’ এখানে ‘সাহস’ বলতে আপনি ঠিক কী বুঝিয়েছেন?
আমিনুল: পাকিস্তানে বিমূর্ত ছবির বিক্রি নেই। কেউ করে না। মনসুর (শিল্প-সমালোচক, অধ্যাপক আবুল মনসুর) ক্লেইম করল, বিমূর্ত শিল্পের প্রভাব আরম্ভ হয়েছে করাচিতে।
প্রশ্ন: আদতে কী?
আমিনুল: আমি করাচিতে অনেক এক্সিবিশন করেছি, অনেক এক্সিবিশনে গিয়েছি। বিমূর্ত ছবি একটাও বিক্রি হয়নি। যেগুলো মূর্ত ছবি সেগুলোই বিক্রি হয়েছে। অনেকে বলে, এখানে যারা বিদেশি ছিল তারা বিমূর্ত ছবির ভক্ত ছিল। তারা বিমূর্ত ছবির ভক্ত ছিল না। তারা বরং…।
প্রশ্ন: তাহলে তো দেখা যাচ্ছে স্যার বিমূর্ততার প্রতি আপনার আগ্রহের খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে তৎকালীন প্রচলিত শিল্পধারাগুলোর বাইরে বের হয়ে আসা।
আমিনুল: এটা একটা। আরেকটা কারণ হলো, বিমূর্ত শিল্পকলা, যে শিল্পকলা এটা স্টাবলিশড করা।
প্রশ্ন: যে শিল্পধারার সঙ্গে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই সেই শিল্পধারা এই জনগোষ্ঠীর ভেতর চর্চা করার যে প্রচেষ্টা আপনি নিয়েছিলেন—তা কতটা যুক্তিসংগত ছিল এবং কিসের ভিত্তিতে?
আমিনুল: আধুনিক ছবিতেও দেশের কথা বলতে চেয়েছি, প্রকারান্তরে বলেছিও। আমার ‘ট্রান্সফরমেশন’ সিরিজ যার উদাহরণ। আমার মনে তখন ভাবনা ছিল, পাকিস্তান একটা ট্রান্সফরমেশনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
এক দেশ থাকবে, নাকি ভাগাভাগি হয়ে যাবে? এটা আমার বিমূর্ত ধারার ছবিতে প্রকাশ করেছি।
প্রশ্ন: কবিতার মতো চিত্রকলায়ও আপনারা সেই পশ্চিমা ফর্মটিকে গ্রহণ করেছেন?
আমিনুল: কারণ আমি যে আগেই বললাম, প্রকৃতি থেকে আমরা নিয়েছি, বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকা চাই। গ্রহণ করার ক্ষমতা না থাকলে সেটা আস্তে আস্তে স্থবির হয়ে যায়; প্রাণ থাকবে না। দুর্বোধ্যতার অভিযোগ ছিল, কিন্তু রিয়েলিস্টিক ফটোগ্রাফির ওপরও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ আছে। সাধারণ লোকজন বোঝে না এটা কার ছবি? কার পোর্ট্রেট?
প্রশ্ন: কিন্তু জয়নুল কিংবা কামরুলের ছবি দেখে কিন্তু মানুষ দুর্বোধ্যতার অভিযোগ করেনি।
আমিনুল: করেনি; কিন্তু কয়জন করেনি? এই শহরের কয়জন মধ্যবিত্ত। গ্রামের লোক তো দেখেইনি। আবেদিন সাহেব ল্যান্ডস্কেপ প্রচুর এঁকেছিলেন। সৈয়দ জাহাঙ্গীর ল্যান্ডস্কেপ করে ২৫ বছর পশ্চিম পাকিস্তানে কাটিয়েছেন। তারপর আবেদিন সাহেব খাগের কলম আর ওয়াটার কালার করে চিটাগং হিলট্রাকসের ছবি এঁকেছেন। এগুলো তো কাইন্ড অব প্রফেশন। এগুলো বিক্রি হয়। তাঁরা এগুলো করেছেন। ধরো, রাজ্জাক সাহেব, বাসেত সাহেব কিংবা মাহমুদুল হক। এঁরা কিন্তু অত গভীরভাবে চিন্তা করে অ্যাবস্টাকশনে আসেননি। এঁরা আমাদের দেখে দেখে, ওয়েস্টে কী হচ্ছে দেখে দেখে…এটাও এক ধরনের আর্ট…সৃষ্টিশীল কাজের…
প্রশ্ন: কিন্তু এভাবে কি কোনো মহৎ সৃষ্টি হতে পারে?
আমিনুল: দশটা ছবির মধ্যে একটা ভালো ছবি হয়ে যেতে পারে। আমি আরেকটা উদাহরণ দিই—সিক্সটি থ্রি কিংবা সিক্সটি ফোরে…একবার ঠিক হলো যে আর্ট কলেজের টিচাররা মিলে, চৌদ্দ জন আর্টিস্ট, এক্সিবিশন করবেন। আমাদের খাজা সাহেব…
প্রশ্ন: খাজা শফিক?
আমিনুল: হ্যাঁ, খাজা শফিক, তারপর আর্ট কলেজের ড্রাফটসম্যান সৈয়দ আলী আহসান—তাঁরা ঠিক করলেন, ওঁরা মডার্ন আর্ট করছেন, আমরা কি মডার্ন আর্ট পারি না? দুই-তিন রাত আর্ট কলেজেই থেকে রংটং ছিটিয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা ছবি করলেন। এবং আশ্চর্য! ওই ছবি বিক্রিও হলো। আমি খাজা সাহেবকে বললাম, আপনি যখন কাজ করছিলেন নিশ্চয় খুব ‘এনজয়’ করছিলেন। এনজয়মেন্টের ফলে যেহেতু আপনার রং সম্বন্ধে, কম্পোজিশন সম্পর্কে ধারণা আছে—দু-একটা ভালো ছবি বের হয়ে গেছে। এবং এটা অনেকের ভালো লেগেছে কিন্তু আপনি দশ বছর ধরে এ ছবি আঁকতে পারবেন কি না? ক্যান ইউ কনটিনিউ দিস লং পিরিয়ড? দু-একটা ছবি ভালো হয়ে যায়; কিন্তু এটায়…যদি আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা না থাকে, আপনি বেশি দিন কনটিনিউ করতে পারবেন না।
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৫, ২০১১
Leave a Reply