গোটা দেশ ছেলে ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে সুদর্শন ও গুণী যুবা পুরুষটির জন্যে
যোগ্য পাত্রীর খোঁজে যখন হন্যে হচ্ছিলেন অভিভাবকেরা—তখন হঠাৎই চোখ পড়ল নিজেদেরই সেরেস্তার একজনের নবমবর্ষীয়া কন্যার ওপর, জন্ম যার পূর্ব বাংলার অজপাড়াগাঁ দক্ষিণ ডিহির ফুলতলি গ্রামের ফুলি, পোশাকি নাম ভবতারিণীর আড়ালে আমরা কি তাকে চিনি? চিনব কী করে? ঠাকুরবাড়ির রেওয়াজ অনুযায়ী ততক্ষণে তার নতুন নামকরণ মৃণালিনী, যার ওপর প্রভাত-রবির প্রথম আলো পড়ে মুদ্রিত মৃণালকলি প্রস্ফুটিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের নিজেরই পছন্দ তদুপরি প্রথম দেখায় রচিত হলো, ‘যে হেথায় আমার চোখ ভুলিয়াছে/ তাতে আছে যেন এই মাটির শ্যামল অঞ্জন/ এর কচি ধানের চিকন আভা।’
এমনকি নিজের বিয়ের এক অভিনব নিমন্ত্রণপত্র নিজেই লিখেছিলেন,
ইতি অনুগত রবীন্দ্রনাথের নামে
সম্প্রদান হলো ওদের রবীন্দ্রনাথের হাতেই—তেমন গুরুজনদের অনুপস্থিতিতে
বিবাহবাসরে নিজেই গাইলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘আ মরি লাবণ্যময়ী,/ কে ও স্থির সৌদামিনী/ পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে/ মার্জিত বদনখানি।’
২৩ বছরের যুবকের সঙ্গে মাত্র নয় বছরের বালিকার মধ্যে সম্পর্ক দেহ বা মননের সৌন্দর্য আশা করা যায়?
বাইশ বছরের যুবক বিলেতফেরত রবীন্দ্রনাথের জীবনে তখন এসে গেছে আন্না তড়খড়, লুসি স্কট—সর্বোপরি প্রায় সমবয়সী কাদম্বরী দেবী আর ইন্দিরার
প্রমুখ প্রায় সমবয়সীরা মননের সৌন্দর্য আর লাবণ্যময়তার ভরপুর ডালি নিয়ে—
আর সে জায়গায় কে না? ফুলতলির ভবতারিণী যিনি কবির স্ত্রী হিসেবে একেবারেই বেমানান।
আর এই সময় কিনা এগারো বছরের মৃণালিনী অন্তঃসত্ত্বা তো বটেই বারো বছরে প্রথম সন্তানের জননী?
আর আট বছরের মধ্যেই শীর্ণা ও ক্ষুদ্রশরীরা ৫টি সন্তানের দুর্ভাগা জননী?
এই সময়েই কবির রচনায় ‘স্তন’, ‘চুম্বন’, ‘বিবসনা’, ‘বাহু’, ‘ধরন’
যাবতীয় রতিরসের কবিতা লিখে চলেছেন—কিশোরী বধূর
উদ্দেশেই লিখছেন, ‘এই তনুখানি তব আমি ভালোবাসি/ এ প্রাণ তোমার দেহে হয়েছে উদাসী।’
দাম্পত্য মিলনকুঞ্জে সম্ভোগ প্রেমের এমন অপূর্ব সুন্দর চিত্র
দেহের পাত্রে মর্ত্য জীবনের পরম পিপাসায় এত্ত আস্বাদন
বৈষ্ণব পদাবলীর পরে আর কেই বা লিখবে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না মৃণালিনীকে ঘিরে দেহবাদের আকুতি।
এখানেই শেষ নয়, কবিতাটির শেষ স্তবকগুলোতে রয়েছে ফুলতলি থেকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ঘরে ফুলির করুণ মৃত্যু।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৫, ২০১১
Leave a Reply