নির্বোধকে অনেকেই ‘গরু’ বলে উপহাস করে। গুরুজন হলে ভর্ৎসনাও করেন ‘গরু’ বলে। আমার মনে হয়, আদপেই ঠিক নয় এটা। এ দিয়ে কেবল গরুর মতো উপকারী প্রাণীর প্রতি আমাদের বিদ্বেষ প্রকাশই পায়। সত্যি বলতে কি, কেবল বুদ্ধি আছে তা-ই নয়, গরু হলো রীতিমতো ‘বুদ্ধিজীবী’। এটা আমার কথা নয়, এখন থেকে ঠিক ১৭০ বছর আগে অক্ষয়কুমার দত্ত গরুকে বলেছেন বুদ্ধিজীবী। হ্যাঁ, গরু, ছাগল, ভেড়া—এরা সবাই ‘বুদ্ধিজীবী’ তাঁর মতে। কিন্তু জামানা বদলে গেছে—এখন বুদ্ধিজীবী বললে বোঝায় অন্য একটি জীবকে। অথবা হতে পারে, এখনকার বুদ্ধিজীবীরা অক্ষয় দত্তের সংজ্ঞার দিকেই ফিরে যাচ্ছেন!
ভদ্রলোক ‘ভয়ানক’ আর একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন ‘মন্ত্রী’র। তাঁর মতে, ‘মন্ত্রী’ মানে হলো ‘বিবেক’ (১৮৪৪)। হায় রে, একালের মন্ত্রীদের সঙ্গে বিবেকের কোনো যোগাযোগ আছে বলে তো মনে হয় না! কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং ‘বিবেকে’র বিপরীতার্থক শব্দ হিসেবে ‘মন্ত্রী’ শব্দটা ব্যবহার করেন কেউ কেউ। কিন্তু মন্ত্রী বলে কথা! সে জন্যই বলেছি ‘ভয়ানক’।
‘অনুবাদ’ কথাটার মানে আমাদের সবারই জানা। কিন্তু ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ এখন থেকে ৪০০ বছরেরও আগে ‘অনুবাদ’ বলতে বোঝানো হয়েছে ‘কোনো গ্রন্থ থেকে আবৃত্তি করা’। ‘রাগ’ বললে এখন আর ‘অনুরাগ’ বোঝায় না, যা বোঝায় তা অনুরাগ বৃদ্ধি করে না, বরং রাগের মাথায় আমরা অনুরাগকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে থাকি। ‘মাগী’ কথাটাও এখন তুচ্ছার্থক, অশ্লীল গাল। যতই রাগ করুন, ভদ্রলোকেরা ‘মাগী’ বলে বউ অথবা অন্য কোনো মহিলাকে সম্বোধন করেন না। অথচ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অসাধারণ স্নেহের পাত্রী—এক বন্ধুর নাতনিকে—বিদ্যাসাগরসহ সবাই ‘মাগী’ বলে ডাকতেন। সেটা এতই স্বাভাবিক ছিল যে, প্রভাবতী নিজেও নিজেকেও শনাক্ত করত মাগী বলে। বিছানায় শুয়ে সে বলত, ‘মাগী শুলো।’ এমনিতে কথাটা আদৌ অপমানজনক অথবা তুচ্ছার্থক নয়—এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে ‘মা’ শব্দটার। অথচ সময়ের সঙ্গে শব্দটার অভিধা একেবারে বদলে গেছে।
মাত্র পাঁচটা শব্দের কথা বললাম। এভাবে, অর্থের পরিবর্তন হয়েছে হাজার হাজার শব্দের। এমনকি, শুধু অর্থ নয়, বেশির ভাগ শব্দের চেহারাও বদলে গেছে। ‘বে’ শব্দটা যেমন: বিবাহ > বিভাঅ > বিআঅ > বিয়া > বিয়ে > বে। শব্দের অর্থ এবং চেহারার এই বিবর্তন আসলে দারুণ আগ্রহব্যঞ্জক। ইন্টারেস্টিং। একটা শব্দ কোথা থেকে এসেছে, কখন প্রথম ব্যবহূত হয়েছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার অর্থ ও বানান কীভাবে বদলে গেছে—এসব জানা গেলে বেশ হতো। জানা দরকার। অথচ আমাদের ভাষার বেশির ভাগ শব্দের বিবর্তন কেমন করে হয়েছে, তা আমাদের অজ্ঞাত।
দ্বাদশ শতাব্দীর পণ্ডিত সর্বানন্দ থেকে আরম্ভ করে অনেকেই বাংলা শব্দ সংগ্রহ করেছেন। বিদেশিরাও এগিয়ে এসেছেন এ কাজে। লিসবন থেকে ভাওয়ালের সন্তান মনোয়েল দা আস্্সুমসাঁওর অভিধান মুদ্রিত হয়েছিল ১৭৪৩ সালে। বাংলা শিখতে গিয়ে হ্যালহেডও বাংলা-ফারসি অভিধান প্রণয়ন করার চেষ্টা করেছিলেন ১৭৭০-এর দশকে। এরপর ১৭৮২ সালে বাঙালি মুনশিকে দিয়ে চুঁচুড়ায় বসে ফরাসি কুঠির দোভাষী ওগুস্তাঁ ওসাঁ-ও একাধিক শব্দকোষ রচনা করিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল বাংলা-ফরাসি শব্দকোষ; অন্যটি ছিল ফরাসি-ইংরেজি-পর্তুগিজ—ফারসি-হিন্দুস্তানি-বাংলা—এই ছয় ভাষার অভিধান। হ্যালহেড অথবা ওসাঁর অভিধান মুদ্রিত হয়নি। কিন্তু তাঁদের সিকি শতাব্দীর মধ্যে আপজন (১৭৯৩) আর দুই খণ্ডে হেনরি ফরস্টারের অভিধান (১৭৯৯-১৮০২) মুদ্রিত হয়েছিল। তারপর দুই খণ্ডে উইলিয়াম কেরির অভিধান প্রকাশিত হয় ১৮১৫ ও ১৮২৫ সালে।
বাঙালিদের মধ্যে সবার আগে অভিধান প্রকাশ করেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ—১৮১৭ সালে। বঙ্গভাষাভিধান নামে মাত্র ৯৮ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত অভিধান হলেও এটিই বাঙালিদের প্রকাশিত অভিধানগুলোর মধ্যে সবার আগে প্রকাশিত হয়েছিল। বাঙালিদের মধ্যে প্রথম দ্বিভাষিক অভিধান প্রণয়ন করেন রামকমল সেন (১৮৩৪)। তারপর ২০০ বছরে ছাপা হয়েছে অসংখ্য অভিধান।
এই মুহূর্তেও বাজারে আছে পকেট অভিধানসহ ছোট, মাঝারি, বড়—নানা আকারের এন্তার অভিধান। কিন্তু কোনো অভিধানেই শব্দের বিবর্তনের ইতিহাস দেখা যায় না—যদিও প্রায় ৮০ বছর আগে প্রকাশিত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানে শব্দের ব্যুৎপত্তি এবং অর্থের খানিকটা বিবর্তন লক্ষ করা যায়। কিন্তু যাকে বিবর্তনমূলক অভিধান বলছি, এ অভিধান ঠিক সে রকমের অভিধান নয়। তা ছাড়া এ অভিধানে অনেক শব্দই নেই। যেমন, আমাদের নিত্য ব্যবহূত ‘রসুন’ শব্দটাও এই অভিধানে নেই। ‘লোশুন’ আছে, কিন্তু ‘রসুন’ নেই। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত বহু শব্দও অন্তর্ভুক্ত হয়নি এ অভিধানে।
তদুপরি, গত ৮০ বছরে বিস্তর নতুন শব্দ এসেছে আমাদের ভাষায়। যেমন, এখন ‘জাতীয়তা’ শব্দটা ব্যবহূত হচ্ছে সারাক্ষণই। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকে এ শব্দটার অস্তিত্ব ছিল না—‘জাতীয়তাবাদ’-এর তো নয়ই। শব্দ গঠনের জাদুকর রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত জাতীয়তা অথবা জাতীয়তাবাদের কথা ভাবেননি, ইংরেজিতে লিখেছেন ‘নেশন’ এবং ‘ন্যাশনাল্্ইজম’। এ রকমের শব্দ ‘জাতিসঙ্ঘ’, ‘মুদ্রাস্ফীতি’ অথবা ‘কম্পিউটার’। বস্তুত, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, সাময়িক প্রসঙ্গ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদি—প্রতিটি ক্ষেত্রে শত শত নতুন শব্দ এসেছে আমাদের ভাষায়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গেছেন অনেক আগে, তাই এই নবাগত শব্দাবলি তাঁর অভিধানে থাকার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত যেসব অভিধান প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে পাণ্ডিত্য ও নিষ্ঠার জন্য তাঁর দুই খণ্ড বঙ্গীয় শব্দকোষই সর্বোত্তম। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আমাদের ভাষায় এক লাখেরও বেশি শব্দ আছে। এসব শব্দের প্রতিটিরই ইতিহাস আছে। কবে কোন শব্দ আমাদের ভাষায় এসেছে, গোড়াতে সে শব্দের রূপ কী ছিল, সে শব্দটা প্রথম কখন ব্যবহূত হয়েছে, আদিতে কোন শব্দের কী অর্থ ছিল—এর প্রতিটি বিষয়েরই ইতিহাস আছে এবং সে ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেটা আবিষ্কার করার কাজটা আদৌ সহজ নয়।
কয়েকটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। ‘আড্ডা’ বললে কী বোঝায়, বাঙালিদের চেয়ে তা কেউই বেশি জানে না। কিন্তু উনিশ শতকে ‘আড্ডা’ কথাটার মানে ছিল প্রথমে ‘ঘাঁটি’, তারপর ‘স্টেশন’, তারপর ‘থাকার জায়গা’। ‘আলোকচিত্র’ কথাটা কবেকার? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানে ফটোগ্রাফ কথাটার মানে দেওয়া আছে ‘আতপচিত্র’। তাহলে তার পরবর্তী বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ১৮৪০-এর দশকে ‘আলোকচিত্র’ শব্দটা তৈরি করে লিখেছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। ‘ব্যবস্থাপক’ কথাটা ১৭৮৫ সালে ব্যবহূত হয়েছিল জোনাথান ডানকানের অনুবাদে। আইনের ‘ধারা’, ‘কর্ম্মকর্ত্তা’ ও ‘আদালতের অপমান’ কথাগুলোও তাঁর রচনায় প্রথম ব্যবহূত হয়। রামমোহন রায় ‘বেশ্যাগমনে’র পরিবর্তে লিখেছিলেন ‘বেশ্যাসেবন’। তিনি ঠিকই লিখেছিলেন, কারণ বেশ্যার কাছে কেউ শুধু যায় না, তাকে ভোগ অথবা উপভোগ করে।
ইংরেজি ভাষায় অনুরূপ কাজ শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। লন্ডনের ভাষাতাত্ত্বিক সমিতি ইংরেজিতে সে অভিধান রচনার আহ্বান জানিয়েছিল ১৮৫৭ সালে। তারপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের উদ্যোগে সে কাজ শুরু হয় ১৮৭৯ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণে এ অভিধান সম্পাদনার কাজ নেন জেমস মারে। এ অভিধান রচনা করার জন্য সারা দেশে তাঁর মতো পণ্ডিত ব্যক্তি আর কেউ ছিলেন না। তবে কোনো পরীক্ষায় পাস করেননি তিনি। স্কুল ছেড়েছিলেন মাত্র ১৪ বছর বয়সে। তারপর নিজে নিজে শিখেছিলেন অনেকগুলো ভাষা। ইংরেজি ছাড়া যে ভাষাগুলোতে তাঁর রীতিমতো পাণ্ডিত্য ছিল সেগুলো হলো ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ল্যাটিন, পর্তুগিজ, জার্মান, ডাচ আর ড্যানিশ। তা ছাড়া বেশ ভালো করে জানতেন অ্যাংলো-স্যাক্সন, গথিক, কেলটিক, হিব্রু, আরমেনিয়ান আর আরবি ভাষা। আর মোটামুটি জানতেন আরও কয়েকটা ভাষা। তার ওপর জেমস মারের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন হেনরি ব্র্যাডলি, উইলিয়াম ক্রেইগ ও অনিয়ন্সের মতো আরও কয়েকজন ভাষাতাত্ত্বিক।
বাংলা ভাষায় এমন কোনো পণ্ডিত নেই এখন, যিনি এতগুলো ভাষা দূরে থাক, ভারতবর্ষীয় ভাষা ছাড়া পাঁচ-ছয়টা ভাষা জানেন। এটা হলো পয়লা কারণ, যার জন্য এ রকমের অভিধান প্রণয়ন করা অসম্ভব।
দ্বিতীয় কারণ হলো সময় ও নিষ্ঠার অভাব। মারের অভিধানের কাজ কবে শুরু হয়েছিল—আগেই বলেছি—১৮৭৯ সালে। কিন্তু তা শেষ করতে সময় লেগেছিল ৪৯ বছর। মারে নিজে কাজ করেছিলেন ৩৬ বছর। অভিধানের কাজ শেষ হওয়ার ১৩ বছর আগেই তিনি মারা যান। তিনি ‘টি’ পর্যন্ত ভুক্তিগুলো তৈরি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর সহকর্মীদের সম্পাদনায় ১৯২৮ সালে অভিধানের শেষ খণ্ডটি যখন প্রকাশিত হয় তখন তাতে মোট শব্দ ছিল চার লাখ ১৫ হাজার, আর পৃষ্ঠা ছয় হাজার ৪০০। ১৯৮৯ সালে এই অভিধানের যে সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে, তার পৃষ্ঠা—২০ খণ্ডে—২২ হাজার।
অভিধানের জন্য সারা জীবন ব্যয় করতে রাজি আছেন—এমন বাঙালি পণ্ডিত এ যুগে কমই পাওয়া যাবে—যদি আদৌ পাওয়া যায়। পুরো জীবন না হলেও, জীবনের মূল্যবান ১৭ বছর একনিষ্ঠ অধ্যবসায় করেছিলেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন ১৭ মাসে অভিধান লিখতে আমরা ব্যস্ত সবাই।
নিজে কাজ না করে এখন সবাই চান অন্যের কাজ থেকে নকল করতে। এবং স্বীকার করতে হবে, এ কাজে আমাদের দক্ষতা মারের থেকেও বেশি। মনে আছে, এ রকমের একটি অভিধান প্রণয়ন নিয়ে যখন প্রথম আলোচনা হয় এশিয়াটিক সোসাইটিতে, তখন একজন ‘কাট অ্যান্ড পেস্টে’র সহজ পথ দেখিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য সে পদ্ধতির দৃষ্টান্ত আগেই দেখিয়েছিলেন তাঁর একটি গ্রন্থে। এ ছাড়া বাজারেও এই পদ্ধতিতে করা অন্য অভিধান দেখেছি।
বাংলা ভাষায় বিবর্তনমূলক ঐতিহাসিক অভিধান সংকলনের তৃতীয় বাধা উপকরণের অভাব। মারের অভিধানে প্রতিটি শব্দ প্রথমবারের মতো কখন ব্যবহার করা হয়েছিল, বছরের ও লেখকের নামসহ তা উল্লেখ করা হয়েছে। ইংরেজিতে ছাপার কাজ শুরু হয় সাড়ে ৫০০ বছরেরও আগে। কাজেই মুদ্রিত উপকরণ থেকে গত সাড়ে ৫০০ বছরের মধ্যে যেসব শব্দ প্রথম ব্যবহার করা হয়, তা আবিষ্কার করা দুরূহ হলেও অসম্ভব নয়। অপরপক্ষে, বাংলা মুদ্রণের কাজ আরম্ভ হয় মোটামুটি ২৩০ বছর আগে। এই মুদ্রিত উপকরণে নতুন শব্দ যেসব ব্যবহূত হয়েছে, তার বেশির ভাগই উদ্ধার করা সম্ভব। তবে সব নয়, তার কারণ, এসব মুদ্রিত উপকরণের বিরাট একটা ভাগ নষ্ট হয়েছে অথবা সংরক্ষিত হয়নি। বঙ্গদেশে ছাপাখানা স্থাপিত হওয়ার আগেই বহু গ্রন্থ রচিত ও লিখিত হয়েছিল। কিন্তু সেসব রচনার সঠিক তারিখসংবলিত পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না।
যেমন ধরুন, বিজয় গুপ্ত তাঁর মনসামঙ্গল নাকি রচনা করেছিলেন ১৫ শতকের একেবারে শেষ দিকে। কিন্তু তাঁর মনসামঙ্গলের সবচেয়ে পুরোনো যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে, তার বয়স দুই-আড়াই শ বছরের বেশি নয় বলে অনুমান করেছেন সুকুমার সেন। তার অর্থ, বিজয় গুপ্ত লেখার ৩০০ বছর পরের পুঁথি পেয়েছি আমরা। ইতিমধ্যে কত যে নতুন উপাদান যোগ করেছেন লিপিকরেরা, কত উপাদান যে বাদ পড়েছে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। ফলে বিজয় গুপ্তের রচনা থেকে যেসব শব্দ পাওয়া যাবে সেগুলো পুরোপুরি ‘অথেনটিক’ নয়। শত শত পাণ্ডুলিপি সম্পর্কেই এ কথা খাটে। বাংলা শব্দসমূহের প্রথম ব্যবহারের তারিখ নির্ণয় করা এ কারণে একপ্রকার অসম্ভব।
চতুর্থ কারণও উপকরণের অভাব। কিন্তু সেটা সময় নির্ণয় করার জন্য নয়, শব্দের আদিরূপ ও অর্থ নির্ণয়ের। আবার সেই বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলের কথা দিয়েই বলতে পারি যে, এই পাণ্ডুলিপিতে গোড়াতে কবি যেসব শব্দ ব্যবহার করেছিলেন তার চেহারা অনেকটাই বদলে গেছে বলে মনে করা সংগত। এমনকি অর্থেরও পরিবর্তন হওয়া সম্ভব। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যখন এই মঙ্গলগীতি গাওয়া হয়েছে, তখন গায়কেরা মুখে মুখে মূল কথাগুলো বহু জায়গায় জ্ঞাতে এবং অজ্ঞাতে বদলে দিয়েছেন। ভুলেও গেছেন নিশ্চয় বহু অংশ। এমনকি যুগে যুগে লিপিকারেরাও নকল করার সময় জেনে না-জেনে পাল্টে ফেলেছেন।
একটা উদাহরণ দিই। ‘শালিবাহন’ বলে একটা শব্দ আছে। একজন রাজার নাম। কিন্তু অর্থ না-জানায় পরবর্তী সময় সেই শব্দ হয়ে যায় ‘শালবন’। কারণ ‘শালবন’ কথাটা সবার জানা। ছেলেবেলায় একটা পঙিক্ত শুনেছিলাম, ‘কপাল ভিজিয়া গেল নয়নের জলে।’ নয়নের জলে কপাল ভিজতে গেলে মাধ্যাকর্ষণকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সাধারণ গায়েনও সেটা জানেন। তাই এর একটা ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন তাঁরা, ‘পা দুটি বাঁধা ছিল তমালের ডালে।’ হ্যাঁ, তাহলে নয়নের জলে কপাল ভেজা সম্ভব! কিন্তু আসল কথাটা হলো, ‘কপাল’ নয়, ‘কপোল’। ‘কপোল’ শব্দের অর্থ না-জানায় যত বিভ্রাট।
পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ইত্যাদি কারণও দেওয়া সম্ভব। তবে তার ফলে নতুন কিছু প্রমাণিত হবে না। এককথায়, বাংলা ভাষার একটা বিবর্তনমূলক অভিধান রচনা করা অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে। একালে জীবনের গতিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারের মতো সহায়ক প্রযুক্তি লাভ করেছি আমরা। ছাপানো এবং সহায়ক উপকরণও পাওয়া যাচ্ছে অনেক বেশি। তার ফলে কাজটা সহজ হওয়ারই কথা। সহজ হয়েছে বৈকি! কিন্তু যা আমরা শোচনীয়ভাবে হারিয়েছি তা হলো, কঠোর পরিশ্রম করার সংকল্প আর অধ্যবসায়। আর দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে সময়ের। উন্নতমানের কাজের জন্য যে সময় এবং নিষ্ঠা প্রয়োজন, একুশ শতকে এসে আমাদের কারও তা নেই।
কিন্তু এসব বাধা সত্ত্বেও জানুয়ারি মাস থেকে বাংলা একাডেমী একটি বিবর্তনমূলক অভিধান প্রণয়ন করার শক্ত এবং উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পে ১০ জনেরও বেশি লোক কাজ করছেন। তাঁদের সামনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। সময় অবশ্য সীমিত। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি শেষ করতে হবে এ অভিধানের কাজ। এ রকম অভিধানের জন্য এ সময় যথেষ্ট না-ও হতে পারে। তবে বাংলা একাডেমী আশাবাদী যে, এরই মধ্যে এই ঐতিহাসিক অভিধান তুলে দেওয়া যাবে পাঠকদের হাতে।
শেষ করি আর একটা শব্দের কথা বলে, কলেজ অর্থে ‘মহাবিদ্যালয়’। এ শব্দ সম্প্রতি তৈরি হয়নি। সমাচার দর্পণে এ শব্দ ব্যবহূত হয়েছিল ১৮১৯ সালে, ‘হিন্দু কালেজে’র কথা লিখতে গিয়ে। হ্যাঁ, ‘কলেজ’ নয়, ‘কালেজ’।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৫, ২০১১
Leave a Reply