‘বিদ্রোহী’র নব্বই
আহমদ কবির
কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নব্বই বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছরই। এই বিশেষ ঘটনাকে সামনে রেখেই আমাদের এ সপ্তাহের মূল রচনা-
‘বিদ্রোহী’র নব্বই পূর্ণ হয়নি, আর কয়টা মাস গেলে নব্বই হবে। কবিতাটি ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে রচিত হয়েছিল। ২০১১ সালকে নব্বই পূর্তির বছর হিসেবে ধরে উৎসবমন্য বাঙালি সংস্কৃতি-সমাজ তখন থেকে পূর্তি উৎসবে মেতে উঠেছে। সে যা-ই হোক, ‘বিদ্রোহী’র বয়স হয়েছে। মানুষের হিসাবে অনেক, ‘বিদ্রোহী’কে বুড়ো বলা যায়। কিন্তু কবিতার বয়স নেই, কবিতা অনন্তযৌবনা, আর ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা হলে তো কথাই নেই। এ কবিতা প্রেরণা ও প্রাণময়তায় রয়ে যায় চিরতরুণ, চিরভাস্বর হয়ে। এটি নজরুলের অমর কবিতা শুধু নয়, বাংলা সাহিত্যেরও অমর কবিতা। নজরুলকে আরও কিছু কবিতা ও গান দিয়ে চট করে চেনা যায়, কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ই তাঁর সর্বোত্তম শনাক্তচিহ্ন। নজরুলের নামের অভিধা যে ‘বিদ্রোহী’ হয়েছে, তা এই কবিতারই ফল। এই কবিতা নিয়ে যারা একসময় নজরুলকে কাফের বলতে চেয়েছিল, তারাই এখন এই কবিতার জন্য গদগদ, কিংবা যাঁরা এই কবিতার জন্য নজরুলকে আক্রমণ করেছিলেন, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছিলেন কিংবা ভাব চুরির অভিযোগ এনেছিলেন, তাঁদের ছাপিয়ে ‘বিদ্রোহী’ উঠে গেছে সর্ব শীর্ষে, সর্ব উচ্চতায়—‘উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর’। কবিতাটির একেবারে শেষ চরণেও একই অভিব্যক্তি, ‘আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির’। ‘চির উন্নত শির’ কথাটি প্রবল বিদ্রোহের ও শক্তির অবিরাম অফুরন্ত পৌরাণিক ও প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ নিয়ে বারবার উচ্চারিত হয়। ভয়াল সেসব অনুষঙ্গ। ‘বল বীর বল উন্নত মম শির’ হলো বিদ্রোহী বাণী—এই ‘চির উন্নত শির’ কারও কাছে আনত হয় না, মাথা নোয়ায় না, কাউকে তোয়াক্কা করে না, কাউকে মানে না, এমনকি গণবিরোধী আইনকেও নয়। বিদ্রোহী প্রচণ্ড বীর্যমন্ত অগ্নিশপথ নিয়ে তূর্যবাদনের গগনবিদারী নির্ঘোষে কবিসত্তার সর্বস্বাধীন অস্তিত্বের সরব ও সুদৃঢ় উন্নত অবস্থানের কথাই শুধু বলে। ওই যে চিরবিস্ময়ের কথা বলা হয়েছে, তা বিদ্রোহীর মহান রূপেরই পরম প্রকাশ। বিদ্রোহী আত্মবোধে অটল, অবিচল আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে সাহিত্যবোদ্ধাদের মূল্যায়নও বিচিত্র। ধারণা করতে অসুবিধা নেই যে ‘বিদ্রোহী’ এবং আরও কিছু কবিতার শব্দ বজ্রের নির্ঘোষকে মনে রেখে বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে বলেছেন, ‘চড়া গলার কবি’, তাঁর কবিতায় ‘হৈ চৈ অত্যন্ত বেশি’ এবং তিনি ‘কোলাহলকে গানে বেঁধেছেন’। ‘বিদ্রোহী’র ভাববস্তু নিয়ে কাজী আবদুল ওদুদের মূল্যায়ন (নজরুল প্রতিভা) বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর মতে, কবি নজরুলের শক্তি অত্যাশ্চর্য, কিন্তু ভাবপ্রকাশে নজরুলের প্রযত্ন কম। ‘দুর্বল ও অনাবশ্যক চরণ থেকে বিদ্রোহী মুক্ত নয়।’ ‘বিদ্রোহী’র নামকরণ নিয়ে ওদুদের অভিমত খুবই ইতিবাচক, কিন্তু তিনি এ-ও বলেন, ‘এটি এক অপূর্ব উন্মাদনারই কবিতা, কোনো বিদ্রোহী বাণী এতে বিঘোষিত হয়নি।’ ওদুদ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে মন্তব্য করেননি।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা হয়েছিল যখন দেশের তরুণ মন উদ্বোধিত হচ্ছিল দেশ মুক্তির সংগ্রামে। তখন উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনগুলোর সঙ্গে মুক্তিকামী তরুণদের সম্পৃক্ততা। অসহযোগ আন্দোলন, চরকা আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, দেশ মুক্তির সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, রুশ বিপ্লবের প্রেরণাজাত সাম্যবাদী আন্দোলন ইত্যাদি নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি ও বিক্ষোভ-প্রতিবাদে মুক্তিশপথ দীপ্ত তরুণদের হূদয়-মন উন্মাদনায় ভরপুর ছিল। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ ভারতীয় রাজনীতির এই তুঙ্গ মুহূর্তেই প্রকাশিত হয়েছিল এবং তরুণমনকে অপূর্ব প্রেরণায় প্রাণিত করেছিল। নজরুল নিজেও এসব আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। নজরুলের এই কালিক ভূমিকার কথাই বলেছেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য—‘রাজনীতির স্থূল ও প্রত্যক্ষ ক্ষেত্রে যে আহ্বান জানিয়েছিলেন গান্ধীজি, নজরুলের “বিদ্রোহী” কবিতা ঠিক সেই আহ্বানই আমাদের অনুভূতির দেহকে স্পন্দিত করে গেছে (নজরুল ইসলাম)। নজরুল অবশ্য গান্ধীবাদ ত্যাগ করেছিলেন; অচিরেই দেশের নিপীড়িত, বঞ্চিতদের মুক্তির অন্য পথ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। বন্ধু কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সাহচর্যে হোক কিংবা নিজের অনুভূতির বিবেচনা তাঁকে ক্রমশ নিয়ে গেছে বিপ্লববাদ ও সাম্যবাদের দিকে। নজরুলের এই অবস্থানই বিপ্লপবাদীদের মনঃপূত। কল্পতরু সেনগুপ্তের কথায়, ‘নজরুল রচিত “বিদ্রোহী” কবিতা বাংলা কাব্য জগতে এক অনবদ্য সৃষ্টি। এই কবিতা বাংলার বিপ্লববাদীদের ঘোষণাপত্রের ভূমিকা পালন করেছে। সর্বপ্রকার ভীরুতা ও দীনতা থেকে মুক্ত হয়ে এগিয়ে চলার সাহস জুগিয়েছে। …“বিদ্রোহী” কবিতা তৎকালীন বিপ্লববাদীদের ইশতেহারে পরিণত হয়েছিল। এ কবিতা সেই সময়ের তরুণ প্রজন্মকে সংগ্রামে সংঘবদ্ধ হতে, কারাগারের অন্ধকার আর ফাঁসির মঞ্চকে অগ্রাহ্য করতে এবং মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে সাহস জুগিয়েছে।’ (বিপ্লববাদ থেকে সাম্যবাদ)। আরেকজন বলেছেন, ‘বিদ্রোহী বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সিম্বলিক কবিতা।’ (সুশীলকুমার গুপ্ত)। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ভাব-উপাদানের ভেতরের কবিতাটিকে নানা তাৎপর্যে বোঝার দিকগুলো রয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক কবিতা।
‘বিদ্রোহী’ নজরুলের প্রথম প্রকাশিত কাব্য অগ্নিবীণার দ্বিতীয় কবিতা। এটিই কাব্যের মূল কবিতা, অন্য কবিতাগুলো এর সহগ। নজরুল চরিত মানসের লেখক সুশীলকুমার সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, ‘কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের দুর্গাপূজার কাছাকাছি সময়ে।’ তিনি রচনার স্থান-কাল নিয়ে কিছু বলেননি। সুশীলকুমার সম্ভবত বিদ্রোহীর রচনা প্রসঙ্গে নজরুলের বন্ধু মুজফ্ফর আহমদ রচিত কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে বইটির দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ওই বইয়ে ১৯২১ সালের দুর্গাপূজার কাছাকাছি সময়ে ‘বিদ্রোহী’ রচিত হয়েছিল বলে তিনি লিখেছিলেন। কিন্তু মুজফ্ফর আহমদ পরবর্তীকালে তাঁর বন্ধু নজরুলকে নিয়ে রচিত ভিন্ন গ্রন্থ কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথায় বলেছেন, তিনি ‘বিদ্রোহী’ রচনার ভুল সময় দিয়ে অন্যায় কাজ করেছেন। সংশোধনীতে তাঁর কথা ওই স্মৃতিকথা গ্রন্থে—‘আসলে “বিদ্রোহী” কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। সব হিসাব খতিয়ে এবং সমসাময়িক ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে বেরিয়ে আসছে যে এটাই ছিল কবিতাটির রচনার সময়।’
মুজফ্ফর আহমদের দেওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেন বাড়িতে রচিত হয়েছিল। ১৯২০ সালে ঊনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি পল্টন ভেঙে গেলে নজরুল প্রথমে তাঁর সতীর্থ কথাসাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাসায় ওঠেন, সেখানে কয়েক দিন থেকে আরেকটি বাসস্থানে, পরে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে উঠলেন। সেখানে তাঁর বন্ধু মুজফ্ফর আহমদ থাকেন। তাঁর সঙ্গে নজরুল একত্র বসবাস করেছেন আরও কয়েকটি বাসায়, শেষে ৩/৪ সি তালতলা লেনে। মুজফ্ফর আহমদ স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, পুরো বাড়ি পশ্চিমগাঁর নওয়াব ফয়জুন্নিসা চৌধুরানীর নাতিরা ভাড়া নিয়েছিল। বাড়ির নিচতলার দক্ষিণ-পূর্ব ঘরটি নজরুল ও মুজফ্ফর আহমদ ভাড়া নিয়েছিলেন। এখন মুজফ্ফর আহমদ থেকেই জানা যাক কবিতাটি কোথায়, কখন রচিত হয়েছিল। ‘এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতা লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানি নে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। “বিদ্রোহী” কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।’ মুজফ্ফর আহমদ জানিয়েছেন, নিজের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই কবিতাটি শুনে তিনি কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি। এতে নজরুল মনে মনে আহত হয়েছেন নিশ্চয়ই। কবিতাটির রচনার সময় নিয়ে মুজফ্ফর আহমদ আবার বলেছেন, ‘আমার মনে হয় নজরুল ইসলাম শেষ রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। তার ঘুম সাধারণত দেরীতেই ভাঙত, আমার মতো তাড়াতাড়ি তার খুব ভাঙত না।’ মুজফ্ফর আহমদ আরও জানিয়েছেন, নজরুল সম্ভবত প্রথমে কবিতাটি পেনসিলে লিখেছিলেন।
‘বিদ্রোহী’ কোন পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়েছিল সে নিয়েও বিতর্ক আছে। নজরুল রচনাবলীর (বাংলা একাডেমী) সম্পাদক আবদুল কাদির প্রথম খণ্ডের গ্রন্থ পরিচয়ে জানিয়েছেন, ‘বিদ্রোহী ১৩২৮ কার্তিকে ২য় বর্ষের ৩য় সংখ্যক “মোসলেম ভারতে” বাহির হইয়াছিল। ১৩২৮ সালের ২২শে পৌষের সাপ্তাহিক বিজলীতে এবং ১৩২৮ মাঘের প্রবাসীতে উহা সংকলিত হইয়াছিল।’ আবদুল কাদির এ তথ্যও জানিয়েছেন যে ‘মোসলেম ভারতে’ প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আরও কয়েকটি চরণ ছিল, যেগুলো পরে পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু মুজফ্ফর আহমদ বলেছেন, ‘বিদ্রোহী’ প্রথমে সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় ছাপা হয়েছে (১৯২১ সালের ৬ জানুয়ারি, ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) মুজফ্ফর আহমদের কথায়, ‘“বিদ্রোহী” প্রথম ছাপানোর সম্মান বিজলীরই প্রাপ্য।’ এ কথা অবশ্য ঠিক যে ‘মোসলেম ভারতে’ প্রকাশের জন্য নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পাদক আফজালুল হককে প্রথমে দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘মোসলেম ভারতে’র কথিত সংখ্যাটি বের হতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা পাঠ করে কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ‘নিয়ন্ত্রিত’ কবিতাটি লিখেছিলেন। কবিতাটির শুরুটা এ রকম—
ওগো ‘বীর’
সংযত কর, সংহত কর ‘উন্নত’ তব শির।
‘বিদ্রোহী’—শুনে হাসি পায়।
বাঁধন-কারার কাঁদন কাঁদিয়া বিদ্রোহী হতে সাধ যায়?
সে কি সাজেরে পাগল সাজে তোর?
আপনার পায়ে দাঁড়াবার মত কতটুকু জোর আছে জোর?
ছি ছি লজ্জা, ছি ছি লজ্জা!
—ইত্যাদি
গোলাম মোস্তফার এই বিদ্রূপাত্মক সাবধান বাণীর চেয়েও ‘বিদ্রোহী’ রচনা নিয়ে নজরুলের অগ্রজ বন্ধু কবি মোহিতলাল মজুমদারের প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে তীব্র। নজরুলের সঙ্গে মোহিতলালের বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। নজরুল-আবাসে মোহিতলাল নিয়মিত আসতেন, কবিতা আওড়াতেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ রচনার পর এই বন্ধুতে চিড় ধরে এবং দুজনের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায়। মোহিতলাল দাবি করেন ‘মানসী’র ১৩২১-এর পৌষ সংখ্যায় তাঁর রচিত ‘আমি’ গদ্যরচনার ভাব চুরি করে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেছেন। মোহিতলাল রচনাটি নজরুলকে পড়েও শুনিয়েছেন বলে মুজফ্ফর আহমদ জানিয়েছেন। এটি ‘বিদ্রোহী’ রচনার এক বছর আগের ঘটনা। ‘আমি’ ও ‘বিদ্রোহী’ পাশাপাশি পড়লে কিছু সাদৃশ্য হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু ‘আমি’ একটি দার্শনিক গদ্য রচনা, আর ‘বিদ্রোহী’ ব্যক্তি আমির উন্মাদনাপূর্ণ এক অনবদ্য রচনা, যার রাজনৈতিক ও মানবিক দিকটি খুবই উল্লেখযোগ্য। মোহিতলালের রচনায় এসব নেই। আসলে নজরুল মোহিতলালের বলয় থেকে বেরিয়ে আসাতে মোহিতলাল নজরুলের ওপর মহাক্ষুব্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েছিলেন। শনিবারের চিঠির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। শনিবারের চিঠির ১৩৩১ সালের ১৮ আশ্বিন সংখ্যায় ‘বিদ্রোহী’র প্যারোডি বের হলো ‘ব্যাঙ’ নামে।
আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং
ভৈরব রভসে বরষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং।
আমি ব্যাঙ,
আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ;
শ্রাবণ-নিশায় পরশে আমার সাহসিকা
অভিসারিকা
ডেকে উঠে ‘বাপ বাপ’।
ইত্যাদি।
এই প্যারোডি রচনা করেছিলেন সম্পাদক সজনীকান্ত দাস ভাবকুমার প্রধান ছদ্মনামে। নজরুল প্যারোডি পড়ে মনে করেছিলেন এটি মোহিতলালেরই রচনা। প্রত্যুত্তরে তিনিও লেখেন, ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’ নামের কবিতা, যা ফণি-মনসা কাব্যে সংকলিত হয়েছে।
রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা।
রুধির-নদীর পার হতে ঐ ডাকে বিপ্লব-হ্রেষা।
হে দ্রোণাচার্য। আজি এই নব জয়যাত্রার আগে
দ্বেষ-পঙ্কিল হিয়া হতে তব শ্বেত পঙ্কজ মাগে
শিষ্য তোমার, দাও গুরু দাও তব রূপ-মসী ছানি’
অঞ্জলি ভরি’ শুধু কুৎসিত কদর্যতার গ্লানি।
ইত্যাদি
এর উত্তরে মোহিতলাল মজুমদার লেখেন, ‘দ্রোণ গুরু’ (৮ কার্তিক ১৩৩১)।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার কালিক প্রতিক্রিয়া নজরুলের মহিমাকে কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন করতে পারেনি। এই কবিতা চিরকালের সম্পদ এবং এর প্রাসঙ্গিকতাও কোনো দিন ফুরোবে না। এই কবিতা রচিত হয়েছিল ব্রিটিশ-উপনিবেশের দুর্বিষহ কালে। সে কাল পেরিয়ে গেছে বহুদিন আগে। এখন ‘বিদ্রোহী’ নব্বই হয়েছে; কাল পেরিয়ে গেলেও বিদ্রোহী এখনো সমান জ্বলজ্বলে,—উদ্দীপনা ও উজ্জীবনের জন্য আত্মবোধ ও আত্মসম্মানের জন্য আত্মঅহমিকা ও আত্ম অহংকারের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, অত্যাচারিত ও নিপীড়িত সামাজিক মানুষের জন্য, ভাগ্যহত ও সর্বহারার জন্য, এবং সর্বোপরি বিপ্লববাদীদের জন্য। বিশুদ্ধ শিল্পবিচারক ও কাব্যরসিকের দৃষ্টিতে ‘বিদ্রোহী’র মধ্যে শিল্পের ঊনতা থাকলেও ‘বিদ্রোহী’ বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক কবিতা।
ভাইয়া চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, কারণ খুব সহজ। তুমি যেখানে আছো, যে পরিবেশে বাস করছো, সেখানে তুমি স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস ফেলতে পারো না। সারাক্ষণ তোমাকে দমবন্ধ অবস্থায় থাকতে হয়। তুমি এ বাড়িতে আসো নিঃশ্বাস ফেলার জন্য।
বনলতা কোনো কথা বলল না। চোখ বড় বড় করে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। বৃষ্টির পানি হিমশীতল। সে শীতে কাঁপছে। ভাইয়া বলল, তুমি এক কাজ করো, পুরোপুরি এ বাড়িতে চলে আসো। নিঃশ্বাস ফেলার পারমানেন্ট ব্যবস্থা হোক।
বনলতা বলল, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
ভাইয়া বলল, রহিমার মা চলে গেছে। আমাদের কাজের মেয়ে দরকার। রান্নাবান্না করবে, ঘর ঝাঁট দেবে, কাপড় কাচবে। তুমি রাজি?
বনলতা আর্তনাদের মতো বলল, এই সব আপনি কী বলছেন?
ভাইয়া বলল, আমি রগট ধর্ম নামে এক ধর্মের প্রচারক। এই ধর্মে প্রথম পরিচয়েই মানুষকে আহত করার বিধান আছে; আমি তা-ই করেছি। এখন সামনে থেকে যাও। সাবধানে যাবে, বৃষ্টিতে ভিজে উঠান পিছল হয়ে আছে।
বৃষ্টিতে গরম চা খেতে চমৎকার লাগছে। তবে চা দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। উঠানের শেষ মাথায় টিনের চাল বেয়ে পানির প্রবল স্রোত নামছে। তার নিচে মাথা পেতে বসে আছে বনলতা। দৃশ্যটা দূর থেকে দেখতে ভালো লাগছে। ভাইয়া বলল, বাবার ভেতরে মন্দ কিছু বের করার অনেক চেষ্টা করেছি, পাইনি।
আমি বললাম, একটা তো পেয়েছ। বাবা ও ফজলু চাচা—দুই বন্ধু মিলে এই জায়গা কিনেছেন। বাবা তাঁর নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছেন।
ভাইয়া ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এটা ঠিক না। ফজলু চাচা বাবাকে কোনো টাকা দেন নাই।
তুমি নিশ্চিত?
হ্যাঁ। ফজলু চাচা দুষ্টপ্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি গোপনে আরেকটা বিয়ে করেছিলেন। তাঁর সেই স্ত্রীর নাম পারভীন। এই জমি কেনার টাকা দিয়ে তিনি সেই স্ত্রীকে আগারগাঁওয়ে তিন কাঠা জমি কিনে দেন। বাবা পুরো ঘটনাটা জানেন। কিন্তু এত ঝামেলাতেও প্রকাশ করেননি। পদ্মর মা এবং পদ্মও জানে। তুই কি বনলতা মেয়েটিকে বলবি আমাকে আরেক কাপ গরম চা দিতে?
বলব। একটু পরে বলি? তোমার গল্প শুনে শরীর ঝিম ধরে গেছে। ঝিম কাটুক।
ভাইয়া বলল, বাবার সম্পর্কে একটা চমৎকার গল্প এখন বলব। তোকে যে ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই ধাঁধার উত্তর গল্পে আছে। মন দিয়ে শোন।
শুনছি।
বাবা তখন মাত্র বিয়ে করেছেন। মাকে নিয়ে সোবাহানবাগের এক গলিতে দুই রুমের একটা বাসা নিয়ে থাকেন। একদিন ভোরবেলা বাবা মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে দেখেন, ডাস্টবিনের পাশে একটা বাচ্চাছেলে ট্যা ট্যা করে কাঁদছে। ছেলেটাকে ঘিরে বেশ কিছু মানুষ। তারা কৌতূহলী হয়ে দেখছে, কিন্তু কিছু করছে না। বাবা ছেলেটাকে উঠিয়ে নিয়ে এলেন। নিজের সন্তানের মতো বড় করলেন। বল দেখি, সেই ছেলে কে? দেখি তোর কত বুদ্ধি।
বৃষ্টি থেমে গেছে। ভাইয়া হাউমাউ করে কাঁদছে। বনলতা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে।
পরিশিষ্ট
বাবার হাতে যে টাকা-পয়সা আছে তা দিয়ে ব্যাংককে মায়ের চিকিৎসা হবে না। যাওয়া-আসার ভাড়াই হবে না, চিকিৎসা তো পরের ব্যাপার। ভাইয়া ইচ্ছা করলে ব্যবস্থা করতে পারে, কিন্তু তা সে করবে না। ভাইয়ার কাছে জানলাম, অতি দুষ্ট এক চক্রের প্রধান হয়েও সে একটি টাকাও নেয় না। এই কাজ সে করে না বলেই তাকে সবাই গুরু বলে মানে। তা ছাড়া বাবা-মায়ের মতো শুদ্ধ মানুষের জন্যে সে অশুদ্ধ অর্থ ব্যবহার করবে না।
আমরা ব্যাংককের বদলে যাচ্ছি কক্সবাজার। আমরা দুই ভাই এবং বাবা স্যুট-টাই পরেছি। গলায় লাল টাই। আমাদের স্যুট-টাই পরা দেখে মা আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন। বারবার বলছেন, কী সুন্দর যে লাগছে! কী সুন্দর যে লাগছে, মাশাল্লাহ! বাবা জামালকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন, সে আবার পালিয়েছে। এবার নিয়েছে পদ্মর মায়ের ভ্যানিটি ব্যাগ। ব্যাগে মোবাইল ফোন আর নয় শ টাকা ছিল।
পদ্মর মা এই বাড়ি ছানাউল্লাহ সাহেবের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন এবং পদ্ম সেই টাকা নিয়ে পালিয়ে চলে গেছে ড্রাইভার সালামতের কাছে। যাওয়ার আগে আমার কাছে একটি চিঠি লিখে গেছে। চিঠিটা এ রকম—
নকল স্বামী,
আমি এখন যাচ্ছি আসল স্বামীর কাছে। তার সঙ্গে কত দিন থাকব তাও জানি না। আপনার ভাইয়াকে একটু জিজ্ঞেস করে দেখুন তো সে আমাকে রগট ধর্মে দীক্ষা দেবে কি না। আপনাকে একটা কথা জানানো বিশেষ প্রয়োজন। আমার বাবা এই বাড়ির জমি কেনার জন্যে কোনো টাকা দেননি। আমি এবং মা দুজনই এই বিষয়টা জানি।
ইতি
আপনার নকল স্ত্রী পদ্ম
পুনশ্চ: খবরদার, নাকথ্যাবড়ি বনলতাকে বিয়ে করবেন না। বিয়ে করলে খবর আছে।
অফিসের মাইক্রোবাস নিয়ে আমাদের ট্রেনে তুলে দিতে এল বনলতা। সে খুব সাজগোজ করেছে। নীল শাড়ি, কপালে নীল টিপ। ফার্স্ট ক্লাসের রিজার্ভ করা কামরায় আমরা উঠেছি। মা বলল, তোর বাবার কাণ্ড দেখলি, টগর! পানির মতো টাকা খরচ করছে।
বনলতা একগাদা ফলমূল নিয়ে এসেছে। ব্যস্ত হয়ে সবকিছু গোছাচ্ছে। মা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, মা, তোমার পরিচয়টা কী?
বনলতা লাজুক গলায় বলল, আমি জীবনানন্দ দাশের মানসকন্যা বনলতা সেন।
মা কিছু না বুঝেই আনন্দিত গলায় বললেন, তোমাকে দেখে খুব খুশি হলাম, মা। তোমার বাবা জীবনানন্দ বাবু ভালো আছেন?
ভাইয়া হো হো করে হাসছে। মা ভাইয়ার দিকে বিরক্তি চোখে তাকালেন।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বাবা বললেন, ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বনলতা, তুমি নেমে যাও।
বনলতা লাজুক গলায় বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে যাব। আমি জীবনে কখনো সমুদ্র দেখিনি, সমুদ্র দেখব।
বাবা ব্যস্ত হয়ে বললেন, তোমার তো টিকিট কাটা হয় নাই। তোমার টিকিটের কী হবে?
মা বললেন, আরে তাই তো! এই মেয়ের টিকিট? ও টগর! বাবা, একটা কিছু কর।
ট্রেনের গতি বাড়তে শুরু করেছে। বনলতা মায়ের হাত ধরে বসে আছে। মায়ের উল্টো দিকে আমরা দুই ভাই, আমাদের মাঝখানে বাবা।
মা বললেন, বনলতা! দেখো, এদের তিনজনকে কী সুন্দর লাগছে! মা, তোমার মোবাইলে এদের একটা ছবি তোলো তো। টগর, তোর বাবাকে হাসতে বল। কেমন প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে আছে। এই, তুমি হাসো তো, ছবি উঠছে।
ট্রেনের গতি বাড়ছে। বাবা বললেন,
It was many and many a yeaৎ ago
In a kingdom by the sea.
That a maiden theৎe lived whom you may know
By the name of Annabel Lee.
[শেষ]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০১, ২০১১
Leave a Reply