প্রভূত শ্রমের ফসল
আখতার হুসেন
রবীন্দ্রনাথ, গীতাঞ্জলি ও দুই হ্যারিয়েট—হাসান ফেরদৌস \
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন \ প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী \ প্রকাশকাল: ২০১১ \ মূল্য: দুই শ আশি টাকা।
‘এই কাহিনি অনেকেই লিখেছেন। আমি যে নতুন খুব কিছু যোগ করেছি, দাবি করি না। তবে চেষ্টা করেছি এ বিষয়ে সম্ভাব্য সব তথ্য মিলিয়ে দেখতে ও সে কাহিনি পূর্ণাঙ্গাকারে লিপিবদ্ধ করতে।’ তাঁর প্রতিশ্রুত লক্ষ্য পূরণে তিনি যেভাবে সর্বত্রগামী হন, তন্ন তন্ন করে তথ্যের সন্ধান করেন, ছেঁকে তোলেন তথ্যের পর তথ্য, তা রীতিমতো সম্ভ্রম জাগানিয়া। রবীন্দ্রনাথ, গীতাঞ্জলি ও দুই হ্যারিয়েট হাসান ফেরদৌসের একেবারে আনকোরা রচিত বই। বলা বাহুল্য, বিষয়ের কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথ—তাঁর বিশ্বকবি হয়ে ওঠার প্রাক-সময় এবং তৎপরবর্তী একটা উল্লেখযোগ্য কালপরিসর। মাত্র তিনটি প্রবন্ধের মাধ্যমে হাসান তাঁর দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। শিরোনাম ‘গীতাঞ্জলি: তর্ক-বিতর্কের ১০০ বছর’, ‘তুমিই আকাশ, তুমি নীড়’ এবং ‘দুই হ্যারিয়েট’।
এই বইয়ের প্রথম প্রবন্ধটি দীর্ঘ। মোট ৯৮ পৃষ্ঠার। তথ্যবহুল। কিন্তু এই বাহুল্য কোনোভাবেই এর পাঠ থেকে বিরত করে না। বরং আগ্রহী করে তোলে আমগ্ন পাঠে।
রবীন্দ্রনাথকে, সর্বপ্রথম একজন পীতবর্ণের এশীয়কে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ঘটনা নিজের দেশ তো বটেই, বিশ্বের নানা প্রান্তে সোল্লাস আলোড়ন তোলার পাশাপাশি সবিস্ময় বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। ‘গীতাঞ্জলি: তর্ক-বিতর্কের ১০০ বছর’ প্রবন্ধে এর বিবরণ প্রায় অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন হাসান। তবে সম্পৃক্ত বিষয়ে তথ্য সন্নিবেশে কোথাও তিনি একরৈখিকতার আশ্রয় নেননি। নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন এই বলে, ‘এই তর্ক-বিতর্ক সবই কি একদম অর্থহীন ও অবিবেচনাপ্রসূত?’ এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হাসান যেসব তথ্য হাজির করেন, রীতিমতো বিস্ময়কর। আমরা জানতে পারি রবীন্দ্রনাথ নিজেই বিশ্বাস করতেন, ‘এশীয় লেখকেরা’ এই পুরস্কারের যোগ্য নয় বলে। তাই যদি হবে, ‘তাহলে ড. জগদীশচন্দ্র বোস, যিনি আধুনিক সময়ে ভারতের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক, তিনি কেন পুরস্কার পেলেন না?’—রবীন্দ্রনাথের সক্রোধ প্রশ্ন। অথচ সেই পুরস্কারই যখন তাঁর কপালে জোটে, তাই নিয়ে সীমাহীন তর্ক-বিতর্ক। অন্তহীন উল্লাস। রবীন্দ্রনাথ নিজেই পীড়িত হন।
হাসানের বইয়ের সূত্রে আবারও আমরা জানতে পারি, গীতাঞ্জলির স্বকৃত ইংরেজি অনুবাদের কল্যাণেই রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি ভাষী কবি হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তথ্যটি নতুন নয়। কিন্তু হাসানের কৃতিত্ব এখানেই যে রবীন্দ্রনাথ অন্য বিচারে অর্থাৎ গীতাঞ্জলির সুইডিস ও নরওয়েজীয় ভাষায় অনুবাদের কল্যাণে এবং নোবেল কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান এন্দার্স অস্টারলিং তার স্বাদ গ্রহণে মুগ্ধ হওয়াতেই রবীন্দ্রনাথ যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সে দিকটি তুলে ধরতে তিনি কসুর করেননি। এ রকমের আরও অনেক তথ্যবহুল মত-প্রতিমতের সমাহার ঘটিয়েছেন তিনি।
‘গীতঞ্জলি: তর্ক-বিতর্কের ১০০ বছর’ প্রবন্ধটি ‘নোবেল পুরস্কার: সাহিত্যে আদর্শগত প্রবণতা?’, ‘এজরা পাউন্ড ও ডব্লিউ বি ইয়েটস,’ ‘গীতাঞ্জলি ও চার্লস এন্ড্রুজ’, ‘ভালো ইংরেজ ও মন্দ ইংরেজ’, ‘গীতাঞ্জলি: প্রেমের না ভক্তির’, ‘ইংরেজি গীতাঞ্জলি: অধরা রবীন্দ্রনাথ’ এবং ‘শেষ কথা’ শীর্ষক সাতটি উপশিরোনামে বিভক্ত। প্রতিটি শিরোনামেই প্রাসঙ্গিক তথ্যের প্রাচুর্য মন ও মননকে আলোকিত করে।
এ বইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয়, অর্থাৎ শেষ প্রবন্ধের শিরোনাম যথাক্রমে ‘তুমিই আকাশ, তুমি নীড়’ ও ‘দুই হ্যারিয়েট’। দুটিই রবীন্দ্রনাথের জীবনকেন্দ্রিক।
‘একাধারে তুমিই আকাশ, তুমি নীড়’—নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থের ৮১ সংখ্যক কবিতার প্রথম চরণ। রবীন্দ্রনাথ নিজে অনুবাদ করে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করেন গীতাঞ্জলির অন্যান্য কবিতার সঙ্গে। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু গোল বাধে অন্য জায়গায়। ব্রিটেনের রাজকবি রবার্ট ব্রিজেস তাঁর প্রস্তাবিত কাব্য সংকলন দি স্পিরিট অব ম্যান-এ উল্লিখিত কবিতাটি কিছুটা সংশোধনসহ অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ তাতে আপত্তি জানান। অথচ রবার্ট ব্রিজেস নাছোড়। ব্যাপারটি নিয়ে দুই কবি ও অন্য আর যাঁদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, তা-ই এই প্রবন্ধের আলোচ্য।
গ্রন্থের শেষ প্রবন্ধ ‘দুই হ্যারিয়েট’। এই প্রবন্ধের কুশীলব দুই মার্কিন নারী। ‘একজন হ্যারিয়েট মনরো, শিকাগো থেকে প্রকাশিত পোয়েট্রি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। অন্যজন হ্যারিয়েট মুডি, মার্কিন কবি উইলিয়াম ভন মুডির বিধবা স্ত্রী।’ হাসান জানাচ্ছেন, ‘দীর্ঘদিনের এক গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিল বাঙালি কবি ও তাঁর মার্কিন অনুরাগিণীর মধ্যে।’ এও জানাচ্ছেন তিনি, ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনূদিত চিত্রা গ্রন্থটি মিসেস মুডিকেই উৎসর্গ করেছিলেন।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মাতৃসম জ্ঞান করতেন। এক বিচিত্র আত্মিক সম্পর্ক! শেষত মিসেস মুডির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই হার্দ্যিক সম্পর্ককে হাসান ‘অন্য রকম ভালোবাসা’ বলে অভিহিত করেছেন। এ প্রবন্ধেও তথ্য আছে, টীকাভাষ্য আছে। সর্বোপরি আছে, একটি ঘরোয়া রম্যভঙ্গি, যা অখণ্ড মনোযোগে প্রবন্ধ পাঠের বড় সহায়।
পোয়েট্রি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হ্যারিয়েট মনরো মার্কিন কাব্যামোদীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন কবি এজরা পাউন্ড। রবীন্দ্রনাথের ছটি কবিতা ছাপা হয়েছিল এজরা পাউন্ডের দীর্ঘ ভূমিকাসমেত ১৯১২ সালের ওই সাময়িকীটির ডিসেম্বর সংখ্যায়। এই প্রবন্ধের পাঠ আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে তখনই, যখন আমরা তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত হতে যাওয়া রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে হ্যারিয়েট মনরোর এই মন্তব্য পাঠ করি, যেখানে তিনি বলছেন, ‘কোনো অ্যাংলো স্যাক্সন কবির হাতে নয়, ইংরেজি কবিতার শক্তি প্রকাশিত হচ্ছে একজন হিন্দুর হাতে, যাঁর ইংরেজিতে রয়েছে ঐন্দ্রজালিক শক্তি…।’ এবং এও জানছি, ‘শিকাগোতে, বিশেষত পোয়েট্রি পত্রিকার ক্ষুদ্র দপ্তরে, রবীন্দ্রনাথের আগমন রীতিমতো আলোড়ন তুলে দেয়।’
এই বইয়ের পাঠ নিঃসন্দেহে এক সুখকর ঘটনা। হাসান ফেরদৌসের প্রভূত পরিশ্রমের ফসল এই বই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০১, ২০১১
Leave a Reply